বহু আলোচনা-সমালোচনার পর স¤প্রতি কওমি মাদরাসার দাওরায়ে হাদিসের সমমান দিয়েছে সরকার। সংসদে এই বিলটি খুব জোরালোভাবে পাশ হয়েছে। না ভোট দিয়ে বিলটি খুব সহজে বাতিল করে দেওয়া যেত। কিন্তু অনেকটা আশাতীতভাবে অর্জিত হয়েছে কওমি সনদের স্বীকৃতি। তাই বছরটি বাংলাদেশের কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের জন্য স্মরণীয় একটি বছর। শুধু কওমি মাদরাসার জন্যই না, বরং প্রায় দেড়শ বছর ধরে চলে আসা প্রাণবন্ত একটি শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয় স্বীকৃতি লাভ করায় বাংলাদেশের ইতিহাসে এই বছরটি আলাদাভাবে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।
এভাবে স্বীকৃতি পাওয়া যেমন সাধারণ জনগণের কাছে আশাতীত ছিল তেমনি আশাতীত ছিল স্বয়ং কওমি মাদরাসা সংশি¬ষ্ট ব্যক্তিদের কাছেও। কেউ কেউ স্বীকৃতি নেওয়া হবে কিন্তু এই সরকারের কাছ থেকে নয় কিংবা যেভাবে চাওয়া হচ্ছে সেভাবে দেওয়া হবে কিনা সে বিষয়ে সন্দিহান ছিলেন। চলতি বছরেই মিরপুরের আরজাবাদে একটি সম্মেলন হয়েছিল, যেখানে প্রায় এ ধরণের বক্তব্য দেওয়া হয়। এরপর খুব দ্রæত মত পরিবর্তন করে আলেমরা স্বীকৃতি গ্রহণ করেন।
কওমি মাদরাসাকে সরকার স্বীকৃতি দেওয়ার পর বেশ কিছু মহল এর বিরোধিতা করে। এদের মধ্যে তরিকত ফেডারেশন নামের একটি দলকে মাঠে নামতেও দেখা যায়। এ ছাড়া আলিয়া মাদরাসার কেউ কেউ এর বিরোধিতা করেন। সেক্যুলার মানসিকতার অনেক ব্যক্তি এটাকে নতুন ইস্যু হিসেবে নিয়ে আলোচনা-টকশোতে নিজেদের জ্ঞান জাহির করেন। এসব মহলের স্বীকৃতি-বিরোধিতার পেছনে কোনো স্বার্থ ছিল যে, তা ¯পষ্ট।
আরেকদল মানুষ এই স্বীকৃতির বিপক্ষে কথা বলেছেন। আশ্চর্যের বিষয়, তাঁরা কওমি মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষক। তাঁদের বিরোধিতার কারণ রহস্যাবৃত। এই লেখায় আমি কিছু সম্ভাব্য কারণ বিশ্লেষণের চেষ্টা করব।
স্বীকৃতির এই দাবি দীর্ঘদিনের। একসময়ে এই দাবি আদায়ের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া মনীষীদের অনেকেই পরলোক গমন করেছেন। স্বীকৃতির দাবির সঙ্গে মাদরাসার শিক্ষার্থী বা ছাত্ররা অনেক আগে থেকেই পরিচিত। তবে দুঃখের বিষয় হলেও সত্য, এই দীর্ঘ সময়েও কওমি মহলে স্বীকৃতি নিয়ে নিরবচ্ছিন্ন ঐকমত্য গড়ে ওঠেনি। শিক্ষা বোর্ডের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা স্বীকৃতির বিষয়ে সচেতন হলেও অন্যরা এই বিষয়ে তেমন আগ্রহী নয়। বরং প্রথম শ্রেণীর অনেক আলেমকে প্রকাশ্যে এখনও স্বীকৃতির বিপক্ষে কথা বলতে শোনা যায়।
এদের মধ্যে একটি দল স্বীকৃতির বিরোধিতা করেছিলেন নিজেদের স্বকীয়তা হারাবার ভয়ে। স্বীকৃতি দেওয়া হলে সরকারের কর্তৃত্ব এসে যেতে পারে বা আলিয়া মাদরাসার মত পরিণতি হতে পারে। এই কারণটি যৌক্তিক মনে হলেও অমূলক। কারণ, কওমি মাদরাসার সর্বজন শ্রদ্ধেয় এবং আস্থাভাজন ব্যক্তিরা এই স্বীকৃতি গ্রহণ করেছেন। তাই নিজেদের স্বকীয়তা বা আদর্শ হারাবার ভয় আর থাকার কথা না।
এরপরও যারা স্বীকৃতির বিরোধিতা করছেন বা স্বীকৃতি পেয়ে অসন্তুষ্ট তাঁদের অসন্তুষ্টির একমাত্র কারণ অজ্ঞতা এবং অসচেতনতা। এর বাইরে কোনো কারণ থাকতে পারে বলে মনে হয় না।
অজ্ঞতা এবং অসচেতনতা এই দুটোকে মারাত্মক অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা যায়। কোনো গোষ্ঠী বা জাতির ধ্বংসের জন্য এর চেয়ে বেশি কিছু লাগে না। কওমি মাদরাসার মতো গুরুত্বপূর্ণ মহলে এমন অপরাধীর বিচরণ থাকবে, তা কখনোই মেনে নেওয়া যায় না।
ব্যক্তি পর্যায়ে অনেকেই স্বীকৃতি নিয়ে অসন্তুষ্ট, তার প্রমাণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে পাওয়া যায়। ফেসবুকে বা ফেসবুকের বাইরে সুপরিচিত এমন অনেকের স্ট্যাটাস পড়ে মনে হয়েছে স্বীকৃতি দেওয়াটা সরকারের ভুল ছিল। স্বীকৃতি না হলেই বুঝি তাঁরা ভালো থাকতেন।
হয়তো এমন অজ্ঞ ও আত্ম-অসচেতন লোকদের কারণেই সমাজে এত বড় অবদান রাখার পরও কওমি মাদরাসাকে ছোট করে দেখা হয়। আলাদা প্রজাতির মানুষ ভাবা হয় কওমির সন্তানদের। যোগ্য ও দক্ষ হয়েও কর্মহীন হয়ে থাকতে হয় তাঁদের।
অজ্ঞতা ও অসচেতনতার কারণ কী? কেন স্বীকৃতির বিষয়ে অনাগ্রহ তাঁদের? আল্লামা আহমদ শফি এবং দেশের বরেণ্য আলেমগণ স্বীকৃতি গ্রহণ করার পরও কেন তাঁদের অনাস্থা?
এর উত্তর খুঁজে পাওয়া কঠিন। তবে অজ্ঞতা, অসেচতনতা ও অধঃপতন একটি অপরটির সঙ্গে যুক্ত। অজ্ঞতার কারণে অসচেতনতা তৈরি হয়। অসচেতনতা থেকে শুরু হয় পতন।
অনেকে এই স্বীকৃতির কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। চাকরি পাব কিনা, বিসিএস দেওয়া যাবে কিনা ইত্যাদি। এখনই এ ধরণের প্রশ্ন করা বীজ বপন করে অঙ্কুরোদ্গম হওয়ার আগেই ফল খাওয়ার আশা করার মতো।
আগে থেকে স্বীকৃত দেশের অন্যান্য শিক্ষাব্যবস্থার দিকে তাকালে আমরা এর উত্তর পেতে পারি। কলেজ বা আলিয়ার ছাত্ররা কি চাকরি পেয়ে যায়? কয়েক মিলিয়ন বেকারের এই দেশে চাকরিকে সোনার হরিণ না বলে আনযা পাখির সঙ্গে তুলনা করলেও অত্যুক্তি হবে না।
স্বীকৃত সনদধারী লক্ষ লক্ষ যুবক যেখানে বেকার বসা সেখানে স্বীকৃতি পাওয়া মাত্রই চাকরির আশা করা কি অজ্ঞতার পরিচয় বহন করে না?
তবে এ কথা সত্য, চাকরির বাজারে কদর যোগ্যদেরই। চাকরি প্রার্থী কোন ধারা বা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করেছেন তা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় না। চাকরির জন্য তিনি উপযুক্ত কিনা সেটাই আসল বিষয়। তাই নিরাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই।
এই স্বীকৃতি কওমি শিক্ষার্থীদের অগ্রযাত্রার প্রথম ধাপ। এখনো অনেক কাজ বাকি। এখনো ছয়টি বোর্ড একত্র হতে পারেনি। এখনো মাদরাসাগুলোর শিক্ষাগত বিষয়ের অভিন্ন নিয়ম-কানুন তৈরি হয়নি। শিক্ষাকাল, পাঠ্যসূচী ইত্যাদি বিষয়ে কোনো নিয়ম নেই। প্রতিষ্ঠানের জন্য বোর্ডের পক্ষ থেকে যথাযথ তদারকি ব্যবস্থা নেই। শিক্ষক নিয়োগেও পরিচ্ছন্ন নীতিমালা তৈরি হয়নি।
স্বীকৃতি না থাকায় স্বাধীনতার পর থেকে যে ক্ষতি হয়ে গেছে তা পুষিয়ে নিতে আরও কয়েক দশক সময় লেগে যাবে। অন্যান্য কর্মক্ষেত্রের কথা বাদ দিয়ে শুধু মসজিদের ইমাম পদের কথা বলি। বাংলাদেশের বেশিরভাগ সরকারি মসজিদের ইমাম আলিয়া মাদরাসা পড়–য়া সুন্নি ও নানা মতবাদে বিশ্বাসী। স্বীকৃতি না থাকায় কওমি মাদরাসার যোগ্য ও শুদ্ধ ব্যাক্তিদের জায়গা হয়নি এ সব মসজিদে। ফলে অনেক ক্ষেত্রে সঠিক ধর্মীয় দীক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়েছে মানুষ। এখন সে সুযোগ এসেছে। অন্যান্য চাকরির চিন্তা বাদ দিয়ে ইমাম পদের কথা চিন্তা করলেই দেখা যায় বিরাট কর্মক্ষেত্র পড়ে আছে এখানে।
স্বীকৃতি দিয়ে সরকার তাদের কর্তব্য পালন করেছে। কিন্তু নিজেদের করণীয় অনেক কাজ এখনো বাকি রয়ে গেছে। নিজেরা কি নিজেদের স্বীকৃতি দিতে পেরেছি এখনো?
নভেম্বর ২০১৮