সেই ছাত্রবেলা থেকেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে ছিলেন সোচ্চার ও প্রতিবাদী। তাঁর উদ্দাম তারুণ্যের সময় থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন অবধি বহু বার তাঁকে কারাবরণ করতে হয়েছে। নানা মেয়াদে জীবনের মূল্যবান অনেকগুলো বছর তিনি যাপন করেছেন কারাগারের নিঃসঙ্গ প্রকোষ্ঠে।
কারাগারে বসে বসে কারাকর্তৃপক্ষ থেকে সরবারহকৃত খাতায় তিনি লিখেছেন নিজের জীবনের গল্প এবং সংগ্রামের আখ্যান। কখনো-বা নিজের একান্ত অনুভূতি মেলে ধরেছেন রোল-টানা পৃষ্ঠাগুলোতে, দিয়েছেন সমকালীন পরিস্থিতির নিখুঁত বর্ণনা। আর প্রচ্ছন্নভাবে এতেই রোপিত হয়েছিল একটি স্বাধীন ভূখÐের স্বপ্ন। স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেসা সেসব খাতা সংরক্ষণ করেছিলেন পরম যতœ নিয়ে। তারপর বহু ঝড়-ঝাপ্টা বয়ে গেছে শেখ পরিবারের ওপর দিয়ে। খাতাগুলো কখনো হারিয়েছে, কখনো আবার খুঁজে পাওয়া গেছে অনেক বছর পর। ইতিহাসের অমূল্য সেসব দলিলেরই গ্রন্থিত রূপ ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’।
বই দু’টো পাঠের শুরুতে ভূমিকা পড়তে গিয়ে পাঠক পিতৃপরায়ণা এক কন্যাকে আবিস্কার করবেন। ঘোরলাগা বিস্ময় নিয়ে দেখবেন নতুন এক শেখ হাসিনাকে। যিনি নিজের পিতার স্মৃতিমোড়ানো কয়েকটি খাতা এবং এর সংরক্ষণ, হারিয়ে যাওয়া ও পুনরুদ্ধারের গল্প বলছেন এক আটপৌরে মেয়ের জবানেÑ‘আব্বার লেখা এই খাতার উদ্ধার আমার মায়ের প্রেরণা ও অনুরোধের ফসল। আমার আব্বা যতবার জেলে যেতেন মা খাতা, কলম দিতেন লেখার জন্য। বার বার তাগাদা দিতেন। আমার আব্বা যখন জেল থেকে মুক্তি পেতেন মা সোজা জেল গেটে যেতেন আব্বাকে আনতে আর আব্বার লেখাগুলি যেন আসে তা নিশ্চিত করতেন। সেগুলি অতি যতেœ সংরক্ষণ করতেন।…’
অসমাপ্ত আত্মজীবনী
‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে ফুটে উঠেছে কর্মব্যস্ত ও সংগ্রামমুখর বঙ্গবন্ধুর বর্ণাঢ্য জীবনের পরতে পরতে লুকিয়ে থাকা সাদামাটা জীবন ও সংসারের চিত্র। ২০৯ নম্বর পৃষ্ঠা থেকে কোট করে এনে বইয়ের শুরুতেই এ চিত্রের একটি সংক্ষিপ্ত রূপ সেঁটে দেওয়া হয়েছে এভাবেÑ‘একদিন সকালে আমি ও রেণু বিছানায় বসে গল্প করছিলাম। হাচু ও কামাল নিচে খেলছিল। হাচু মাঝে মাঝে খেলা ফেলে আমার কাছে আসে আর “আব্বা আব্বা” বলে ডাকে। কামাল চেয়ে থাকে। এক সময় কামাল হাচিনাকে বলছে, “হাচু আপা, হাচু আপা, তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা বলি?” আমি আর রেণু দু’জনেই শুনলাম। আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠে যেয়ে ওকে কোলে নিয়ে বললাম, “আমি তো তোমারও আব্বা।” কামাল আমার কাছে আসতে চাইত না। আজ গলা ধরে পড়ে রইল। বুঝতে পারলাম, এখন আর ও সহ্য করতে পারছে না। নিজের ছেলেও অনেকদিন না দেখলে ভুলে যায়। আমি যখন জেলে যাই তখন ওর বয়স মাত্র কয়েক মাস।’
বইটিতে বঙ্গবন্ধু একে একে বলেছেন তাঁর জন্ম, পারিবারিক ঐতিহ্য, বেড়ে ওঠা, সমকালীন পরিস্থিতি কীভাবে তাঁকে রাজনীতির দিকে নিয়ে এলÑসেসব গল্প। বলেছেন সোহরাওয়ার্দি, মওলানা ভাসানী, মওলানা আকরম খাঁ, নাজিমুদ্দীন প্রমুখ সমকালীন রাজনীতিকের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে ওঠার কাহিনি। এ ছাড়াও পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে এ ভূখÐের রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বচ্ছ আয়নার মতো প্রতিবিম্বিত হয়েছে বইটির পাতায় পাতায়। সেই সঙ্গে বিমূর্ত হয়ে উঠেছে বঙ্গবন্ধুর পাহাড়সম ব্যক্তিত্বের আড়ালে লুকিয়ে থাকা নিরহংকার সারল্যÑ‘সহকর্মীরা বলে, রাজনৈতিক জীবনের ঘটনাগুলি লিখে রাখো, ভবিষ্যতে কাজে লাগবে। আমার সহধর্মিণী একদিন জেলগেটে বসে বলল, “বসেই তো আছ, লিখো তোমার জীবনের কাহিনি।” বললাম, ‘লিখতে যে পারি না; আর এমন কী করেছি যা লেখা যায়! আমার জীবনের ঘটনাগুলি জেনে জনসাধারণের কি কোনো কাজে লাগবে? কিছুই তো করতে পারলাম না। শুধু এইটুকু বলতে পারি, নীতি ও আদর্শের জন্য সামান্য একটু ত্যাগ স্বীকার করতে চেষ্টা করেছি।”’
কারাগারের রোজনামচা
‘থালা বাটি কম্বল
জেল খানার সম্বল।’
‘কারাগারের রোজনামচা’ যে কয়েকটি খাতার সমষ্টি তার একটির প্রথম পাতায় বঙ্গবন্ধু হিজিবিজি অক্ষরে লিখেছিলেন এ কথাটি। এ বাক্য দ্বারাই বোঝা যায় তিনি কত গভীরভাবে কয়েদিদের জীবনকে পাঠ করেছেন।
পাঠক বইটি পড়তে বসে মূল লেখা শুরু হওয়ার আগের পৃষ্ঠায়ই খানিক সময়ের জন্য থমকে যাবেন কয়েকটি বাক্য পড়ে। ভেতরের এক জায়গা থেকে বাক্যগুলো কোট করে আনা হয়েছে এখানে। হয়তো নিজের অজান্তে চোখের পাতাজোড়া ভিজে উঠবে, পাঠক টেরই পাবেন না। নিতান্ত সাদামাটা বর্ণনায় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘৮ই ফেব্রæয়ারি ২ বৎসরের ছেলেটা এসে বলে, “আব্বা বালি চলো”। কি উত্তর ওকে আমি দিব। ওকে ভোলাতে চেষ্টা করলাম ও তো বোঝে না আমি কারাবন্দী। ওকে বললাম, “তোমার মার বাড়ি তুমি যাও। আমি আমার বাড়ি থাকি। আবার আমাকে দেখতে এসো।” ও কি বুঝতে চায়! কি করে নিয়ে যাবে এই ছোট্ট ছেলেটা, ওর দুর্বল হাত দিয়ে মুক্ত করে এই পাষাণ প্রাচীর থেকে! দুঃখ আমার লেগেছে। শত হলেও আমি তো মানুষ আর ওর জন্মদাতা। অন্য ছেলেমেয়েরা বুঝতে শিখেছে। কিন্তু রাসেল এখনও বুঝতে শিখে নাই। তাই মাঝে মাঝে আমাকে নিয়ে যেতে চায় বাড়িতে।’
কী নিদারুণ কষ্টের কথা অথচ বঙ্গবন্ধু কী সাদামাটাভাবেই না সেদিনের দিনলিপিতে কথাগুলো লিখলেন! কষ্ট তাঁর লেগেছে, তিনি স্বীকারই তো করলেন, কিন্তু পিতৃ¯েœহকে হৃদয়ের অলিন্দে তালাবদ্ধ করে নিজের সংগ্রাম ও সংকল্পকে তিনি প্রাধান্য দিয়েছেন। ছেলেকে এ আশ্বাসটুকুও দেননি যে, তিনি আগামীতে মুক্ত হয়ে বাড়ি ফিরবেন। ছেলের কাছে বরং জেলকে নিজের বাড়ি বলে পরিচয় দিয়ে বুঝ দিয়েছেন।
বইটি তাঁর জেলজীবনের দিনলিপি। দিনলিপির কয়েকটি খাতার গ্রন্থিত রূপ। একটি ১৯৬৬ সালে লেখা, আরেকটি ৬৭-তে। বাকিগুলোও ওই সময়কার। ধারাবাহিকভাবে এখানে গ্রন্থিত হয়েছে সব। বইয়ের প্রথম দিকে জেলজীবনের হালচাল, কারাগারের বাহারি সব পরিভাষার পরিচয়, কয়েদিদের দুঃখগাঁথা, ভেতরের দুর্নীতিÑইত্যাদি নানা কিছু সরল বয়ানে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন চমৎকারভাবে। সরস ভঙিমায় বলেছেন দু’-একটি হাসির ঘটনাও। যেমন ৩৪ নম্বর পৃষ্ঠায় কয়েদি পাগলদের কথা বলতে গিয়ে লিখেছেন, ‘একদিন দাঁড়াইয়া পাগলের গোসল দেখছি। এক পাগলের গোসল হয়ে গেছে। সে কাঁপতে কাঁপতে আমাদের কাছে এসে দাঁড়াইয়া রোদ পোহাচ্ছে। আর একজন পাগলকে কয়েকজন কয়েদি ধরে এনে গোসল করাচ্ছে। যে পাগলটা আমাদের কাছে দাঁড়াইয়া রোদ পোহাচ্ছে সে আমাকে বলে, “কি দেখেন, এগুলি সব পাগল, খুব পাগলামি করে।” আমি তো হেসেই অস্থির। নিজে যে পাগল তা সে ভুলে গেছে।’
কারাগারের এসব নানাবিধ বর্ণনার পর শুরু হয়েছে তাঁর রোজনামচা। দু’টো খাতায় তিনি সন-তারিখসহ রোজকার ভাবনাগুলো লিপিবদ্ধ করেছেন। প্রথমটা শুরু হয়েছে ২রা জুন ১৯৬৬ সাল থেকে। শেষ হয়েছে একই সালের ১৬ই সেপ্টেম্বর। দ্বিতীয়টার শুরু ৬৭ সালের ১লা জানুয়ারি। তবে ১লা জানুয়ারি থেকে ২০শে ফেব্রæয়ারি পর্যন্ত তিনি একটি মাত্র দিনলিপি লিখেছেন। এভাবে গ্যাপ দিয়ে দিয়ে একই সালের ২২শে জুন অবধি ২৪০ পৃষ্ঠার রোলটানা খাতাটি শেষ করেছেন। তারপরের খাতাটি ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা চলাকালীন বন্দী অবস্থায় লেখা। মামলার ব্যস্ততায় ৩২০ পৃষ্ঠা খাতার মাত্র ৫২ পৃষ্ঠা লিখতে পেরেছিলেন।
দু’টো বই-ই বাংলাদেশের ইতিহাসের অসামান্য এক দলিল। সেই সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্ব, কর্মপন্থা ও মানসিকতা সম্পর্কে বিস্তারিত জানার শ্রেষ্ঠ মাধ্যম। টুঙ্গিপাড়ার সামান্য এক তরুণ কীভাবে নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে বাঙালিদের অবিসংবাদিত নেতার আসন অলংকৃত করেছিলেন, তারই চিত্র ফুটে উঠেছে বই দু’টোর পাতায় পাতায়।
আগস্ট ২০১৮