১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের বহুল প্রচারিত দৈনিক পত্রিকা ইত্তেফাক-এর সম্পাদক আখতার-উল-আলম গিয়েছিলেন বাগদাদ সফরে। বাগদাদের ঐতিহাসিক গ্রন্থাগার পরিদর্শনের সময় প্রাচীন একটি পাণ্ডুলিপি তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বুখারি শরিফের একটি ব্যাখ্যাগ্রন্থ এ পাণ্ডুলিপি। লিখেছেন শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা। এই পাণ্ডুলিপির সূত্রেই তিনি জানতে পারেন শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা বাংলাদেশে বসবাস করেছেন জীবনের দীর্ঘ সময়। বাংলার প্রাচীন রাজধানী সোনারগাঁয়ে তিনি একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এবং এই মাদরাসার পাশেই হয়েছেন সমাহিত। পাণ্ডুলিপিটাও তিনি রচনা করেছেন এই মাদরাসায় থাকাকালে।
আখতার-উল-আলম বিস্মিতও হন পাণ্ডুলিপিটা দেখে। এমন একজন মনীষী ও প্রাজ্ঞ আলেম বাংলাদেশে ছিলেন, অথচ তাঁকে নিয়ে কোনো কথাবার্তা নেই এই অঞ্চলের চর্চিত ইতিহাসে! দেশে ফিরে তিনি এ বিষয়ে আলাপ করলেন ড. কাজী দীন মুহম্মদের সঙ্গে। তারপর তাঁকে নিয়ে ছুটে যান ঢাকার অদূরে, নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁয়ে, যেখানে ছিল আবু তাওয়ামার প্রতিষ্ঠিত মাদরাসা এবং যেখানে আবু তাওয়ামা সমাহিত আছেন। গিয়ে দেখেন মাদরাসা-এলাকাটা বর্তমানে অবহেলিত এক পল্লী। মাদরাসার পরিত্যক্ত অবকাঠামো এবং আবু তাওয়ামার সমাধি ঢাকা পড়ে আছে লতাগুল্মে। অযত্ন-অবহেলায় জঙ্গলে পরিণত হয়েছে পুরো এরিয়াটা। আখতার-উল-আলম ও ড. কাজী দীন মুহম্মদ লতাগুল্মের জঙ্গল সরিয়ে আবু তাওয়ামার কবর জিয়ারত করলেন। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে এবং ব্রিটিশ প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের ১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দের ফলক অনুসরণ করে তাঁরা আবু তাওয়ামার মাদরাসা ও কবর শনাক্ত করতে পেরেছিলেন।
আখতার-উল-আলম ও ড. দীন মুহম্মদের এই সফরের পর শায়খ আবু তাওয়ামার স্মৃতিবিজড়িত এই এলাকাটা প্রথমবারের মতো ধর্মীয় অঙ্গনের অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এবং অনেকে আবু তাওয়ামা ও তাঁর মাদরাসা নিয়ে ইতিহাস-অন্বেষে ব্রতী হন। (সূত্র : ইতিহাসের অন্তরালে, ফারুক মাহমুদ, পৃষ্ঠা-ক্রম : ১০৯)
জন্ম ও জন্মভূমি
শায়খ শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা রহমতুল্লাহি আলায়হি খ্রিষ্টাব্দ ত্রয়োদশ শতাব্দীর একজন বিখ্যাত মনীষী আলেম, একই সঙ্গে ধর্মপ্রচারকও। জ্ঞানের নগরী বুখারায় তাঁর জন্ম; যে শহরে জন্মেছিলেন কালজয়ী ইমাম বুখারি রহমতুল্লাহি আলায়হি। আবু তাওয়ামার জন্মসাল নির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল, তবে এতটুকু নিশ্চিত যে, তাঁর জন্ম হয়েছিল খ্রিষ্টাব্দ ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে। পড়াশোনা নিজ অঞ্চলেই করেছেন। হানাফি মাজহাবের ওপর ছিল অগাধ পাণ্ডিত্য। অতঃপর রাজনৈতিক কারণে তাঁকে নিজ শহর বুখারা ত্যাগ করতে হয়। (সূত্র : শতাব্দীর চিঠি, মুসা আল হাফিজ, পৃষ্ঠা-ক্রম : ৪৫)
দিল্লি আগমন
ইসলাম প্রচারের জন্য ১৩৬০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি হিন্দুস্তানের রাজধানী দিল্লিতে আগমন করেন। দিল্লিতে তখন মামুলক সালতানাতের শাসন প্রতিষ্ঠিত। সুলতান নাসিরুদ্দিন মাহমুদ ক্ষমতায়। শায়খ আবু তাওয়ামা এখানে এসে শহরবাসীর মধ্যে দীনের দাওয়াত এবং ইলম-শিক্ষাদানে ব্রতী হন। তাঁর দরস ও দাওয়াতের প্রভাব অল্প দিনেই এত ব্যাপৃতি লাভ করে যে, দিল্লির অন্যতম শীর্ষ আলেম হিসেবে তিনি সর্বমহলে আদৃত ও বরিত হন। তাঁর দরস ও ইসলাহি মজলিসগুলোতে তালিবুল ইলম ও আপামর জনতার ঢল নামতে থাকে প্রতিদিন। জনগণের মধ্যে তাঁর প্রভাব এতটাই বিস্তৃত হয় যে, অনেক ক্ষেত্রে সুলতানের প্রভাবকেও ছাপিয়ে যায়। ১৩৬৫ খ্রিষ্টাব্দে সুলতান নাসিরুদ্দিন মাহমুদের ইন্তেকাল হলে তাঁর উজির গিয়াসুদ্দিন বলবন নতুন সুলতান হিসেবে ক্ষমতায় আসেন। গিয়াসুদ্দিন বলবন ধর্মানুরাগী ছিলেন, কিন্তু ক্ষমতাপ্রশ্নে তিনি কাউকে ছাড় দিতেন না। তাঁর জীবনীকার জিয়াউদ্দিন বারানি তারিখ-ই ফিরোজশাহি গ্রন্থে লিখেন, গিয়াসুদ্দিন বলবন নামাজ-রোজার পাবন্দি করতেন, দুহাতে দান-সদকা করতেন, ওলামায়ে কেরামের মজলিসে সাধারণ শ্রোতা হয়ে হাজির হতেন, সুবিচারে ছিলেন প্রসিদ্ধ—এতসব গুণ থাকা সত্ত্বেও ক্ষমতাপ্রশ্নে কাউকে তিনি ছাড় দিতেন না। বিদ্রোহ দমনের জন্য কোনো শহরকে বিরান করে দিতেও কণ্ঠাবোধ করতেন না। এ ক্ষেত্রে তাঁর স্বভাবজাত খোদাভীতিটা অনুপস্থিত থাকত, বিদ্রোহ দমনে শরিয়াহ-নীতির তোয়াক্কাও তখন করতেন না।
তো, তিনি ক্ষমতায় আসবার পর যখন দেখলেন শায়খ আবু তাওয়ামার প্রভাব অনেক ক্ষেত্রে তাঁর প্রভাবকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে, তিনি সুলতান কিন্তু জনগণ তাঁর চেয়েও বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে আবু তাওয়ামাকে, তখন আবু তাওয়ামার ব্যাপারে আশংকা করলেন, যে, আবু তাওয়ামা হয়তো এই প্রভাবের জোরে একসময় তাঁকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে ফেলবেন।
সুলতান গিয়াসুদ্দিন বলবন এমনিতে আলেম-ভক্ত হবার কারণে আবু তাওয়ামাকে সম্মান করতেন। তাঁর মজলিসে বিভিন্ন সময় সাধারণ শ্রোতা হিসেবে অংশগ্রহণ করতেন। কিন্তু ক্ষমতাপ্রশ্নে কঠোর হবার কারণে এবং তাঁর প্রতি নিজের ভেতরে আশংকা তৈরি হওয়ায় তিনি দিল্লি থাকুন, সুলতান এটা চাচ্ছিলেন না।
এদিকে আবু তাওয়ামাকে শ্রদ্ধা করার কারণে দিল্লি ছাড়ার জন্য সরাসরি নির্দেশও দিতে পারছিলেন না। সুলতান তাই একদিন কৌশলে তাঁকে বললেন, ‘আমি বাংলা অঞ্চল জয় করে এসেছি সবেমাত্র। সেখানকার মানুষের অবস্থা খুবই করুণ। ধর্ম-কর্মের ব্যাপারে তারা খুবই অজ্ঞ এবং উদাসীন। দিল্লিতে তো প্রচুর আলেম-ওলামা আছেন, তাঁরা এখানকার জনগণকে রাহনুমায়ি করার জন্য যথেষ্ট। আপনি যদি বাংলা অঞ্চলে চলে যেতেন, তাহলে সেখানকার প্রচুর মানুষ ধর্মের দিশা পেত।’
শায়খ আবু তাওয়ামা তো বিচক্ষণ ব্যক্তিত্ব। সুলতান বিনয়ের সুরে বললেও তিনি বুঝতে পারছিলেন, এটাই নির্দেশনামা। বস্তুত তিনি ছিলেন একজন শিক্ষক এবং ধর্মপ্রচারক। ইসলাম প্রচার ও শিক্ষাদানকেই জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। ক্ষমতা কিংবা বাদশাহি তিনি চাইতেন না। তাছাড়া বাংলা অঞ্চলে আসলেই দাওয়াত ও ইসলামি শিক্ষা বিস্তারের প্রয়োজন ছিল। তাই সুলতানের সঙ্গে কোনো বাকবিতণ্ডায় না গিয়ে সহাস্যে তিনি মেনে নিলেন তাঁর নির্দেশনা-সূচক পরামর্শ। (সূত্র : বাংলাদেশে ইসলাম, মান্নান তালিব, পৃষ্ঠা-ক্রম : ১০৭; সংগ্রামী সাধকদের ইতিহাস তৃতীয় খণ্ড, মূল : আবুল হাসান আলী নদভী, অনুবাদ : আবু সাঈদ মুহাম্মদ উমর আলী, পৃষ্ঠা-ক্রম : ১৭১)
বাংলার পথে
দিল্লি ত্যাগ করে শায়খ শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা বের হন বাংলার উদ্দেশে। তৎকালীন মধ্য বাংলার রাজধানী সোনারগাঁও তাঁর গন্তব্য। পথিমধ্যে বিহার প্রদেশ অতিক্রমকালে মানের নামক একটি এলাকায় তিনি সেখানকার প্রসিদ্ধ ও মহান এক বুজুর্গের আতিথেয়তা গ্রহণ করেন। তিনি ইয়াহইয়া মানেরি রহমতুল্লাহি আলায়হি। তাঁর এক ছেলে ছিলেন তখন কিশোর, তাঁর নামও শরফুদ্দিন। খুব মেধাবী ও প্রত্যুতপন্নমতিত্বের অধিকারী ছিলেন। আবু তাওয়ামা সেখানে অবস্থানকালে তিনি নিজের জ্ঞান ও মেধা দিয়ে তাঁকে চমৎকৃত করেন। এবং আবু তাওয়ামার সঙ্গী হবার বায়না ধরেন পিতা-মাতার কাছে। পিতা-মাতাও অমত করলেন না। আবু তাওয়ামার পাণ্ডিত্য ও আধ্যাত্মিকতা সম্পর্কে ইতিমধ্যেই তাঁরা ওয়াকিবহাল হয়ে গিয়েছিলেন।
শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা শরফুদ্দিন বিন ইয়াহইয়া মানেরিকে নিয়ে আবার যাত্রা শুরু করলেন। সোনারগাঁও এখনও বহু দূরের পথ।
সোনারগাঁওয়ে আবু তাওয়ামা
আবু তাওয়ামা রহমতুল্লাহি আলায়হি সোনারগাঁওয়ে ঠিক কত সালে এসেছেন এ নিয়ে একাধিক মত পাওয়া যায়। নুজহাতুল খাওয়াতির গ্রন্থ অবলম্বনে ড. মুহাম্মদ ইসহাক বলেছেন তিনি ১২১০ থেকে ১২৩৬ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে কোনো একসময়ে এসেছেন। মানাকিবুল আসফিয়া গ্রন্থ অবলম্বনে ড. সগির হাসান আল মাসুমি বলেছেন ১২৭০ খ্রিষ্টাব্দের কথা। কিন্তু বাংলাদেশে ইসলাম গ্রন্থের লেখক মান্নান তালিব বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছিয়েন, উপরোক্ত দুই মতের কোনোটিই সঠিক হওয়া সম্ভব নয়। (দেখুন : বাংলাদেশে ইসলাম, মান্নান তালিব, পৃষ্ঠা-ক্রম : ১০৮) তিনি আবু তাওয়ামার সোনারগাঁও আগমনের সন হিসেবে ১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দকে উল্লেখ করেছেন।
সোনারগাঁও তখন ছিল মধ্য বাংলার রাজধানী। ব্যবসা-বাণিজ্যে উৎকর্ষিত হচ্ছিল এ অঞ্চল। আবু তাওয়ামা এখানে এসে অমুসলিমদের মধ্যে ইসলামের দাওয়াতি কাজ শুরু করে দিলেন। সেই সঙ্গে চালু করলেন শিক্ষাদান। শুরুতে শরফুদ্দিন ইয়াহইয়া মানেরিই ছিলেন কেবল তাঁর ছাত্র। অতঃপর ছাত্র বাড়তে থাকল, প্রয়োজন দেখা দিল প্রাতিষ্ঠানিকতার।
মাদরাসা প্রতিষ্ঠা
আবু তাওয়ামা তাঁর শিক্ষাদানকে প্রাতিষ্ঠানিকতায় রূপ দিলেন। গড়ে তুললেন একটি মাদরাসা। মাদরাসা বলতে আমরা এখন যা বুঝি, আবু তাওয়ামা’র মাদরাসা সেরকম ছিল না। ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি তিনি সেখানে জাগতিক শিক্ষারও সন্নিবেশ ঘটিয়েছিলেন। সেই সঙ্গে সাধারণ মানুষের আত্মশুদ্ধির জন্য গড়ে তুলেছিলেন একটি খানকাও। খানকাহ থেকে মানুষ আত্মশুদ্ধির সবক নিত, আর মাদরাসা থেকে গ্রহণ করত জ্ঞানের পাঠ। ইসলামি শিক্ষার সকল শাখায় এখানে উচ্চতর পড়াশোনা হতো। আবার লৌকিক বিজ্ঞানের ওপরও চলত পাঠদান। ফলে আজকের বিশ্ববিদ্যালয় বলতে আমরা যা বুঝি, আবু তাওয়ামার মাদরাসা সে-বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ পরিগ্রহ করেছিল। ফলে বাংলা অঞ্চল তো বটেই, বাংলার বাইরের, বিদেশ-বিভূঁই থেকেও অসংখ্য জ্ঞান-পিপাসু জ্ঞানের তিয়াস মেটানোর জন্য আসত এ দরসগায়।
বাংলা অঞ্চলে ইতিপূর্বে এত বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আর কোথাও গড়ে ওঠেনি। সেই সঙ্গে উপমহাদেশে হাদিসের চর্চা এখান থেকেই সর্বপ্রথম চালু হয়। এবং সেটা শায়খ আবু তাওয়ামার মাধ্যমেই।
১৩০০ খ্রিষ্টাব্দে আবু তাওয়ামা ইন্তেকাল করেন। মাদরাসার পাশেই তাঁকে সমাহিত করা হয়। তাঁর পর এই মাদরাসার দায়িত্ব গ্রহণ করেন তাঁর শিষ্য শরফুদ্দিন ইয়াহইয়া মানেরি। শরফুদ্দিন ইয়াহইয়া মানেরি ততদিনে এতদঞ্চলের বিখ্যাস সুফি ও ধর্মশাস্ত্রবিদ হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন।
আবু তাওয়ামার এই মদরাসাটার অবস্থান বর্তমান সোনারগাঁওয়ের মোগড়াপাড়ায়। আবু তাওয়ামা ও শরফুদ্দিন মানেরি’র ইন্তেকালের পরও বহু কাল যাবত মাদরাসাটি পরিচালিত হয়েছিল তাঁদের অনুসারীদের মাধ্যমে। তারপর কালের পরিক্রমায় তা একসময় বন্ধ হয়ে যায়। মোগড়াপাড়ার সেই এলাকায় এখন কেবলই আছে মাদরাসাটির ধ্বংসাবশেষ। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের উদাসীনতার ফলে মাদরাসার যেটুকু স্মৃতিচিহ্ন এখনও বাকি আছে, তা ক্রমশ বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
নভেম্বর, ২০২০