১২৮৪ খ্রিষ্টাব্দ।
দিল্লিতে তুর্কি বংশোদ্ভূত সুলতান গিয়াসউদ্দীন বলবনের রাজ্যশাসনের শেষ সময় চলছে। ১২৬৬ সালে ৬০ বছর বয়সে তিনি দিল্লি সালতানাতের সুলতান নির্বাচিত হন। এখন তাঁর বয়স ৭৮। সুলতান হিসেবে প্রায় আঠারো বছর রাজ্যশাসন, সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি এবং বিদ্রোহ দমনে ছিলেন দুর্দণ্ড প্রতাপশালী। সিংহাসনের যোগ্যতা প্রশ্নে তাঁর চেয়ে যোগ্য আর কেউ ছিল না।
এই বয়সেও কিছুদিন আগে দিল্লি সালতানাতের সবচে বিদ্রোহপ্রবণ অঞ্চল বাংলার দীর্ঘ বিদ্রোহ দমন করে এসেছেন। দিল্লি কর্তৃক নিযুক্ত সেখানকার তুর্কি শাসক মুগিসউদ্দীন তুগরল তুগান খান বিগত ছয় বছর ধরে নিজেকে স্বাধীন সুলতান হিসেবে দাবি করে আসছিল। উত্তর ভারতে মোঙ্গলদের আক্রমণ প্রতিহত করতে গিয়ে সুলতান এতদিন বাংলার দিকে মনোযোগ দেয়ার সময় পাননি। ১২৭৭ সালের পর ধারাবাহিক কয়েকজন সেনাপতিকে পাঠান তুগরল খানকে শায়েস্তা করার জন্য। কিন্তু একে একে তিনজন সেনাপতি তুগরল খানের সামরিক কৌশলের কাছে পরাজিত হয়। অবশেষে তাকে শায়েস্তা করতে সুলতান গিয়াসুদ্দীন বলবন শাহজাদা নাসিরুদ্দীন বুগরা খানকে সঙ্গে নিয়ে ১২৮০ সালে স্বয়ং বাংলায় আগমন করেন।
প্রায় দুই লাখ যোদ্ধায় সজ্জিত দিল্লি বাহিনী নিয়ে তিনি বাংলায় আগমন করলেও তুগরল খানকে গ্রেফতার মোটেও সহজ ছিল না। বাংলার রাজধানী লক্ষ্মণাবতী ছেড়ে তুগরল খান দীর্ঘ তিন বছর নদীপথে যুদ্ধ অব্যাহত রাখেন। অবশেষে ১২৮৩ সালে উড়িষ্যা সীমান্তের কাছে তুর্কি সেনাপতি মালিক বেকতুরসের সঙ্গে এক সম্মুখযুদ্ধে তিনি গ্রেফতার হন। গ্রেফতারের পর তাকে বাংলার রাজধানী লক্ষ্মণাবতীতে নিয়ে আসা হয়। সুলতান গিয়াসুদ্দীন বলবন তখন লক্ষণাবতীতে অবস্থান করছিলেন। তুগরুল খানকে লক্ষ্মণাবতীতে নিয়ে আসা হলে সুলতান তাঁকে ও তাঁর পরিবারের নারী-পুরুষ সবাইকে খোলা মাঠে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যার নির্দেশ দেন।
দিল্লি সাম্রাজ্যের মধ্যে বাংলাই সম্ভবত একমাত্র অঞ্চল, যেখানে দিল্লির শাসনের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছে। আপাত শান্ত নিরীহ এই বাঙালি জাতি কিছুতেই যেন অন্যের আধিপত্য মেনে নিতে ছিল নারাজ। এ কারণে দিল্লির আধিপত্যবাদী সুলতানদের বার বার হোঁচট খেতে হয়েছে এখানে এসে।
তা ছাড়া নদীমাতৃক অঞ্চল হওয়ায় এখানকার বিদ্রোহীরা সহজেই ছোট-বড় নদীপথে পালিয়ে যেতে পারে। অন্যদিকে দিল্লির নেতৃত্বাধীন তুর্কি বা আফগান যোদ্ধারা জালের মতো ছড়িয়ে থাকা এসব নদীতে মোটেও সাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। বর্ষা মৌসুম হলে তো কথাই নেই, বাঙালি সৈনিকরা তুর্কি-আফগানদের রীতিমতো নাকানি-চুবানি খাইয়ে ছাড়ে।
১২৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসের এক সকালবেলা। দিল্লি বাদশাহি মসজিদে ফজরের নামাজ পড়ে প্রাসাদে ফিরছিলেন সুলতান গিয়াসউদ্দীন বলবন। কিছুদিন আগে বাংলার বিদ্রোহ দমন করে রাজধানী দিল্লিতে ফিরে এসেছেন তিনি। মন মেজাজ বেশ ফুরফুরে। সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী হাশিম বেগ। সামনে পেছনে ষোলজন রক্ষী তাঁকে ঘিরে এগিয়ে যাচ্ছে।
এমন সময় নিকটবর্তী কোথাও থেকে সমবেত মানুষের তকবিরের আওয়াজ শুনতে পেলেন তিনি। দাঁড়িয়ে আওয়াজের উৎস শোনার চেষ্টা করলেন। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে সহকারী হাশিম বেগের দিকে তাকাতেই সে এগিয়ে এসে বলল, ‘আলামপনা, এটা ইয়েমেনি শায়খের দরসের আওয়াজ। প্রতিদিন সকালে শহরের ধর্মপ্রাণ মুসলিম এবং তাঁর শিষ্যরা তাঁর কাছে হাদিস শোনে। পাশের লাল মসজিদে শায়খের খানকাহ।’
সুলতান গিয়াসুদ্দীন ভ্রু কুঁচকে বললেন, ‘কোন শায়খ? ওই যে ইয়েমেন থেকে এসেছিলেন শরফুদ্দীন আবু তাওয়ামা, উনি?’
‘জি, আলামপনা।’
‘আচ্ছা, প্রতিদিন সকালে এভাবে হাদিসের দরস হয় এখানে?’
‘জি, আলামপনা।’
‘কেমন লোক সমাগম হয় প্রতিদিন?’
‘আমি মাঝেমধ্যে বসি ওই হাদিসের দরসে। আমার ধারণা, ১০ থেকে ১৫ হাজার মানুষ প্রতিদিন উপস্থিত থাকে তাঁর দরসে।’
হাশিমের কথা শুনে চোখ বড় বড় হয়ে গেল সুলতানের। এত মানুষ আসে হাদিস শুনতে! একটু চিন্তা করে বললেন, ‘তুমি এখন গিয়ে শায়খকে দরবারে ডেকে পাঠাও। বলবে, সুলতান আপনাকে জরুরি তলব করেছে…।’ কী মনে করে থেমে গিয়ে আবার বললেন, ‘না, তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে। ক্ষেপে যেতে পারে শায়খের ভক্ত-শিষ্যরা। আমিই বরং যাচ্ছি তাঁর খানকায়।’
কোনো ধরনের রাজকীয় বিহার ছাড়া সুলতান গিয়াসুদ্দীন লাল মসজিদে গিয়ে হাজির হলেন। গিয়ে যা দেখলেন তা দেখার জন্য তিনি প্রস্তুত ছিলেন না। কাঠের একটা অনাড়ম্বর মিম্বারে বসে হাদিস পাঠ করছেন শায়খ, আর তাঁর সামনে মসজিদের চাতালে মন্ত্রমুগ্ধের বসে আছে হাজার দশেক মুসলিম। তারা সবাই যে শায়খের শিষ্য এমন নয়, দিল্লির অভিজাত থেকে শুরু করে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষও বসেছে চাতালে। কারো মধ্যে কোনো ব্যস্ততা বা বিতৃষ্ণা নেই, সকলেই নিবিষ্ট মনে শায়খের নসিহত শুনছে।
এত মানুষের এমন সম্মোহন দেখে মনে মনে ভীতি অনুভব করলেন সুলতান। কম্পিত হৃদয়ে ভীড়ের একপাশে বসে পড়লেন। যতক্ষণ দরস চলল ততক্ষণ কিছু বললেন না কাউকে।
দরস শেষ হলে সুলতান এগিয়ে গেলেন শায়খের দিকে। সুলতান ও তাঁর দেহরক্ষীদের আসতে দেখে ভক্ত-শিষ্যরা জায়গা করে দিল। শায়খ মিম্বার থেকে নেমে এগিয়ে এলেন সুলতানের দিকে, বুকে জড়িয়ে ধরলেন তাঁকে।
কিছুক্ষণ পর। শায়খ শরফুদ্দীন আবু তাওয়ামা রহ. এবং সুলতান বসে আছেন মসজিদ লাগোয়া খানকায়। বয়সে শায়খ সুলতানের চেয়ে ঢের ছোট। সুলতানের চুল-দাড়ি এরই মধ্যে পেকে সাদা হয়ে গেছে, শায়খের কেবল পাক ধরেছে। ফলে দুজন দুজনকে যথাযোগ্য সম্মান দিতে কসুর করেননি। সামনে একটা রেকাবিতে আঙুর, নাশপাতি, ডালিম, খেজুরসহ নানা ফল পরিবেশন করা হয়েছে। দুজনে কথার ফাঁকে ফাঁকে মুখে দিচ্ছিলেন দু-একটা।
‘আমি বেশ কিছুদিন রাজধানীতে অনুপস্থিত ছিলাম। আপনার এখানে এত বড় মজমা শুরু হয়েছেÑসে ব্যাপারে আমার জানা ছিল না।’ ধীরে ধীরে কথা আগাচ্ছেন সুলতান।
‘সবই আল্লাহর ইচ্ছা, আলামপনা। আল্লাহ সবসময় মানুষকে হেদায়েত দিতে চান।’ শায়খ ধীরে সুস্থে জবাব দিলেন।
‘মহামান্য শায়খ, বাংলায় দীর্ঘ তিন-চার বছর থাকার ফলে আমার মনে হয়েছে, সেখানকার মানুষগুলো এখনো ইসলাম থেকে অনেক দূরে। সত্তর বছর আগে সেখানে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা হলেও মানুষের মধ্যে ইসলামের শিক্ষা সেভাবে প্রসার লাভ করেনি। প্রতিমা পূজা, জাগযজ্ঞ, কুসংস্কারে আচ্ছন্ন হয়ে আছে পুরো জনপদের মানুষ।’ গলায় বেশ আবেগ ঢেলে বললেন সুলতান।
‘জি মহামান্য সুলতান, আমিও শুনেছি মুলকে বাংলার ব্যাপারে। শুনেছি সেখানে নাকি ধর্মের নামে নরবলি দেয়া হয়!’ সুলতানের কথায় প্রভাবিত হলেন শায়খ।
সুযোগ পেয়ে সেটা কাজে লাগালেন সুলতান, ‘শুধু নরবলি নয়, সেখানকার হিন্দুদের মধ্যে কেউ মারা গেলে স্বামীর লাশের সঙ্গে তার স্ত্রীকেও জীবিত আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়।’
‘কী ভয়াবহ অবস্থা! মানুষের হৃদয়ে ইসলাম না থাকার কারণে ধর্মের নামে এমন কুসংস্কার তৈরি হয়েছে।’ শিউরে উঠলেন শায়খ।
‘আমি অনেকদিন ধরে চিন্তা করছিলাম, বাংলায় যদি সুযোগ্য কোনো মুবাল্লিগে ইসলাম থাকতো তাহলে হয়তো তাঁর স্পর্শে মানুষ হেদায়েত পেতো। সুজলা উর্বর এই ভূমি আল্লাহর নেয়ামতে ভরপুর, কিন্তু ইসলামের আলো না থাকার কারণে সেখানে মানুষ মানুষের খোদা সেজে বসে আছে। ব্রাহ্মণ আর উঁচু জাতের হিন্দুরা ধর্মের দোহাই দিয়ে নীচু জাতের মানুষদের অকথ্য নির্যাতন করে। নীচু জাতের মানুষের নিজেদের অধিকার বলতে কিছু নেই। সেখানে মুসলিম শাসন আছে ঠিকই, কিন্তু জনগণের মধ্যে ইসলামের প্রসার নেই, মানুষের মাঝে ইসলামের কথা বলার আলেম নেই। সেখানে আজানের বদলে সন্ধ্যাবেলা শোনা যায় শঙ্খ আর উলুধ্বনি।’ বলতে বলতে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লেন সুলতান।
তাঁর আবেগ ছুঁয়ে গেল শায়খ শরফুদ্দীনকেও। তিনি সুলতানের হাত ধরে বললেন, ‘মহামান্য সুলতান, আমার বাড়ি ইয়েমেন। সেখান থেকে আমি এই হিন্দুস্তানে এসেছি শুধুমাত্র দীন প্রচারের জন্য। আমি আমার পৈতৃক সহায় সম্পদ সব ছেড়ে পরিবার নিয়ে পথে নেমেছি শুধু আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠা করতে। আমি আপনাকে ওয়াদা দিচ্ছি, অধর্মে আচ্ছন্ন বাংলায় যাবো আমি। সেখানে দাওয়াতের কাজের মাধ্যমে ইসলামের আওয়াজ উচ্চকিত করব ইনশাআল্লাহ।’
১২৮৪ সালের কোনো এক মাসে ইয়েমেনের সুফি সাধক শায়খ শরফুদ্দীন আবু তাওয়ামা দিল্লি থেকে বাংলার পথে যাত্রা করেন। সঙ্গে পরিবারের লোকজন ছাড়াও কয়েক হাজার ভক্ত-শিষ্য তাঁর অনুগামী হয়। তবে সরাসরি বাংলায় আসার আগে তিনি বিহারের রাজধানী পাটনার কাছাকাছি মানেরে যান। সেখানে শায়খ আবু ইয়াহইয়া নামে এক বড় আলেমের সান্নিধ্য লাভ করেন।
দুই
শায়খ আবু ইয়াহইয়ার তরুণ ছেলে ইয়াহইয়া তাঁর সামনে বসা শায়খ শরফুদ্দীনের দিকে চোখ তুলে তাকাতে সাহস পাচ্ছে না। মনে হচ্ছে, তাঁর চোখের দিকে তাকালেই তিনি ইয়াহইয়ার অন্তর্গত সকল পাপ ও গোস্তাাখি পড়ে ফেলতে পারবেন। তাঁর অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যত বায়োস্কোপের মতো ঘুরতে থাকবে শায়খের অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে।
‘বেটা, তোমার আব্বাজান আসতে কতক্ষণ লাগতে পারে?’ দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে জিজ্ঞেস করলেন শায়খ।
‘জি…এখনই চলে আসবেন। মানের বাজারে গেছেন খাসি কিনতে, বেশি দূরে না…! অমি কি তাঁকে ডাকতে যাবো?’ একবার চোখ তুলে তাকিয়েই আবার দৃষ্টি নিচু করে ফেলল ইয়াহইয়া। শায়খ এখনও একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন তাঁর দিকে।
‘না না, তার দরকার নেই। তুমি এখানেই বসো। তোমার আব্বাজান হয়তো শিগগির চলে আসবেন। ততক্ষন আমি তোমার সঙ্গে গল্প করি।’ হাসিমুখে বললেন শায়খ। শায়খের হাসিমাখা মুখ দেখে ইয়াহইয়ার ভেতরে কম্পন আরও যেন বেড়ে গেলো।
‘কী পড়ো তুমি?’
‘জি…পড়ছি, মানে…আব্বাজানের কাছে…কিতাবাদির তালিম…?’
‘আরে বেটা, তুমি এভাবে ভয় পাচ্ছো কেন আমাকে দেখে? তোমার মুখও তো লাল হয়ে গেছে। এদিকে আসো, এদিকে আসো…।’
তরুণ ইয়াহইয়া কম্পিত হৃদয় নিয়ে শায়খের পায়ের কাছে এসে বসল। শায়খ তাঁর মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘দোয়া করি, একদিন তোমার নাম এই ‘মানের’ জনপদ থেকে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ুক।’
তিন
শায়খ শরফুদ্দীন আবু তাওয়ামা রহ. বেশ কিছুদিন মানেরে অবস্থান করেন। এ সময় পাটনার শায়খ আবু ইয়াহইয়ার ছেলে ইয়াহইয়া মানেরীর সঙ্গে নিজ কন্যার বিয়ে দেন। এরপর সম্ভবত ১২৮৫ খ্রিষ্টাব্দের শুরুর দিকে তিনি বাংলার সমৃদ্ধ জনপদ সোনারগাঁওয়ে আগমন করেন। নিজ জামাতা ও অন্যতম শিষ্য ইয়াহইয়া মানেরীকেও সঙ্গে নিয়ে আসেন।
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও সে সময় ছিল দক্ষিণবঙ্গের সবচে বড় নৌবন্দর। নৌবন্দর হওয়ার সুবাদে বন্দরের আশপাশের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে গড়ে উঠেছিল সোনারগাঁও শহর এবং কালক্রমে এটি একটি বাণিজ্যকেন্দ্রে রূপ নেয়। বঙ্গোপসাগর হয়ে যেসব ব্যবসায়ী জাহাজ উত্তরবঙ্গ এবং বাংলার রাজধানী লক্ষ্মণাবতীর দিকে যেতো, সেসব জাহাজ আবশ্যিকভাবে যাত্রাবিরতি করতো এখানে। এভাবে সোনারগাঁওয়ের সঙ্গে নৌযোগাযোগ ছিল সুদূর আরব ও প্রাচ্যের।
শায়খ শরফুদ্দীনের দিল্লি থেকে সোনারগাঁওয়ে আসার যাবতীয় ব্যয়ভার দিল্লির সুলতান গিয়াসুদ্দীন বলবন বহন করেন। শুধু তাই নয়, সোনারগাঁওয়ে যাতে তিনি একটি ইসলামি বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে পারেন তারও বন্দোবস্ত করে দেন। সে সময় বাংলার শাসক ছিলেন সুলতানের ছেলে নাসিরুদ্দীন বুগরা খান। সুলতানের নির্দেশে বুগরা খান শায়খকে বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় সর্বাত্মক সহায়তা প্রদান করেন।
অবশ্য এখানে রাজনৈতিক কারণও ছিল। দিল্লির মসনদ ছিল সে সময় স্পর্শকাতর অধ্যায়ে। যে কোনো সময় কোনো বিদ্রোহী গোষ্ঠী বা ব্যক্তি সিংহাসন দখল করে নিতে পারে। তাই খোদ রাজধানীতে যদি শায়খ আবু তাওয়ামার মজলিসে প্রতিদিন ১৫ হাজার লোকের সমাগম হয়, সেখান থেকে যে কোনো ধরনের রাজনৈতিক আওয়াজ উঠলে সে বিদ্রোহ দমন করা কঠিন হয়ে যাবে। আর সেটা যদি ধর্মীয় সুরমা লাগিয়ে ব্যবহার করা হয় তাহলে সাধারণ মানুষও সিংহাসনের বিরুদ্ধে চলে যেতে পারে। এ কারণে সুলতান গিয়াসুদ্দীন বলবন শায়খকে সুকৌশলে রাজধানী দিল্লি থেকে বিদায় করতে চাচ্ছিলেন। শায়খ সুলতানের রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি বুঝতে পেরে দিল্লিতে অবস্থানকে নিরাপদ মনে করেননি। তাই স্বেচ্ছায় বাংলা চলে আসার আগ্রহ প্রকাশ করেন।
দিল্লিতে থাকার সময় শায়খ শরফুদ্দীনের হাদিসপাঠের সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিল দেশ-বিদেশে। তিনি যখন সোনারগাঁওয়ে নতুন করে ইসলামি বিদ্যায়তন প্রতিষ্ঠা করেন, দূর-দূরান্ত থেকে জ্ঞানপিয়াসী শিক্ষার্থীরা ভীড় জমাতে থাকে সেখানে। মেঘনা ও শীতলক্ষ্যা নদী তীরবর্তী হওয়ার দরুণ সোনারগাঁওয়ের যাতায়াতব্যবস্থা ছিল তুলনামূলক ভালো।
দেখতে দেখতে কয়েক বছরের মধ্যে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংখ্যা ১০ হাজারে উন্নীত হয়। এর আগে বিহারের নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার আর কোনো শিক্ষায়তনে এত ছাত্রের সন্নিবেশ হয়নি। এখানে বিধিবদ্ধ কুরআন এবং হাদিসের দরসের পাশাপাশি ভেষজ চিকিৎসাশাস্ত্র, অংক, ভূগোল, ইতিহাস এবং রসায়ন শাস্ত্রসহ অন্যান্য জরুরি বিষয়ে শিক্ষা প্রদান করা হতো।
ধারণা করা হয়, ১২৮৫ থেকে ১২৯০ সালের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় সোনারগাঁও ইসলামি বিশ^বিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে জ্ঞানের এক আধারে পরিণত হয় এ বিশ^বিদ্যালয়। এবং সবচে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, শায়খ শরফুদ্দীন আবু তাওয়ামা রহ. সর্বপ্রথম উপমহাদেশে উচ্চতর হাদিসের দরস শুরু করেন। তিনি সোনারগাঁও বিশ^বিদ্যালয়ে সহিহ বুখারি, সহিহ মুসলিম এবং মুসনাদে আবু ইয়ালা গ্রন্থের দরস প্রদান শুরু করেন। এ কারণেই তাঁর নামের শেষে ‘বুখারি’ যোগ করা হয়। এর আগে আর কেউ উপমহাদেশে হাদিসের এ সর্বোচ্চ বিশুদ্ধ গ্রন্থের পাঠ শুরু করেননি বলে ইতিহাস থেকে অনুমিত হয়।
চার
এখন জ্ঞাতব্য বিষয় হলো, শায়খ শরফুদ্দীন আবু তাওয়ামা বুখারি বাংলার সোনারগাঁওয়ে বুখারি শরিফের যে দরস প্রদান করতেন, সে দরসের কিতাবাদি কীভাবে সংগ্রহ করা হতো? আমার ধারণা, যেহেতু সোনারগাঁওয়ের সঙ্গে আরব বণিকদের যোগাযোগ ছিল এবং সোনারগাঁও বন্দরে প্রায়ই আরবীয় বাণিজ্য জাহাজ নোঙর করতো, সম্ভবত তাদের মাধ্যমে আরব থেকে প্রয়োজনীয় কিতাবাদি সংগ্রহ করা হতো। এছাড়া স্থলপথে এসব কিতাবাদি সংগ্রহ করা ছিল প্রায় অসম্ভব। এ থেকে বুঝা যায়, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম আরবেও কম-বেশি প্রসিদ্ধ ছিল।
গ্রন্থ রচনার ক্ষেত্রেও শায়খ শরফুদ্দীন সমান আগ্রহী ছিলেন। তাঁর তত্ত্বাবধানে শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে ‘মসনবিয়ে নামে হক’ নামে ফারসি ভাষায় একটি গ্রন্থের উল্লেখ পাওয়া যায়। এ গ্রন্থে সাধারণ ধর্মীয় বিষয়াদি কবিতাকারে বর্ণনা করা হয়েছে। এ গ্রন্থে ১৮০টি কবিতা লিপিবদ্ধ আছে। গ্রন্থটি ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে মুম্বাই থেকে এবং ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে কানপুর থেকে প্রকাশিত হয়। আমার কাছে এ গ্রন্থের একটি পিডিএফ সংস্করণ রয়েছে। এটি পাকিস্তানের লাহোর থেকে মাকতাবায়ে কাদেরিয়া কর্তৃক প্রকাশিত। মাত্র ১৭ পৃষ্ঠার ছোট গ্রন্থটিতে তাওহিদ, রিসালাত, ফরজ, ওয়াজিবসহ বিভিন্ন জরুরি বিষয় কবিতাকারে বর্ণিত।
শায়খ প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থীই ছিলেন বাংলার। এ কারণে তিনি বাংলাভাষায় গ্রন্থ রচনায় তাদের উৎসাহ প্রদান করেন। তাঁর তত্ত্বাবধানে ‘মনজিলে মাকামাত’ নামে বাংলাভাষায় একটি সুফিতাত্ত্বিক দর্শনগ্রন্থ রচিত হয় বলে জানা যায়। যদিও এ গ্রন্থের কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। তবে বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়, শরফুদ্দীন আবু তাওয়ামা লিখিত একাধিক পাণ্ডুলিপি ব্রিটিশ জাদুঘরের আর্কাইভ ভবনে রক্ষিত আছে।
শায়খ শরফুদ্দীন আবু তাওয়ামার অন্যতম শিষ্য শায়খ ইয়াহইয়া মানেরীও গ্রন্থ রচনায় ছিলেন সিদ্ধহস্ত। জানা যায়, সুফি সাহিত্য এবং দর্শন শাস্ত্রে তিনি শতাধিক গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। শায়খ আবু তাওয়ামার মৃত্যুর কিছুদিন পর তিনি বিহারে নিজ এলাকায় চলে যান এবং পরবর্তীকালে বিহারের একজন শ্রেষ্ঠ ইসলামি চিন্তাবিদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তাঁর রচিত ‘মকতুবাতে সাদি’ সুফি সাহিত্যের একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন। এছাড়া ‘মালফুজুস সফর’ নামেও মানেরীর একটি বিখ্যাত গ্রন্থের পরিচয় পাওয়া যায়।
এখানে দুটো বিষয় লক্ষণীয়। এক. শায়খ শরফুদ্দীন ইয়েমেনের অধিবাসী হওয়া সত্ত্বেও দীন প্রচারের লক্ষ্যে ছুটে এসেছিলেন এই বাংলায়। শুধু তাই নয়, তিনি সময়ের সবচে বড় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে এখানে হাদিসের দরস প্রদান করে বাংলাকে ধন্য করেছিলেন। একই সঙ্গে এই জনপদের মানুষের জন্য তিনি বাংলাভাষায় গ্রন্থ রচনা করে বাংলাভাষা এবং বাংলা সাহিত্যকে যে অনুপম সম্মান দিয়েছেন, সেটা অনন্য। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, বাংলার মানুষের কাছে দীন পৌঁছাতে হলে তাদের ভাষায় কথা বলতে হবে, তাদের ভাষায় লিখতে হবে। এটাই ইসলামের সাংস্কৃতিক অগ্রযাত্রা। ইসলাম যখন যে জনপদে আগমন করেছে, সেই জনপদের ভাষা ও সংস্কৃতি ইসলামীকরণ করেছে।
বিগত ১৩-১৪ শ বছরে এই দেশে আরব, পারস্য, হিন্দুস্তান থেকে শত সহস্র মুসলিম মনীষীর আগমন ঘটেছে। এই দেশে জন্ম নিয়ে প্রথিতযশা আলেম হয়েছেনÑইতিহাসে এমন ব্যক্তির উদাহরণও কম নয়। তারা আরবিতে কম গ্রন্থই রচনা করেছেন। বরং বিভিন্ন মুসলিম দেশ থেকে যারাই দাওয়াতের ব্রত নিয়ে এ দেশে এসেছেন, তারা কাল পরিক্রমায় এ দেশের মানুষের ভাষায় কথা বলেছেন। তাদের নিয়ে রচিত হয়েছে বড়জোর ফার্সি বয়েত, কিন্তু অঢেল লেখা হয়েছে বাংলা পুঁথি।
বঙ্গদেশে আগত বিখ্যাত প্রত্যেকজন মুসলিম সাধককে নিয়ে বাংলায় রচিত হয়েছে পুঁথিসাহিত্য। তাতে বাংলাদেশ থেকে ইসলাম বিদায় নিয়ে ইয়েমেন চলে যায়নি। বরং তারাই এসে বাংলার মাটি-বাতাস, জল-প্রকৃতির সঙ্গে নিজেদের একীভূত করে নিয়েছেন। এর ফলে বাংলাদেশের ইসলাম এদেশের প্রতিটি জনপদের নদী, ক্ষেত, বিল, হাওড় আর শহরের সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে গিয়েছে। যে দেশের ভাষা ও কৃষ্টি-সংস্কৃতির সঙ্গে ইসলাম মিশে যেতে পারে সেই দেশে ইসলাম চিরন্তন।
দুই. আমাদের দুর্ভাগ্যই বলতে হবে, শত সহ¯্র বছরে এই বাংলাদেশে হাজার হাজার আলেমে দীন, শায়খ, দরবেশ, মুবাল্লিগের আগমন ঘটেছে। বাংলাদেশেও জন্ম নিয়েছেন বিরাট মাপের অনেক আলেম। কিন্তু তাদের অবদান ও জীবন সম্পর্কে আমরা সম্পূর্ণ বেখবর। না জানি তাদের ত্যাগ ও দীক্ষার কথা, আর না জানি তাদের অবদানের কথা।
এই বাংলাদেশে বিগত এক হাজার বছরের ইতিহাসে ইসলাম নিয়ে আরবি, ফারসি, বাংলাভাষায় হাজার হাজার গ্রন্থ রচনা হয়েছে। কিন্তু সেগুলোর কোনো অস্তিত্ব আমাদের কাছে নেই। চিন্তা করুন, আজ থেকে সাত শ বছর আগে শায়খ শরফুদ্দীন আবু তাওয়ামা রহ. ফারসি ও বাংলাভাষায় ইসলামি অনেক গ্রন্থ রচনা করেছেন বলে ইতিহাস থেকেই আমরা জানলাম। যদি সাত শ বছর আগে তিনি গ্রন্থ রচনা করে থাকেন এবং সেগুলোর অস্তিত্ব আজ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়, তাহলে তাঁর পরবর্তী আলেমগণ নিশ্চয় আরও অনেক গ্রন্থ রচনা করে থাকবেন। এটাই স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু সেই গ্রন্থগুলো কই? আমরা জানি না। হয়তো কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। অথবা ইংরেজরা চুরি করে ব্রিটিশ লাইব্রেরি আর্কাইভে তালাবদ্ধ করে রেখে দিয়েছে। যদি কোনোদিন ব্রিটেনে যাওয়ার সুযোগ ঘটে, বাংলাদেশ থেকে চুরি করা সেসব দুর্লভ গ্রন্থ ব্রিটিশ লাইব্রেরির আর্কাইভে দেখতে চাই।
যাই হোক, শায়খ শরফুদ্দীন নামের এই বীর হাদিসবেত্তা খুব সম্ভবত ১৩০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে সোনারগাঁওয়ে ইন্তেকাল করেন। সেখানেই তাঁকে দাফন করা হয়। তাঁর মৃত্যুর বহুদিন পরও শিক্ষা জারি ছিল এই ইসলামি বিশ^বিদ্যালয়ে। হাদিস এবং অন্যান্য শাস্ত্রের রীতিমাফিক দীক্ষা চলত এখানে।
আজও সোনারগাঁওয়ের মোগরাপাড়ার দরগাবাড়িতে সেই ইসলামি বিশ^বিদ্যালয়ের ধ্বংসাবশেষের দেখা পাওয়া যায়। কালের ক্ষয়ে ধ্বসে পড়েছে ইট-সুড়কি। আগাছা আর অশ^ত্থে ছেয়ে গেছে দালানের দেয়াল। যে বিদ্যায়তনে একদিন প্রথম উচ্চারিত হয়েছিল ‘ক্বলা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম…’ সেই জনপদ আজ ইসলামি শিক্ষাশূন্য বিরান। হাজার হাজার হাদিসের শিক্ষার্থী যেখানে হাঁটু মুড়ে বসে নিমগ্ন হতো হাদিসপাঠে, সেখানে এখন কেবলই সাপ-ইঁদুর আর পোকামাকড়ের ঘরবসতি। ন্যুব্জ প্রতিটি ইট থেকে যেন বেরিয়ে আসছে মহাকালের হাহাকার।
পাঁচ
নিচে আমি কিছু নাম উল্লেখ করছি, দেখে নিন কেউ তাদের চেনেন কি-না:
১. শেখ আখি সিরাজউদ্দীন উসমান বাদায়ুনী (১৩৫৭ খ্রিষ্টাব্দ, গৌড়)
২. নুরুদ্দিন কুতুবুল আলম (১৪১৫ খ্রিষ্টাব্দ, পা-ুয়া)
৩. সফিউদ্দিন শহীদ (১২৯৫ খ্রিষ্টাব্দ, পা-ুয়া)
৪. শাহ ইসলাম ঘায়ী (১৪৭৪ খ্রিষ্টাব্দ, উত্তরবঙ্গ)
৫. শরফুদ্দীন আবু তাওয়ামা (১৩০০ খ্রিষ্টাব্দ, সোনারগাঁও)
৬. শাহ আবদুল্লাহ কিরমানি (চতুর্দশ শতাব্দী, বীরভূম)
৭. আশরাফ জাহাঙ্গীর সিমনানি (১৪২০ খ্রিষ্টাব্দ, জৌনপুর)
৮. শেখ জালালুদ্দীন তাবরিজি (১৩৮৪ খ্রিষ্টাব্দ, পাণ্ডুয়া)
৯. সাইয়িদ ইবরাহিম দানিশমন্দ (১৫৬০ খ্রিষ্টাব্দ, সোনারগাঁও)
১০. মাওলানা আতা (১০ম শতাব্দী আনুমানিক, দিনাজপুর)
উপরে যাদের নাম উল্লেখ করা হলো, সকলেই এই বঙ্গদেশে বসবাসকারী আলেম ও দরবেশ। পৃথিবীর নানা দেশ থেকে তারা বাংলাদেশে এসেছিলেন ইসলাম প্রচারের জন্য। তাদের ধর্মরক্ষার প্রচেষ্টা এবং ইসলাম প্রচারের নানামুখী কার্যক্রম এই বঙ্গভূমিকে ইসলামের দুর্গে পরিণত করেছে। কিন্তু আমরা তাদের জন্য কী করেছি? কিছু করা তো দূরের বিষয়, আমরা তাদের নামই ভুলে গেছি। তাদের অবদানের সামান্য তথ্যও আমাদের কাছে রক্ষিত নেই। তাদের জীবন তালাশে ইতিহাস আর গবেষণার প্রয়োজন মনে করিনি কখনো। অথচ আজকে বাংলাদেশে আমরা নামাজ পড়ছি, রোজা রাখছি, ওয়াজ মাহফিল করছি, বড় বড় মসজিদ-মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করছি, পাঁচ বেলা মিনার থেকে ধ্বনিত হচ্ছে আজান; এ কাদের অবদান? যারা রক্ত-ঘামে আমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছে ইসলামের নজরানা, আমরা তাদের ভুলে গেছি বেমালুম। এমনই এক অকৃতজ্ঞ জাতি আমরা।
আমরা আরবের ইতিহাস জানি, উমাইয়া, আব্বাসি, উসমানি খেলাফতের বিস্তর ইতিহাস আমাদের নখদর্পণে। কিন্তু আমরা জানি না গৌড়ের ইতিহাস, জানি না লক্ষ্মণাবতী, পা-ুয়া, ঘোড়াঘাট, সোনারগাঁও, মুর্শিদাবাদ কিংবা নদীয়ার ইতিহাস। পূর্বপুরুষদে অবদান ও ত্যাগের ইতিহাস অনুপস্থিত আমাদের পাঠ্যতালিকা থেকে।
এভাবে হয় না। এভাবে কখনো ইতিহাস রচনা হয় না। কৃতজ্ঞতা জানানো হয় না। মুসলিম হিসেবে মাথা উঁচু করে এভাবে কখনো দাঁড়ানো যায় না। যে তার পায়ের নিচের মাটি সম্পর্কে বেখবর, সে দৃঢ়পদে দাঁড়াবে কীভাবে?
এখনও সময় শেষ হয়ে যায়নি। পাঠাগার আর কুতুবখানার অন্ধকারে পড়ে থাকা ধুলোপড়া গ্রন্থগুলো আমাদের ডাকছে। আমাদেরই খুঁজতে হবে ইতিহাসের প্রতিটি পৃষ্ঠা। ইতিহাসের প্রতিটি গলি-ঘুঁপচি তালাশ করতে হবে পূর্বপুরুষদের পদছাপ অনুসরণ করতে। সহ¯্র বছরের বাংলার মানচিত্রে যদি আমরা একবার নজর বুলাই, আমাদের পূর্বসূরীরা আমাদের সামনে এসে দাঁড়াবে। যদি একবার সাহস করে অনুসন্ধান শুরু করতে পারি, আপনি আমি সবাই মিলে ঠিকই একদিন তৈরি করতে পারব আমাদের গৌরবজ্জ্বল ইতিহাসের অমূল্য দাস্তান।
ছয় : একটি উপন্যাসের ‘পূর্বাভাস’
ষোড়শ শতকের গোড়ার দিক। বাংলায় তখন হোসেন শাহি বংশের পতনকাল। হোসেন শাহি বংশের শেষ স্বাধীন সুলতান গিয়াসুদ্দিন মাহমুদ শাহর মসনদে লাগছিল পতনের আখেরি কাঁপন। রাজধানী গৌড়ের আসমানে ক্রমশই পুঞ্জিভূত হচ্ছিল পতনের কালো মেঘ। একদিক থেকে ধেয়ে আসছিল বিহারের সুবেদার শেরশাহের লশকর, অপরদিকে তার দরবারের কতিপয় উমারা খেলছিল গাদ্দারির এক নিপুণ খেলা।
বাংলার মসনদে হোসেন শাহি বংশের আগমন ঘটে ঈসায়ি ১৪৯৩ সালে। সৈয়দ আলাউদ্দিন হোসেন শাহ আল হোসাইনি ছিলেন এ বংশের প্রথম সুলতান। বাংলার মসনদে তার আরোহনের পথ ও পন্থা মোটেও পুষ্পসজ্জিত ছিল না। খুন এবং খঞ্জরের যথেষ্ট ব্যবহার করেই তিনি নিশ্চিত করেছিলেন গৌড়ের মসনদের সিঁড়ি।
যদিও তিনি তার নামের শুরুতে ‘সৈয়দ’ উপাধি লাগাতে পছন্দ করতেন, কিন্তু বাস্তব জীবনে ইসলামি তাহজিব তমদ্দুনের এখতিয়ারি করতে তিনি ছিলেন বরাবরই নাখোশ। তার চেয়ে তিনি বরং হিন্দুয়ানি আচার-অনুষ্ঠানের অনুরক্ত ছিলেন অধিক। জনশ্রুতি রয়েছে, তরুণ বয়সে কোনো এক ব্রাক্ষ্মণের কাছ থেকে সবধর্ম সহিষ্ণু ‘বৈষ্ণব ধর্মে’ দীক্ষা নেন তিনি। সেই ব্রাক্ষ্মণের আশ্রমে অতিবাহিত করেন তারুণ্যের দীক্ষাকালীন অনেকটা সময়। পরর্বতী জীবনে এই ব্রাক্ষ্মণের শিক্ষাই তিনি তামিল করেন সর্বক্ষেত্রে।
সুলতান নিজে ব্রাক্ষ্মণ্যবাদের অনুরক্ত ছিলেন বলে জনগণের মাঝেও হিন্দুয়ানি রীতিনীতির ব্যাপকতা ছড়িয়ে দেন। ফলে কিছুদিনের মধ্যে মুসলিম সমাজের ধর্মীয় বা সামাজিক অনুষ্ঠানে ঢুকে পড়ে হিন্দুয়ানি আচার-অনুষ্ঠান, সংস্কৃতি-প্রবণতা।
মুলকে বাংলায় এর আগে যদিও হিন্দু-মুসলমান সহাবস্থান ছিল, কিন্তু তাদের সংস্কৃতি ছিল স্বতন্ত্র। সুলতান ও তার কিছু ব্রাক্ষ্মণ উমারার কূটচালে ধীরে ধীরে ভেঙ্গে পড়ে সেই স্বাতন্ত্রবোধ। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের শাসনামলেই মূলত সাড়ম্বরে মুসলিম তাহজিব-তমদ্দুনে হিন্দু সংস্কৃতির অনাধিকার অনুপ্রবেশের দ্বার তার স্বহস্তে উন্মোচিত হয়।
ঈসায়ি ১৪৯৩ থেকে ১৫১৯ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ শাসনকালে সুলতান হোসেন শাহ একজন যোগ্য শাসকের ভার কাঁধে তুলে নিয়েছিলেনÑএকথা ঐতিহাসিক সত্য ধরা হলেও, তিনি যে ইসলামি মূল্যবোধকে নিজের কাঁধে থেকে নিপাট নির্দ্বিধায় নামিয়ে দিয়েছিলেন, সে ইতিহাসও বিস্মৃত নয়।
১৫১৯ সালে তার মৃত্যুর পর গৌড়ের মসনদে আধিষ্ঠিত হন তার পুত্র নাসিরউদ্দীন নসরত শাহ। একজন প্রজাদরদি শাসক হিসেবে তিনি ছিলেন মশহুর। তার শাসনামলে তিনি মুসলিম সমাজ থেকে বিদআত, কুসংস্কার, ভিন্ন সংস্কৃতির লেজুড়বৃত্তিকে দূর করার কোশেশ করেন বটে, তবে তার প্রচেষ্টা বড় একটা ফলপ্রসু হয়নি। কারণ শাহিমহল এবং সমাজের অভিজাতশ্রেণির অন্দরমহলে ততোদিনে ঢুকে পড়েছিল সুরাপানের চমকদার সোরাহি আর দিল-বেচাইনি সুরেলা সেতার। হিন্দুদের পূজা-পার্বনে নাচ আর ভজন গাইতে আসতো যেসব বাঈজী-নর্তকীরা, তাদের নিয়মিত ডাক পড়তো মুসলিম অভিজাত মহলের বালাখানায়। একথা যেন বাংলা আরেকবার স্মরণ করতে পারলোÑজাতির মগজের মধ্যে যখন পঁচন শুরু হয় তখন সে পঁচন সহজেই পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়ে।
ঈসায়ি ১৫৩২ সালে নাসিরউদ্দীন নসরত শাহর মৃত্যুর পর গৌড়ের মসনদে বসেন তার পুত্র আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহ। ১৫৩৩ সালে দৈবক্রমে তার মৃত্যু হলে আলাউদ্দিন হোসেন শাহর আরেক পুত্র গিয়াসুদ্দিন মাহমুদ শাহ বাংলার মসনদে আরোহন করেন। ধর্মপরয়াণ এবং একজন যোগ্য শাসক হওয়ার সমস্ত গুণাবলি তার মাঝে বিদ্যমান থাকলেও ভাগ্য সম্ভবত বাংলার ললাটলিখন লিখেছিলেন অন্যভাবে।
গিয়াসুদ্দিন মাহমুদ শাহর শাসনের তৃতীয় বছরের শুরুতে হঠাৎই বাংলার আকাশে জমতে থাকে দুর্যোগের কালোমেঘ। খবর পাওয়া যায়, বিহারে নিযুক্ত দিল্লির সুবাদার শেরশাহ বিরাট ফৌজ নিয়ে বাংলা আক্রমণের অভিলাষে গৌড়াভিমুখে রওনা দিয়েছেন। সুলতান গিয়াসুদ্দিন মাহমুদ শাহ শেরশাহকে নিরস্ত্র করতে সন্ধির পয়গাম পাঠান। বিশাল অঙ্কের নগদ অর্থ পেয়ে শেরশাহ বাংলা আক্রমণ না করে আবার বিহারে ফিরে যান।
কিন্তু সুলতান গিয়াসুদ্দিন মাহমুদ শাহ সম্ভবত শেরশাহকে চিনতে ভুল করেছিলেন। এবং এই গোপন খবর জানতেও তিনি বেখবর থাকেন যে, শেরশাহকে বাংলায় হামলা করার জন্য গোপনে আহবান জানিয়েছিল তার দরবারেরই কতিপয় উচ্চাভিলাষী উমারা। যারা স্বাধীন বাংলার আকাশের নিচে নিঃশ^াস নিয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে রঙমহলের আলো-আঁধারিতে শ্বাস নিতে বেশি অভ্যস্ত ছিল। ফলে ঈসায়ি ১৫৩৭ সালে শেরশাহ ফের বাংলা আক্রমণ করেন।
শেরশাহকে রুখার মতো লশকর যদিও বাংলার ফৌজি ছাউনিতে ছিল, কিন্তু সুলতানের সেইসব উমারার কূটচালে বাংলার লশকর রাজধানী ছেড়ে বিভিন্ন দূরবর্তী ছাউনিতে সরিয়ে ফেলা হয়। শেরশাহ রাজধানী গৌড়ে হামলা করলে সুলতান গিয়াসুদ্দিন মাহমুদ শাহ রাজধানী হেফাজতের দায়িত্ব তার দুই শাহজাদার হাতে অর্পণ করে তিনি ভাটি অঞ্চলে তার জামাতা সুলায়মান খানের কাছে সাহায্যের জন্য গৌড় ত্যাগ করেন।
বাংলার মসনদ খালি দেখে শেরশাহ প্রবলবেগে ধেয়ে আসেন রাজধানী গৌড়ের দিকে। গৌড়ের ফৌজিনিবাসের মুষ্টিমেয় সেনাবাহিনী কোনো প্রতিরোধই গড়ে তুলতে পারলো না। শেরশাহ খুব সহজেই পরাজিত করেন দুই শাহজাদার মামুলি প্রতিরোধকে। প্রবল বিক্রমে রাজধানীতে প্রবেশ করে শুরু করেন লুটতরাজ। পুরো গৌড় নগরীকে তিনি ধ্বংস্তূপে পরিণত করেন। পর্তুগিজ বর্ণনামতে, শেরশাহ রাজধানী গৌড় দখল করে বিশ মণ সোনার গহনা ও ছয় কোটি স্বর্ণমুদ্রা হস্তগত করেন।
এদিকে সুলতান গিয়াসুদ্দিন মাহমুদ শাহ ভাটি অঞ্চলে তার জামাতা সুলায়মান খানের আশ্রয়ে যাওয়ার পথে টাঙ্গাইলের আতিয়া নামক স্থানে ইন্তেকাল করেন এবং তাকে সেখানেই দাফন করা হয়। তবে শাহি পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা নিরাপদেই সুলায়মান খানের জায়গির ‘সরাইলে’ পৌঁছতে সক্ষম হন।
সুলতান গিয়াসুদ্দিন মাহমুদ শাহ’র ইন্তেকালের সাথে সাথে শেষ হয় বাংলার দু’শো বছরের স্বাধীন সুলতানি আমল। এরপর বাংলার মসনদ কব্জা করে দিল্লির আধিপত্যবাদী শাসকেরা।
আর ঠিক এই সময় থেকে বাংলার ইতিহাসে সূচিত হয় এক নতুন অধ্যায়। শত শত বছর ধরে বাংলার যে পাক জমিনে রোপিত হয়েছিল আজাদির বীজ, যে ময়দানে ঝলসে উঠেছিল বখতিয়ারের নাঙা তলোয়ার, যে আকাশে একবার উত্থিত হয়েছিল আজানের তাকবিরধ্বনি সে বাংলাকে কখনো পরাধীন করা যায় না।
গৌড়ের সিংহাসন থেকে সুলতানি শাসন শেষ হওয়ার পরই দিল্লির মুঘল সালতানাতের অধীনে চলে যায় মুলকে বাংলা। মুঘলদের অধীনে চলে গেলেও বাংলার আজাদির আওয়াজ কখনো থেমে থাকেনি। সুলতানি আমল শেষ হওয়ার পরপরই দিল্লির আধিপত্যবাদী কায়েমি শাসনের বিরুদ্ধে হতিয়ার তুলে নেয় বাংলার মুষ্টিমেয় কয়েকজন জমিদার। যারা পরাধীনতার সোনার জিঞ্জিরের চেয়ে বেশি পছন্দ করতো আজাদির খুন রাঙা পথ। এই জমিদারদের নেতৃত্ব দেন প্রয়াত সুলতান গিয়াসুদ্দিন মাহমুদ শাহর জামাতা সুলায়মান খান।
সুলায়মান খানের ব্যাপারে ইতিহাস কথা বলেনি খুব বেশি। পূর্বাপর ইতিহাস থেকে জানা যায়, যৌবনে তিনি ছিলেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী। ভারতের অযোধ্যা থেকে ভাগ্যান্বেষণে গৌড়ে এসে সুলতানের নেকনজরে পড়ে যান। সুলতানের আরেক জামাতা ইবরাহিম মালেকুল উলামার বদান্যতায় তিনি রাজস্ব বিভাগে চাকরি পান। সুলতানের অধীনে চাকরি করার সময় ইসলামের মহানুভবতা দেখে ইসলাম গ্রহণ করে মুসলমান হন এবং নিজের কর্মদক্ষতা, মেধা, সততা, যোগ্যতা দিয়ে তিনি সুলতানকে এতোটাই মুগ্ধ করেন যে, সুলতান নিজের কনিষ্ঠ কন্যাকে তার কাছে বিয়ে দিয়ে তাকে নিজের জামাতা হিসেবে গ্রহণ করে নেন। বিয়ের পর সর্ববিদ্যায় পারদর্শী এ জামাতাকে উপহারস্বরূপ প্রদান করেন ভাটি অঞ্চলে সরাইল পরগণার জায়গির। জায়গির পাওয়ার পর সুলায়মান খান সস্ত্রীক সরাইলে বসবাস শুরু করেন।
ওদিকে শেরশাহ যদিও দিল্লির নিযুক্ত বিহারের সুবাদার ছিলেন, কিন্তু তিনি বাংলা দখল করেন দিল্লির আদেশে নয়, বরং নিজের লোভ ও উচ্চাভিলাষ চরিতার্থে। যার দরুণ দিল্লির মোগল সম্রাট হুমায়ুন ১৫৩৮ সালে বাংলা আক্রমণ করে শেরশাহের দখল থেকে বাংলা ছিনিয়ে নেন। সম্রাট যখন বাংলা থেকে দিল্লির পথে যাত্রা করেন তখন শেরশাহ বক্সারের কেল্লার নিকটবর্তী চৌসার ময়দানে সম্রাট হুমায়ুনের বাহিনীর উপর আচমকা হামলা করেন। বক্সারের লড়াইয়ে সম্রাট পরাজিত হয়ে দিল্লির দিকে পালিয়ে যান। শেরশাহ এই বিজয়ে উদ্দীপ্ত হয়ে বিহারের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং ত্বরিতবেগে বাংলায় হামলা চালিয়ে দিল্লির নিযুক্ত সুবাদার জাহাঙ্গীর কুলিকে পরাজিত ও হত্যা করে পুনরায় বাংলা দখল করে নেন। ১৫৪০ সালে শেরশাহ কানৌজের যুদ্ধে সম্রাট হুমায়ুনকে পরাজিত করে দিল্লির মসনদ দখল করে নেন।
ঈসায়ি ১৫৪০ সালে শেরশাহ দিল্লির সম্রাট হলেও নানা কারণে তিনি বাংলার দিকে খুব একটা নজর দিতে পারেননি। এ সময় তিনি হিন্দুস্তানের বিভিন্ন মোগল সুবাদারদের বিদ্রোহ দমনে ছিলেন মশগুল। ফলে বাংলার কয়েকজন জায়গিরদার ও জমিদার সুলায়মান খানের পতাকাতলে একতাবদ্ধ হন দিল্লির কায়েমি শাসনের নাগপাশ থেকে বাংলাকে আজাদ করার প্রত্যয়ে। গোপনে ধীরে ধীরে তারা বাড়াতে থাকেন তাদের ফৌজ এবং নিজ নিজ অঞ্চলে গড়তে থাকেন প্রতিরোধ ব্যুহ।
ঈসায়ি ১৫৪৫ সালে শেরশাহের ইন্তেকালের পর দিল্লির মসনদে আরোহণ করেন তার পুত্র ইসলাম শাহ। শেরশাহ জীবদ্দশায় বাংলার দিকে নজর না দিতে পারলেও তার পুত্র ইসলাম শাহ একই ভুল করতে ছিলেন নারাজ। মসনদে আরোহন করেই তিনি শামসউদ্দিন মুহাম্মদ খান সুরকে বাংলার সুবাদার করে পাঠান।
সুবাদার মুহাম্মদ খান বাংলায় আগমনের পরপরই সমগ্র বাংলা দিল্লির নিয়ন্ত্রণে আনার প্রচেষ্টা চালান। কিন্তু ততোদিনে দেরি হয়ে গেছে অনেক। পূর্ব বাংলার ভাটিরাজ্যের জায়গিরদার সুলায়মান খান শক্তভাবে ভিত রচনা করে ফেলেছেন সরাইল ও তার আশপাশের এলাকায়। বাংলার পূর্বাঞ্চলের আজাদিকামী অন্যান্য জমিদারদেরও করে নিয়েছেন সংঘবদ্ধ। তাকে বিশেষভাবে সাহায্য করেছিলেন তরফরাজ্যের সুবাদার ও সুলতান গিয়াসুদ্দিন মাহমুদ শাহর বড় জামাতা ইবরাহিম মালেকুল উলামা। যার হাত ধরে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে এসেছিলেন জায়গিরদার সুলায়মান খান।
ঈসায়ি ১৪৪৬ সালে দিল্লির সুবাদার মুহাম্মদ খান সুর ও বাংলার সম্মিলিত বিদ্রোহী বাহিনীর প্রধান সুলায়মান খানের সাথে কয়েকটি খণ্ডযুদ্ধ সংঘটিত হয়। মুহাম্মদ খান সুর সব ক’টি লড়াইয়ে পরাজিত হয়ে রাজধানী গৌড়ে ফিরে আসেন। দিল্লির সম্রাট এ খবর পেয়ে ক্রোধে ফেটে পড়েন এবং তখনই মুঘল ফৌজের নামকরা দুই সেনাপতিÑ তাজ খান ও দরিয়া খানকে বিপুল সৈন্য সামন্ত দিয়ে বাংলায় প্রেরণ করেন। অবশেষে লক্ষ্যা নদীর তীরে পানিশ্বর নামক ময়দানে এক মরনপণ লড়াইয়ে পরাজিত হয়ে সুলায়মান খান দিল্লির সাথে সন্ধি করতে সম্মত হন।
সন্ধিবস্থায় অল্প কিছুদিন সময় অতিবাহিত হয়। কিন্তু এর কিছুদিন পর বাংলার কয়েকজন জমিদার সুলায়মান খানের সঙ্গে বিদ্রোহে একাত্মতা ঘোষণা করলে তিনি আবার বিদ্রোহ করেন। তিনি বিদ্রোহ করেন এমন এক মোক্ষম সময়ে যখন দিল্লিবাহিনীর ভেতরে চলছিল ক্ষমতার দ্বন্দ। যার দরুণ বাহিনী ছিল বিশৃংখল ও ছত্রভঙ্গ। এ সময় সুলায়মান খান কয়েকটি যুদ্ধে মুঘলদের পরাজিত করতে সক্ষম হন।
দিল্লির স¤্রাট থেকে দুই সেনাপতি তাজ খান ও দরিয়া খানের ওপর কড়া নির্দেশ ছিলÑসুলায়মান খানকে হত্যা না করে তারা যেন দিল্লি ফেরত না আসে। কোনোভাবেই সুলায়মান খানকে পরাস্ত করতে না পেরে মুঘল সেনাপতি তাজ খান ও দরিয়া খান এক ঘৃণিত চক্রান্তের আশ্রয় নেন। তারা বুঝতে পেরেছিলেন বাংলার এই লড়াকু সিপাহিকে লড়াই করে পরাভূত করা যাবে না। তাই তারা সুলায়মান খানকে আলোচনার জন্য তাদের শিবিরে ডেকে আনেন। দিল্লির সেনাপতিদের সঙ্গে আলোচনা করতে তাদের শিবিরে এলে সুলায়মান খানকে নির্মমভাবে শহিদ করা হয়।
তার হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলার জমিদার ও জায়গিরদারদের নিয়ে দিল্লির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ কিছুদিনের জন্য স্তিমিত হয় বটে, তবে মোগল সেনাপতিদ্বয় যেমন ভেবেছিলেন সুলায়মান খানের মৃত্যুর ভেতর দিয়েই খতম হয়ে যাবে বাংলার আজাদিপাগল মানুষের স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা, চিরদিনের জন্য তাদেরকে আবদ্ধ করে ফেলবেন দিল্লির কায়েমি শাসনের জিঞ্জিরে; এ ছিল তাদের এক বড় ভুল।
সুলায়মান খানের শাহাদাতের মধ্য দিয়ে বাংলার সেই ইতিহাসের শুরু হলো কেবলÑ যে ইতিহাস পরবর্তী পাঁচশো বছর বাংলাকে করে তুলেছিল স্বাধীনতার অতল পিয়াসী। স্বাধীনতার যে বীজ সুলায়মান খান নিজের খুন ঢেলে রোপন করে গিয়েছিলেন বাংলার জমিনে, বছরে বছরে তা ফলিয়েছে স্বাধীনতার সূর্যসন্তানদের, বাংলার প্রতিটি দীপশিখায় প্রতিদিন জ্বলে উঠেছে চেতনার অবিনাশী বহ্নি হয়ে। সুলায়মান খানের শাহাদাত বাংলার বুকে সর্বপ্রথম আওয়াজ তুললো স্বাধীনতার।
শহীদ হওয়ার পূর্বে সুলায়মান খান তার দশ বছর বয়সী কিশোর ছেলের হাতে তুলে দিয়েছিলেন একটি জাতির মুক্তির পরোয়ানা। বুকের ভেতর সিল করে দিয়েছিলেন বাংলার আজাদির সনদ। সেই কিশোরই একদিন হয়ে উঠেন বাংলার আজাদির মহানায়ক, বারোভূঁইয়ার সিপাহসালারÑঈসা খান। শুরু হয় এক নতুন ইতিহাস। শুরু হয় বাংলার আজাদির লড়াইয়ের এক নতুন দাস্তান।
[ এটি একটি উপন্যাসের ভূমিকা। লিখেছিলাম আজ থেকে ১৫ বছর আগে। সে সময় ঈসা খানকে নিয়ে বছরখানেক বেশ বুঁদ হয়ে পড়ে রইলাম। যেখান থেকে পারি বইপত্র সংগ্রহ করে পড়াশোনা করলাম। মনে প্রবল ইচ্ছা ঈসা খানের ওপর একট উপন্যাস লিখেই ফেলবো। দু-তিনবার দুটো পা-ুলিপিতে ২০-৩০ পৃষ্ঠা করে লিখেও ফেললাম। কিন্তু কেন যেন আর লেখা হয়ে উঠল না। এই ভূমিকাটা ছিল ওই বুঁদ-জমানার একদম শেষদিককার লেখা। ভূমিকাটাই কেবল কম্পোজ করা হয়েছিল, বাদবাকি পৃষ্ঠাগুলো কই আছেÑআমি নিজেও জানি না।
তাহলে কেন এতটুকু ভূমিকা এখানে উল্লেখ করলাম? আছে, কারণ আছে। এই ভূমিকা হারিকেনের একটা সলতের মতো। যেটা আগুন জে¦লে কেবল আমাকে নয়, আলোকিত করবে আরও শত জনকে। যারা বাংলার ইতিহাস পড়তে চায়, লিখতে চায়, জানতে চায়Ñএই ভূমিকা তাদের আলোড়িত করবে প্রতি রাতে। তাদের বুকের মধ্যে দীপশিখা হয়ে জ¦লতে থাকবে নিরবধি। যতক্ষণ পর্যন্ত না বাংলাদেশে নিজেদের পূর্বপুরুষদের ইতিহাস দৃঢ় হাতে লেখা হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত এই সলতের আগুন ফুরোবে না। ]
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, নবধ্বনি