‘আঙ্কেল, ভালো আছেন?’
আন্দাজ তেইশ-চব্বিশ বছর বয়সী এক ছেলে মাটিতে প্রায় মাথা ঝুকিয়ে আমার পা ছুঁয়ে সালাম করল৷ আমি কিছুটা বিস্মিত হলাম৷ গুরুজনের পা ছুঁয়ে সালাম করে এমন ছেলে যে আজকের দিনেও আছে—এটা দেখে যে কারুর বিস্মিত হওয়ার অধিকার নিশ্চয় আছে!
‘ভালো আছেন, আঙ্কেল!’
হাসি-গদগদ মুখে দ্বিতীয় বারের মতো প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিল অপরিচিত মনে-হওয়া ছেলেটি৷
ততক্ষণে স্ত্রী এসে আমার পাশে দাঁড়িয়ে পড়ার সুবাদে কদমস্পর্শী সালামের মতো পবিত্র দৃশ্য আরও একবার দেখার সুযোগ হয়ে গেল৷ স্ত্রীর ঘাবড়ে-যাওয়া চেহারা দেখে বুঝে নিলাম—তিনিও আমার মতোই বিস্মিত৷ তবে বিস্ময়ভাব লুকিয়ে ফেলার এক অত্যাশ্চর্য ক্ষমতা আমার স্ত্রীর আছে৷ তিনি তাঁর সেই ক্ষমতাবলে নিজের বিস্ময় একদমই গিলে ফেললেন৷ শুধু কি তাই! উল্টো সাহস দেখিয়ে প্রশ্ন করে বসলেন—‘কে তুমি? ঠিক চিনতে পারছি না তো!’
আকাশ থেকে টুপ করে এইমাত্র পড়ল—এমন ভাব করে ছেলেটি বলল, ‘কী বলছেন আন্টি! আমাকে চিনতে পারছেন না!’
যেন ওকে চিনতে না পেরে আমরা মস্ত কোনো অন্যায় করে ফেলেছি৷ স্ত্রীও আমার কম যান না৷ গলার স্বর আগের চেয়ে গম্ভীর করে ফেলেন৷ বলেন, ‘না, আসলে তোমাকে আগে কখনও দেখেছি বলে মনে করতে পারছি না৷’
‘আন্টি, আমি রাসেল৷ ফরিদের বন্ধু৷ জেভিয়ার্স স্কুলে একসাথে পড়েছি৷ প্রায়ই তো আসতাম, আন্টি৷ মনে নেই! আপনি তো দেখছি একদমই সব ভুলে বসে আছেন!’
‘ও, রাসেল৷ তোমাকে তো চেনাই যাচ্ছে না! কি গো তুমি চিনতে পারছ না? এ রাসেল৷ দাড়ি-গোফ গজিয়ে একদমই বেটা ছেলে হয়ে গেছে!’
শেষের কথাগুলো আমার দিকে ঘুরে বললেন৷ আমি সত্যিই এখনও ঠিক চিনে উঠতে পারিনি৷ তা ছাড়া ছেলের বন্ধুদের সাথে কোনোকালেই আমার তেমন চেনা জানা ছিল না৷ এ কথা তো আর মুখের ওপর বলে দেয়া যায় না! তাই চেহারায় এমন একটা ভাব ফুটিয়ে তুললাম যেন খুব চিনেছি৷ তবে এবার আর চমকালাম না৷ নারী যে মুহূর্তে রূপ বদলে ফেলতে পারে এই পঞ্চাশোর্ধ বয়সে আরও একবার তার চাক্ষুষ প্রমাণ প্রত্যক্ষ করে সামান্য হাসলাম শুধু৷
‘বসো, বাবা৷ তা, এতদিন পর বুঝি আন্টিদের কথা মনে পড়ল!’
‘না, আসলে ফরিদ কানাডা যাওয়ার পর এদিকটাতে তেমন আসা হয়নি৷’
‘বাবা-মা ভালো আছেন তো!’
‘বাবা তো বছর দুয়েক হলো মারা গেছেন৷ মায়ের শরীরটাও ভলো যাচ্ছে না৷ দু বার স্ট্রোক করে এখন পুরোপুরি শয্যাশায়ী৷’
স্ট্রোকের কথা শুনেই কিনা স্ত্রী আমার খানিক মুষড়ে পড়লেন৷ আমার মনে পড়ে গেল—তাঁর হৃদযন্ত্রটাও কিছুদিন হলো বড্ড গোলমাল করছে৷
রাসেলের সাথে আমার স্ত্রীর আরও কথা হলো৷ অবশেষে ‘আন্টি, আজ তবে উঠি’ উত্তরে আমার স্ত্রী মুচকি হেসে ‘ঠিক আছে৷ আবার আসবে কিন্তু’ বললে দুজনের আলাপচারিতা সেদিনের মতো সমাপ্ত হয়৷ এবং ‘এ পথে এলেই আবার এসে আপনাদের জ্বালিয়ে যাব’—বলে একরকম শাসিয়ে রাসেল বিদায় নেয়৷
সেদিন বিদায়কালে আমার স্ত্রী অই যে বলেছিলেন—‘আবার এসো কিন্তু!’ রাসেল তার সে কথা ঠিকই রেখেছিল৷ স্ত্রী হয়তো-বা সামাজিকতা রক্ষার ছলে এমনি কথার কথা বলেছিলেন৷ কিন্তু ছেলেটা মোটেও কথার কথা হিসাবে নেয়নি৷ তার বোধ-বুদ্ধি কিংবা চক্ষু লজ্জার যথেষ্ট ঘাটতি ছিল বলে বোধ করি৷ সেদিনের পর থেকে রাসেলের আগমন এ বাড়িতে প্রায় নিয়মিত হয়ে উঠলো৷ প্রায়দিন দেখতাম—ড্রয়িংরুমে দুজনে বেশ গল্প জমিয়ে নিয়েছে৷ ভেতরে ভেতরে মৃদু আপত্তির কুণ্ডলি ঘনীভূত হলেও বাইরে তার বিন্দুমাত্র প্রকাশ করতে পারতাম না৷ উপরন্তু স্ত্রীর আহ্বানে মাঝে মাঝে তাদের আলাপচারিতায় অংশী হতাম৷
এভাবেই দিনগুলো যাচ্ছিল৷
রাসেলের প্রভাবও আমার স্ত্রীর মনে শেকড় গেড়ে বসছিল৷ কিছুটা অনুমান করছিলাম৷ শেকড় থেকে চারা গজিয়ে সে চারা যে রীতিমতো ডালপালা বিস্তার করতে শুরু করেছে এটা আঁচ করলাম এক রাতে৷
লাইট বন্ধ করে শুতে যাব৷ স্ত্রী বললেন, ‘রাসেল ছেলেটা খুবই ভালো, না?’
প্রশ্নের ভঙ্গিতে বললেও এটা যে তার কোনো কৌতূহল কিংবা জিজ্ঞাসা নয়, সিদ্ধান্ত; সেটা বুঝতে পেরে চুপ থাকাটাই কর্তব্য মনে করলাম৷
‘আমাদের টুম্পার সাথে বেশ মানাবে কিন্তু!’
আমার স্ত্রীর এই এক মুদ্রাদোষ৷ কোন ছেলে তার মনে ধরলেই হলো, তাকে টুম্পার পাশে এনে দাড় করানো চায়৷ এবার আমি মৌনতা ভাঙলাম৷ স্ত্রী আমার যেহেতু মুখ ফসকে বলেই ফেলেছেন ‘আমাদের টুম্পা’ তাই টুম্পার ব্যাপারে আমারও যে কিছুটা অধিকার আছে সেটা উপলব্ধ করেই কিনা মুখ খুলবার সাহস করলাম৷
‘মেয়ে আমাদের গ্রাজুয়েশন করছে৷ ওটা শেষ করুক৷ আর তা ছাড়া…’
‘তাছাড়া কী? মেয়েকে বুড়ি বানিয়ে বিয়ে দিবে নাকি!’
‘না, ঠিক এটা বলতে চাইনি৷ বলছি রাসেল ছেলেটা…’
‘খারাপ কী ছেলেটা! উচ্চ শিক্ষিত৷ ছোটোখাটো কী একটা ব্যবসাও আছে বলছিল৷’
‘তবু সিদ্ধান্তটা নেয়ার আগে একটু ভালো করে জেনে নিলে হতো না! যা দিনকাল…’
‘সে তোমার ভাবতে হবে না৷ তুমি লাইট বন্ধ করো৷ আমার ঘুম পাচ্ছে’ বলে নিজেই সুইচ অফ করে শুয়ে পড়ল৷
সকালে থলে-হাতে বাজারে যাওয়া আমার বহুদিনের অভ্যাস৷ গলদা চিংড়ির দরদাম করছি বিদ্যুচ্চমকের মতো মনে পড়ল স্ত্রীকে নিয়ে আজ ডাক্তার শফিকের কাছে যাবার কথা৷ হাতের কব্জি উল্টে তো রিতীমতো আতকে উঠলাম৷ এই রে, একদমই সময় নেই৷ আল্লাই জানে, আজ কী আছে কপালে৷ পড়িমড়ি বাসায় ছুটে এসে দেখি স্ত্রী আমার ভাবলেশহীন বসে আছেন৷ ঢকঢক করে এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি খেয়ে গলা ভিজিয়ে নিলাম৷
‘চলো, ওঠা যাক৷’
‘থাক, তোমার আর ব্যাস্ত হয়ে কাজ নেই৷’
গলার আওয়াজ মনে হলো শীতল পানির চেয়েও ঠাণ্ডা৷ লক্ষণ সুবিধার মনে হচ্ছে না৷ ঝড়ের পূর্বাভাষ টের পাচ্ছি৷
‘রাসেলকে আসতে বলেছি৷ ও এলে বেরুব৷’
‘ও…’
মনে মনে বললাম, যাক বাঁচা গেল৷
এরই মধ্যে কলিংবেল বেজে উঠলো৷
‘দেখো, এলো বোধহয়৷’
‘দেখছি৷’
দরজা খুলে যে যুবককে দেখলাম, রাসেলের চেহারার সাথে কোনো দিক থেকেই তার কোন মিল খুঁজে পেলাম না৷ চোখ রগড়ে নিয়ে ফের তাকালাম৷ বুড়ো হয়ে গেছি, চোখে কিছুটা এলোমেলো দেখি হয়তবা৷ এবার দেখি, অভ্যাগত একজন নয়; দুজন৷ আমি ‘কে তোমরা’ বলার আগেই আমাকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে ঘরে ঢুকে ছিটকিনি এঁটে দিল৷ মুহূর্তেই দুজন দুজনার সামনে এসে দাঁড়াল৷ না, চোখে কোন গোলমাল হয়নি৷ চোখ আমার ঠিকই আছে৷ না হলে একজনের হাতের তীক্ষ্ণ ধারালো ছুরি ও অন্যজনের হাতের যে ছোট্ট আগ্নেয়াস্ত্রটি তা এমন পষ্ট দেখতে পেতাম না৷ ‘তুই বুড়িটাকে ধর, আমি বুড়োকে দেখছি’ পিস্তল-হাতে ছেলেটা ছুরিওয়ালা ছেলেটাকে বলে৷ ‘বুড়ি’কে ধরার প্রয়োজন পড়ল না৷ স্ত্রী আমার তার আগেই ‘ধপাস’ একটা শব্দ তুলে ‘সোফাশায়ী’ হলেন৷ জ্ঞানশূন্য হলেন না তার হৃদযন্ত্রের ক্রিয়াশূন্য হলো—ঠিক বোঝা গেল না৷
পিস্তল হাতের ছেলেটা আমাকে বলে, ‘আলমারারির চাবি বের কর, নইলে এক টিপে তোর রূহ বের হয়ে যাবে।’ ছেলের বয়সী এক ছোকরা এভাবে তুই তোকারি করাতে লজ্জায় কান লাল হয়ে গিয়েছিল, না তার হুমকিতে ভয়ে আমার চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল আজ এতদিন পর ঠিক বলতে পারব না৷ তবে চোখের সামনে উচিয়ে ধরা পিস্তলটা ‘খেলনা’ ভ্রম হলেও সেটা আসলেই ‘আসল’ কিনা না নিতান্তই কোন খেলনা ওই পরিস্থিতে সে কৌতূহল নিবৃত্ত করতে মোটেও বেগ পেতে হয়নি৷ অগত্যা তোশকের নিচ থেকে চাবি বের করে দিলে ছুরি ওয়ালা ছেলেটা আলমারি খুলে টাকা গহনা সব মেঝেতে স্তুপ করে অতঃপর একটা কাপড়ের ব্যাগে দ্রুত ভরে ফেলে৷
সব যখন শেষ আমাকে পিঠ মোড়া দিয়ে বেঁধে মেঝেতে ফেলে রেখে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে চলে যায়৷ সবকিছু এতই দ্রুত ঘটল ধাতস্থ হতে বেশ সময় লেগে গেল৷ বেশ খানিকটা সময় ঘোরের মধ্যে কাটালাম৷ উঠতে গিয়ে যখন হাতে-পায়ে রশির টান অনুভব করলাম স্তম্ভিত আমি বুঝতে পারলাম ঘটনা সত্যি৷
এভাবে কতটা সময় পার হলো আন্দাজ করতে পারিনি৷ কিছু সময় পর দরজায় তালা ভাঙার আওয়াজ পেলাম৷ দরজা খুলে টুম্পা ঢুকেই কেঁদে-কেটে অস্থির৷
‘বাবা, তোমার এ অবস্থা কেন? মা কোথায়!’
‘আমি ঠিক আছি৷ তোর মাকে দেখ৷’
আমি চোখ নেড়ে জ্ঞানশূন্য স্ত্রীর দিকে ইশারা করলাম৷ টুম্পা মায়ের কাছে ছুটে গেল৷ ড্রাইভার এসে হাত পায়ের বাঁধন খুলে দিলে আমি উঠে গিয়ে পুলিশ ও ডাক্তার শফিককে আসতে বলি৷ ততক্ষণে স্ত্রীর হারানো চৈতন্য ফিরে এসেছে৷
‘যাক কপাল ভালো, ডাকাতরা ক্ষতিকর কোনো মেডিসিন ব্যবহার করেনি৷’
ডাক্তার শফিক আমাদের অভয় দিতে চেষ্টা করে৷ আর সব শোনার পর কিছুটা চিন্তিত মুখ নিয়ে পুলিশ অফিসার বলেন, ‘আমার তো মনে হচ্ছে এটা পেশাদার কোন গ্রুপের কাজ না৷ ড্রাগ এডিক্টেড পোলাপানের কাজ বলে মন হচ্ছে৷ আজকাল তো কলেজ-ভার্সিটি পড়ুয়া ছেলেরাও নেশার টাকা জোটাতে এ ধরনের কাজ করে বসছে৷ আমরা এ লাইনেই তদন্ত করবো৷ আশা করছি— অপরাধী ধরা পড়বে৷’
অবশেষে ‘আপনারা ঘাবড়াবেন না, সব ঠিক হয়ে যাবে’ বলে পুলিশ অফিসার আমাদের আস্বস্ত করে এবং ডাক্তার শফিক ‘নিজেদের খেয়াল রাখবেন, আজ তাহলে উঠি’ বলে চলে গেলে ঘরে আমরা বিস্ময়াবিভূত তিনটি মাত্র প্রাণি এই রকম সময়ে ঠিক কোন কাজটি লাগসই হবে খুঁজে না পেয়ে নির্বাক বসে থাকি৷
বিকালে থানা থেকে ফোন আসে৷
‘কিছু সময় আগে আপনার বাসার অদূরেই এক যুবকের লাশ মিলেছে৷ আমাদের সন্দেহ ওই দলেরই কেউ হবে৷ একটু এসে দেখবেন! যদি শনাক্ত করতে পারেন…’
লাশ দেখে আমি চমকে উঠি৷
এ যে রাসেল! সে এভাবে রক্ত মেখে শুয়ে আছে কেন!
ওসি সাহেবের কথায় চমক ভাঙে৷
‘আমরা ধারণা করছি রাসেলের সূত্রেই এ ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে৷ সে যেহেতু আপনাদের পরিচিত তাই অন্যদের পাঠিয়েছে৷ পরে পয়সা ভাগাভাগি নিয়ে বিবাদে জড়িয়ে হয়তো-বা রাসেলের এই পরিণতি৷’
ওসি সাহেব আরও জানান,
‘রাসেল অনেকদিন ধরেই এ লাইনে৷ পরিচিত, আধা পরিচিত বহু মানুষের ক্ষতি ওরা করে ছেড়েছে৷ আশা করছি এবার পুরো গ্যাঙটাকেই ধরে ফেলব৷’
স্ত্রীকে খবরটা দিতেই হতবিহ্বল হয় পড়েন৷ কেমন অবিশ্বাসী দৃষ্টিতে কতক্ষণ চেয়ে থেকে বলেন, ‘এও কী হয়!’
টুম্পা দরজা বন্ধ করে নিজের ঘরে বসে আছে৷ আমি এ অবসরে স্ত্রীর পাশে বসলাম৷ তার কাঁধে স্বস্তির স্পর্শ রেখে বহুদিন পর ডাকনাম ধরে বললাম, ‘রাবেয়া! আজকের পৃথিবীতে অবিশ্বাস্য এমন অনেক কিছুই এখন হয়।’
নভেম্বর, ২০২০