অনুবাদ একটি গুরুভার ও দায়িত্বপূর্ণ কাজ। একটি গ্রন্থের অনুবাদ করা মানে গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয় ও লেখকের প্রতিনিধিত্ব করা। এক্ষেত্রে বিশ্বস্ততা, দক্ষতা পূর্বশর্ত বলা যায়। এ বৈশিষ্ট্য নিজের মধ্যে ধারণ না করে, অনুবাদের প্রকৃত কৃতিত্ব লাভ করা যায় না। অন্য কথায়, অনুবাদ একটি শিল্প! আর শিল্পের জন্য চাই সৃজনশীলতা এবং প্রয়োজনীয় দক্ষতা।
অনেকটা অভ্যাসের উপর নির্ভর করে অনুবাদের সাফল্য। অনুবাদের সাফল্যের রহস্য এই সত্যের মধ্যে নিহিত যে, এটি মূল পাঠ্যের চেয়ে বেশি আকর্ষণীয় হবে এবং এটি পড়ে মনে হবে যে, এটি কোনো অনুবাদ নয় বরং সহজাত রচনা। এই বিবেচনায়, অনুবাদ একটি কঠিন পরীক্ষায় পরিণত হয়। এবং সত্যি বলতে, এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার সামর্থ্য সকলের নেই।
অনুবাদ শুধু কোনো বইয়ের ভাষান্তর নয়, এর মধ্য দিয়ে জ্ঞান, সংস্কৃতি, চিন্তা ও মূল্যবোধেরও স্থানান্তর হয়। ইতিহাসে দেখা গেছে, অনূবাদের সাহায্য নিয়েই সভ্যতার বিকাশ সম্ভব হয়েছে। সাধিত হয়েছে এর উত্থান-পতন। অনুবাদের হাত ধরে প্রচার ও প্রতিষ্ঠা পেয়েছে বাতিল মতাদর্শ ও চিন্তা-দর্শন। কাজেই একজন অনুবাদকের খুব সতর্ক, সুবিবেচক এবং দূরদর্শী হতে হবে। স্থানিক ও কালিক ন্যায্যতা ও উপযোগিতা বিচার করে দেখতে হবে। সমাজের উপর অনূদিতব্য বইটির প্রভাব কেমন হতে পারে, তার সযত্ন বিবেচনাও একজন অনুবাদকের জন্য জরুরি!
অনুবাদ করার সময় অনুদিতব্য রচনাটির মেজাজ এবং ক্যাটাগরি আমলে নিতে হবে। সাহিত্যনির্ভর বই ও গবেষণাধর্মী বইয়ের অনুবাদে রয়েছে ফারাক– এটা বুঝতে হবে। সাহিত্যনির্ভর বইয়ে কিছুটা ভাবানুবাদের পরিসর থাকলেও গবেষণাধর্মী বইয়ে এ ধরনের অবকাশ খুব একটা নেই। চিন্তা ও গবেষণাধর্মী এবং শাস্ত্রীয় ভাষা ও বৈদগ্ধতায় রচিত গ্রন্থের অনুবাদ করার ক্ষেত্রে, মূল গ্রন্থের শব্দ, বর্ণনাধর্মকে অক্ষুন্ন রাখতে হয় যথাসম্ভব। কারণ, অনেক সময়, শব্দ ও বর্ণনাধারাই একটি গবেষণাকর্মের স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্ট্যকে চিহ্নিত করে; যার সামান্য বিচ্যুতি উক্ত গবেষণার মান-মূল্যকে খুইয়ে দিতে পারে।
হতাশার কথা এই যে, আমাদের অনুবাদকর্মে সাধারণত এই অপরিহার্য বাস্তবতা সম্পর্কে অমার্জনীয় উদাসীনতা লক্ষ্য করা যায়। এমনও দেখা যায় যে, সিরিয়াস, গবেষণাধর্মী গ্রন্থ অনুবাদের পর হয়ে উঠেছে গল্প কিংবা সাধারণ সাহিত্যের বই! ফলশ্রুতি এই হয়েছে যে, চিরায়ত ইসলামী জ্ঞান-ভাণ্ডারের এমন অনেক আকরগ্রন্থও তার প্রাণসত্তা হারিয়েছে!
সম্প্রতি ইসলামী প্রকাশনী জগতে একটা জাগরণ লক্ষ্য করা যাচ্ছ—যা অবশ্য আশাব্যাঞ্জক। এক্ষেত্রে অনুবাদশিল্প অবশ্য প্রধান ভূমিকা রাখছে। বিদেশী ভাষা, বিশেষত আরবী ও উর্দু ভাষার ভালো কিছু কিতাব আমরা এই অনুবাদের কল্যাণে হাতে পেয়েছি এবং পড়তে পারছি। এধারা জারি থাকুক—এই কামনা করি। তবে একইসাথে দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় যে, অনুবাদের ক্ষেত্রে আমরা যেমন অদক্ষতা ও অপেশাদারিত্বের পরিচয় দিচ্ছি, তেমনি গ্রন্থ, বিষয়বস্তু ও লেখক নির্বাচনেও দায়িত্বহীনতা এবং মানসিক সংকীর্ণতার জানান দিচ্ছি। বরাবর একই লেখককে আমরা অনুবাদ করছি, তার সকল বইয়ের তর্জমা করছি, ভাবখানা এমন যে, জগতে এই দুই একজন আল্লামা ছাড়া তৃতীয় কেউ নেই। পরন্তু এটাও তো জরুরি নয় যে, একজন ভালো লেখকের সকল রচনাই ভালো হবে, উপকারী এবং উপযোগী হবে। কিন্তু আমরা কেন জানি এলোপাতাড়ি তাই করে চলছি!
অপরদিকে, এমনও দেখা যায় যে, একটি বইয়ের একাধিক অনুবাদ চলছে। অথচ, বাজারে বিদ্যমান অনুবাদটি ভালো এবং প্রতিষ্ঠিত অনুবাদকের হাতে অনুদিত হয়েছে। অথচ এমন অসংখ্য স্বার্থক রচনা পড়ে আছে, যা অনুবাদ হওয়ার যোগ্য। আমাদের এ-জাতীয় কায়-কারবার ইসলামের ভাবাদর্শের জায়গা থেকে জ্ঞানচর্চা ও বিকাশ এবং মানুষের চাহিদা ও প্রয়োজনীয়তাকে উপেক্ষা করে, নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থপরতা ও মতাদর্শিক প্রচারণাকে প্রাধান্য দেওয়ার কদর্যতারই প্রদর্শন নয় কি! এমনই তো বোধহয়। ইসলামী প্রকাশনী জগতের এই আশাজাগানিয়া জাগরণকে অব্যাহত এবং গন্তব্যস্পর্শী করতে হলে, এর ব্যাপক-গভীর সুফল পেতে হলে, আমাদের এধরণের মনোভাব ও আকাঙ্খাকে পরিহার করা জরুরি মনে করি। উম্মাহর বৃহত্তর কল্যাণ চেতনা ও সমাজ সংস্কারের মহৎ প্রেরনায়, আমাদেরকে বিশুদ্ধ জ্ঞান-চর্চা ও বিকাশে ভূমিকা রাখতে হবে, নিঃস্বার্থভাবে এবং নিরপেক্ষভাবে।
অনুবাদ প্রসঙ্গে মনে রাখার মতো আরেকটি ব্যাপার হচ্ছে, অনুবাদের যে প্রথম খসড়াটি আপনি তৈরি করেছেন, তাতে ত্রুটি থাকবেই, এটা নিশ্চিত, তা যতই ছোটখাট হোক না কেন। অতএব, আপনাকে অনূদিত খসড়ার নজরে সানি বা পুন:নিরীক্ষণ করতে হবে, আবশ্যিকভাবেই। কোনো বিষয়বস্তুই সংশোধনের প্রয়োজনীয়তার ঊর্ধ্বে নয়। তবে দ্বিতীয়বার দেখা ও সংশোধন-প্রক্রিয়ায় মাঝখানে কিছুটা সময় বিরতি নেওয়াকে আমার জরুরি মনে হয়। এতে অনুবাদের কাজে পরিশ্রমের ফলে যে বিরক্তি ও ক্লান্তি ইতিমধ্যে নিজের ভেতর তৈরি হয়েছে, তা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। এবং একইসাথে নতুন উদ্যম ও সজীবতা আসবে তনুমনে; যা এই কাজের সময় খুবই প্রয়োজন এবং ফলপ্রসূ!
শিক্ষার্থী, মাহাদুল ফিকরি ওয়াদদিরাসাতিল ইসলামিয়্যা, ঢাকা