সান্নিধ্য ও বিশেষ সম্পর্কের দিক থেকে আমার গুরুভাগ্য খুব ভালো ছিল না। হিফজখানা থেকে বের হয়ে কিতাব বিভাগে আসার পর উস্তাদদের সঙ্গে সেভাবে কোনো সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। কওমি ধারায় ‘তালিমি মুরব্বি’ নামে যে একটি ব্যাপার আছে, সেই দায়িত্ব পালন করেছেন আমার বাবা এবং চাচা, তাই আলাদা করে কোনো উস্তাদের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক তৈয়ারের তেমন দরকার পড়েনি। আবার উস্তাদদের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্কের যে মর্যাদা, সেটার প্রতি ছিল আমার ভয়মিশ্রিত বিশেষ শ্রদ্ধা; ছাত্র হিসেবে খানিকটা ডানপিটে হবার কারণে আমার আশঙ্কা ও ভয় ছিল—কোনো উস্তাদের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক তৈরির পর তার মান রক্ষা আমার পক্ষে কঠিন হবে। তবে বলা বাহুল্য, প্রত্যেক উস্তাদের প্রতিই অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও সমীহ ছিল। উস্তাদদের টুকটাক খেদমত, পাঞ্জাবিটা ধুয়ে দেওয়া, খাবারটা নিয়ে আসা—এসব কাজ অতি উৎসাহের সঙ্গে করেছি। আজও যেকোনো শিক্ষাগুরুর সঙ্গে দেখা কিংবা কথা হলে শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতাবোধে নুয়ে পড়ে আমার সমগ্র সত্তা।
শুরুতেই কিতাব বিভাগটাকে আলাদা করেছি কারণ, হিফজখানায় থাকতে একজন উস্তাদের বিশেষ তত্ত্বাবধান পেয়েছিলাম। হিফজ বিষয়ে আমার চরম আতঙ্কগ্রস্ততার একসময়ে আল্লাহ তাআলা মিলিয়ে দিয়েছিলেন এই উস্তাদকে।
একদম ছেলেবেলা, প্রাথমিক ক্লাসগুলো শেষ হবার পর হিফজের প্রতি আমার প্রচণ্ড আগ্রহ তৈরি হয়। সেই আগ্রহ থেকেই হিফজে ভর্তি। প্রথম কিছুদিন গ্রামীণ একটি মাদরাসায় অনাবাসিকভাবে পড়েছি। পরে আবাসিক একটি মাদরাসায় ভর্তি করে দেওয়া হলো। এখানে কিছুদিন যাবার পর মনে হলো, এই পরিবেশ আমার জন্য নয়। দিন-রাতের কঠোর রুটিনের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া সম্ভবপর হয়ে উঠছিল না। আবার মারপিট আমি দারুণ ভয় পাই, শৈশবে সেই ভয় আরও প্রকট ছিল। একদিকে কঠোর কানুন, বাড়ির জন্য অস্থিরতা ও চাপা-কান্না, তারউপর জালিবেত হাতে উস্তাদের চোখরাঙানি দেখলে নিজেকে নিদারুণ অসহায় লাগত।
কুরআন হিফজের জন্য আমাদের দেশের হিফজখানাগুলোতে টাইট শিডিউলের এই আবাসিক পদ্ধতি বাচ্চাদের জন্য কতটা উপযোগী, তা নিয়ে কেউ ভাবেন কি না জানি না; তবে সেই ছেলেবেলায় যে এ পদ্ধতির উপর আমার বিতৃষ্ণা জন্মেছিল তা এখনো কাটেনি। ৬/৭/৮ বছরের একটা বাচ্চা কুরআন হিফজের জন্য এমন টাইট শিডিউলের মধ্য দিয়ে তার দিন-রাতের ২৪ ঘণ্টা পার করবে, যেখানে সাকুল্যে ঘণ্টা দুয়েক বা তারচেয়েও কম সময় তারা খেলাধুলা বা নিজেদের ‘বাচ্চামি’ প্রকাশের সুযোগ পায়, আর বাকিটা সময় থাকতে হয় উস্তাদের কড়া নেগরানি চোখরাঙানি ও জালি বেতের আওতায়—আমার কাছে কখনোই এ পদ্ধতিকে বাচ্চাদের উপযোগী মনে হয়নি। অনেক বাচ্চা এই পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারলেও তাদের উল্লেখযোগ্য একটি সংখ্যা কিন্তু ঝরে পড়ছে শুধু পদ্ধতিগত জটিলতার কারণে। আবার যারা টিকছে, তাদের বড় একটি অংশও নিজের শিশুমনের সঙ্গে নানাবিধ সংগ্রাম করে নিজেকে পরিবেশের উপযোগী করে তুলছে। বাচ্চাদেরকে এই কঁচি-বয়সে এমন একটি সংগ্রামের দিকে ঠেলে দেওয়া কতটা উপযোগী সেটাও একটি বড় প্রশ্ন।
টাইট শিডিউলের জটিলতা ছাড়াও আরও বেশ কিছু সমস্যা আছে এই আবাসিক পদ্ধতিতে। তার মধ্য থেকে সবচেয়ে মারাত্মক সমস্যাটির কথা আমরা মুখে আনতে চাই না। কদিন পরপরই এই সমস্যাটি খবরের শিরোনাম হয়, তখন কেউ মুখ লুকাই আবার কেউ গা বাঁচাবার চেষ্টা করতে গিয়ে নানাবিধ কুতর্ক হাজির করি। সমস্যার সমাধানের দিকে করোরই মনোযোগ খুব একটি থাকে না; অথোরিটি পর্যায়ের কারও তো নয়ই, আমরা সাধারণ যাঁরা তাঁরাও খুব একটা সোচ্চার হই না। অথচ সকলেই জানি, হিফজখানাগুলোতে কমবেশি এর বাস্তবতাটা আছে।
এর বাইরে হিফজখানার শিক্ষকদের মারপিটের বিষয়টিও খবরের শিরোনাম হতে দেখি। এখানে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হলো, হিফজখানায় চোখরাঙানি, ধমকি ও জালিবেতের ব্যবহারকেই বাচ্চাদের শিক্ষা দানের সর্বোত্তম তরিকা মনে করা হয়। দেশে এখন হিফজ-শিক্ষক প্রশিক্ষণ কোর্সের বিভিন্ন ব্যবস্থা আছে, এগুলোতে তাজভিদ-মাখরাজ-লেহেন ইত্যাদির বাইরে বাচ্চাদেরকে পড়ানোর তর্জ-তরিকা বিষয়ে কোনো সবক দেওয়া হয় কি না, জানি না। দিলেও এসবের কার্যকারিতা কিন্তু সেভাবে পরিলক্ষণ করা যায় না। হিফজ-শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ কোর্সগুলোতে তাজভিদ-মাখরাজ-লেহেনের তালিমের পাশাপাশি সমান বা অধিক গুরুত্বের সঙ্গে বাচ্চাদের সঙ্গে উস্তাদরা কীরূপ আচরণ করবেন, জালিবেত ও জোরজবরদস্তি ছাড়া কী পদ্ধতিতে তাকে পাঠে আগ্রহী করে তুলবেন—এসব বিষয়ে শিক্ষকদেরকে প্রশিক্ষণ করানো দরকার।
কুরআন হিফজের এই টাইট শিডিউল পদ্ধতিতে না গিয়েও বহিঃবিশ্বের মুসলিম দেশগুলোতে প্রচুর শিশু-কিশোর হাফিজ হচ্ছে। নিজেদের সাধারণ পড়াশোনা জারি রেখেও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দিনের একটি অংশ তারা কুরআন হিফজের পেছনে ব্যয় করে পুরো কুরআন সিনায় ধারণ করছে। দেশে এই পদ্ধতিগুলো প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এবং কার্যকর পন্থায় চালু করলে আমাদের শিশুদেরকেও তাদের শৈশবের আনন্দ-চপলতাকে বুকভরা দীর্ঘশ্বাসে পরিণত করা লাগবে না।
আমার নিজের কথায় ফিরে আসি। হিফজখানার সেই নতুন পরিবেশে আমি নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছিলাম না। যে উস্তাদ আমাদের দায়িত্বে ছিলেন, আদতে তিনি রহমদিল ও মেহনতি ছিলেন, ছাত্রদের পেছনে প্রচুর খাটতেন, কিন্তু ছাত্রদের সঙ্গে তাঁর শাসনের ভিত ছিল জালিবেত-নির্ভর। একই সঙ্গে বাহ্যিক আচরণও ছিল ভীতিসঞ্চারক। এই পরিবেশে আমি রীতিমতো অসুস্থ হয়ে পড়লাম। মাদরাসায় আর থাকা হলো না। বাড়িতে ফেরার পর কিছুদিন বিশ্রাম নিয়ে যখন সুস্থ হয়ে উঠলাম, পরিবার থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো অন্য আরেকটি মাদরাসায় ভর্তি করার। সেই মাদরাসাটি হিফজের জন্য আমাদের এলাকায় স্বনামধন্য ছিল, তবে তারচেয়েও বেশি ‘বিখ্যাত’ ছিল সেখানকার হিফজের মারপিট। পারিবারিক সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করার জো ছিল না, তবে মনে মনে দুআ করছিলাম অন্তত এই মাদরাসায় যেন আমাকে যেতে না হয়। কয়েকদিনের ভেতর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হয়ে গেল। আমাদের জেলা শহরের অদূরে গ্রামের ভেতর ছোট্ট একটি মাদরাসা পাওয়া গেছে। শুধু হিফজখানা। ২০/২২ জন ছাত্র আর একজন উস্তাদ। উস্তাদও আব্বুর পরিচিত।
বাড়ি থেকে দূরে থাকা এবং আবাসিকের কষ্টটুকু বাদ দিলে পরের তিনটি বছর আমাকে আর একটি বারের জন্যও মনখারাপ করতে হয়নি। গ্রামীণ পরিবেশে সেই ছোট্ট মাদরাসাটি আমরা ২০/২২টি কিশোরের জন্য হয়ে উঠেছিল দ্বিতীয় বাড়ি। মুরগি-ছানার মতো হুজুর আমাদের আগলে রাখতেন। আবার তাঁর শাসনের কায়দাও ছিল খুবই অদ্ভুত। বেতের ব্যবহার করতেন না। কোনো ছাত্র উল্টাপাল্টা করলে তার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ। হুজুর আমাদেরকে এতটাই স্নেহ-মমতায় রাখতেন, কোনো ছাত্রের সঙ্গে তিনি কথা বলা বন্ধ করলে সেই ছাত্রটি অস্থির হয়ে পড়ত, এই শাস্তিটি তার জন্য হাজার ঘা বেতের চেয়েও অসহ্য হয়ে দাঁড়াত। হুজুর তার পড়া শুনতেন ঠিকই, কিন্তু কথা বলতেন না। মুখের দিকেও তাকাতেন না। রাতে যখন খাওয়া-দাওয়ার পর সবাইকে নিয়ে গল্পের আসর জমাতেন, সেখানেও তার দিকে তাকাতেন না। এ ছিল এক অসহ্য যন্ত্রণা। ছাত্রটিকে অনেক কষ্টে হুজুরের রাগ ভাঙাতে হতো। যে অপরাধে হুজুর রেগেছেন, সেই অপরাধটি আর কখনো না করার ওয়াদা করতে হতো। অন্য হিফজখানার মতো এত টাইট শিডিউলও ছিল না, বিকালের খেলাধুলা তো ছিলই, দিন-রাতের বড় একটি অংশে আমাদের সঙ্গে নানাবিধ খোশগল্প করতেন। ফলে দীর্ঘ ক্লাসের যে একঘেয়েমি তা আমাদেরকে তেমন স্পর্শ করত না।
মাদরাসা থেকে বিদায়ের প্রাক্কালে হুজুরের নতমুখের চোখের জল আজও আমাকে স্পর্শ করে। বিদায়ের সময় একটি বারও হুজুর মুখ তুলে তাকাতে পারেননি। প্রতিটি ছাত্রের বিদায়েই হুজুর এভাবে কাঁদেন।
উস্তাদুল হুফফাজ মাওলানা হাফিজ আব্দুল মুকিত। মহান শিক্ষাগুরু! আল্লাহ আপনাকে দুনিয়া ও আখেরাতে আগলে রাখুন, যেভাবে সন্তানের মতো আপনি আগলে রাখেন আপনার প্রতিটি ছাত্রকে।
লেখক : সহকারী সম্পাদক, মাসিক নবধ্বনি
অক্টোবর, ২০২১ সংখ্যায় প্রকাশিত