পরীক্ষা শেষে ছুটির ঘোষণা হয়েছে সেই সকালে। আমার ভালো লাগছিল না। বের হতে হতে বিকেল হয়ে গেছে। কাউন্টারে এসে বাসে যখন উঠি, দিগন্তে সূর্য তখন ডুবি ডুবি করছে।
শহরের ব্যস্ততাকে ছুটি দিয়ে কিছুদিনের জন্য গ্রামের পথে ছুটেছি। প্রতিবার গ্রামে যাওয়ার সময় আমার পুরান ঢাকার সাথে দেখা হয়ে যায়। তাই পুরান ঢাকার প্রতি মনে আলাদা মায়া জন্মে গেছে। এখানে এলে ইচ্ছে করে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করি। চলে যাবার আগে কাছ থেকে একটু ছুঁয়ে দেখি, চেয়ে দেখি। ভেতরে রহস্য আর ভালোলাগার পুলক জাগে। এই যে পুরান ঢাকার পুরাতন সব ভবন আর সেকেলে ঐতিহ্যের সাক্ষী দেয়াল, বুড়িগঙ্গার ‘ধ্বংসাবশেষ’ এবং সরু সরু গলি-ঘেরা গিঞ্জি এলাকা—এ-সব আমার ঘেঁটে দেখতে মন চায়। কেননা, হাসি-কান্নার এবং আশা-হতাশার কত দৃশ্য, কত গল্প নীরবে দেখে যায় পুরান ঢাকার এই শহর, এইসব পুরান পথঘাট আর ভবনগুলো! দেখে দেখে নীরব সাক্ষী হয়ে থাকে। জীবনের নানারঙা গল্পেরা এখানে এসে ভিড় করে চলছে যুগের পর যুগ ধরে। সেই ডায়েরি খুললে হয়তো আমারও এক-দুইটা গল্প খুঁজে পাওয়া যাবে শৈশব-কৈশোরের।
বাসে আমার পাশের সিটের ভদ্রলোক অমুসলিম। সে নিজে বলেনি। বিষয়টা আঁচ করতে পেরেছি তার গায়ে একটি প্রতীক দেখে। ব্যবহার অমায়িক। কিছুক্ষণ বিক্ষিপ্ত আলাপ হলো তার সাথে। এরপর যে যার মতো ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। ভদ্রলোক ফোন টিপছেন। আমি ব্যাগ খুলে একটা সাহিত্য-ম্যাগাজিন বের করলাম পড়ার জন্য। বাসে ওঠার আগে বাংলাবাজার ঘুরতে গিয়ে ম্যাগাজিনটা সংগ্রহ করেছিলাম। গাড়ির ঝাঁকুনি উপেক্ষা করে যৎসামান্য পড়া যাচ্ছিল, তাতেই খুশি আমি। একটু পর গাড়ি বুড়িগঙ্গা সেতুতে ‘চাকার্পণ’ করল। জানালা থেকে এখন স্পষ্ট বুড়িগঙ্গার করুণ দৃশ্য দেখতে পাচ্ছি। এই যে বুড়িগঙ্গাকে আমরা কত নিন্দাই, দোষটা তো আর বুড়িগঙ্গার না। আমরা মানুষেরা বড় বেইনসাফ। বুড়িগঙ্গা কোনো প্রতিবাদ করে না। নীরবে আমাদের অত্যাচার সহ্য করে আর ইতিহাসের পাতায় আমাদের অবিচারের গল্পগুলো লিখে রাখে। বুড়িগঙ্গার দিকে তাকালে মনে হয়, তার বুকে অনেক ব্যথা, অনেক কথা জমে আছে। দূর থেকেই বুড়িগঙ্গাকে বিদায় জানালাম। মনে মনে ব্যথিতও হলাম।
গাড়ি একটু একটু করে এগিয়ে চলছে। হাতে ম্যাগাজিনটা ধরে ছিলাম। ফের চোখ ফেরালাম তাতে। আলো কমে আসছে দিনের। আবছা আলোয় আরো কিছুদূর পড়লাম। মায়ার শহরটাকে পেছনে ফেলে গাড়িও কিছুদূর এগিয়েছে। অন্ধকারও আরেকটু গাঢ় হয়েছে। ম্যাগাজিনটা ব্যাগে রেখে বাইরের প্রকৃতিতে মনোযোগী হলাম। শীতকালের প্রকৃতি ঝিমিয়ে এসেছে। সন্ধ্যার আলোয় দেখতে ভালো লাগছিল। গ্লাসের ভেতর থেকেও বাইরের ঠান্ডা অনুভব করা যাচ্ছিল। কেরাণীগঞ্জের এই খালি জায়গাগুলো মনকে অন্য রকম স্পর্শ করে। প্রকৃতির চোখে চোখ রেখে তার আয়োজনগুলো উপভোগ করি। এখানে মানুষের বিচরণ কম, তাই প্রকৃতির আয়োজনই বেশি। সব ভুলে আমি বাইরে তাকিয়ে থাকি। পৃথিবীর সাথে নির্জন প্রকৃতির এই প্রান্তর কীভাবে আঁধারে ডুবে যায় চেয়ে চেয়ে দেখি। ভালো লাগে আমার। আমার অনুভূতিও আঁধারে ডুব দেয় প্রকৃতির সাথে।
জানুয়ারি ২০২২