যিনি শিক্ষা ও প্রজ্ঞার আলোকিত প্রদীপ সবার অন্তরে জ্বালিয়ে দেন এবং যিনি পিতার ¯েœহ, মায়ের মমতার পরশ বুলিয়ে দরদী মালীর মতো একটি মানবকলিকে প্রস্ফুটিত করেন, তিনিই শিক্ষক। আমি এই ছোট্ট জীবনে অনেক শিক্ষকের সান্নিধ্য নিয়ে ধন্য হয়েছি। তাঁরা আমার চোখের তারায়, হৃদয়ের মণিকোঠায় রাজার আসনে সমাসীন।
আলহামদুলিল্লাহ, আমিও তাঁদের শুভ্র মনের আঙিনায় সামান্য হলেও জায়গা করে নিতে পেরেছি। আমার সকল শিক্ষক জ্ঞানের উজ্জ্বল বাতিঘর, আদর্শ ছাত্র গড়ার দক্ষ কারিগর। তাঁদের উজ্জ্বল জ্ঞানের আভায়, আলোর ছিটেফোঁটায় আমার জীবন আলোয় আলোয় ভরে উঠেছে। তাঁরা প্রত্যেকেই একেকটি সুরভিত ফুল। যে ফুলের মনমাতানো সৌরভে-সুবাসে আমার জীবন-উদ্যান পুষ্পিত বসন্তের সাজে সেজেছিল। আমি আমার প্রত্যেক শিক্ষককে সমান দৃষ্টিতে সম্মান করেছি। সামর্থ্য অনুযায়ী তাঁদের টুকটাক কাজ করে দিতাম। তাঁরা আমাকে দোআ দিতেন। ভালোবাসার চাদরে জড়াতেন। ¯েœহ বিলাতেন। আমি তাঁদেরকে হৃদয় থেকে ভালোবাসতাম। এই ভালোবাসার টানে বারবার তাঁদের সাহচর্যে যেতাম। মাদরাসা বন্ধের সময় তাঁদের কথা মনে পড়ত। তাঁদের জন্য হৃদয় পুড়ত। কারো প্রতি ভালোবাসা, হৃদয়ের টান খোদাপ্রদত্ত। তাই মন চাইলেও সবাইকে এক সমান ভালোবাসা যায় না।
একজন শিক্ষকের প্রতি আমার হৃদয়ের টানও একটু বেশি ছিল। আমি ছিলাম তাঁর প্রথম ছাত্র। এটা জানতে পেরেছি তাঁর ডায়েরীর পাতা থেকে। আমার সম্পর্কে তিনি নিজ ডায়েরিতে লেখেন, ‘অনেকদিন পর আবার রোজনামচার পাতায় লিখতে বসলাম। তাও নিজের কথা লেখার জন্য নয়। আমার প্রথম ছাত্রের কথা লিখতে। আজ তার কিতাব পড়ার দেড়-দু বছর হয়ে গেছে। আলহামদুলিল্লাহ, এই সময়গুলোতে আমি যেমন মেহনত করেছি, সে-ও মাশাআল্লাহ উন্নতির সিঁড়ির দিকে এগুচ্ছে। আল্লাহ আমাদের মেহনত ব্যর্থ করেন নি।’ যেদিন ডায়েরির এই লেখাটি পড়েছিলাম সেদিন হৃদয়ে অপার্থিব এক আনন্দের পুলক অনুভব করেছিলাম। তিনি যদি আমার জীবনে না আসতেন হয়তো আমার ছাত্রজীবন অন্যরকম হতে পারত। তিনি এসে আমার জীবন-তরীর হাল ধরলেন। এই তরী কখনো ঝড়ের মুখে পড়েছে। কখনো ঢেউয়ের তোড়ে গড়িয়েছে। ভয়ে মাঝে মাঝে শিউরে উঠেছি। যদি মাঝ দরিয়ায় আমার জীবন-তরী ডুবে যায়? কিন্তু তিনি ছিলেন শান্ত ও স্থির। তিনি আমাকে অভয় দিতেন, সাহস জোগাতেন।
প্রতিটি মুহূর্তে আমাকে দূরের বন্দরের আলোবিন্দুর দিকে ইঙ্গিত দিতেন। আমার জীবনের যত সাফল্য সব তাঁর অনন্য কৃতিত্ব। যত ব্যর্থতা সবই আমার নিজস্ব দুর্বলতার ফল। হৃদয়ের সবুজ পাপড়িতে এখনো গেঁথে আছে সেই সাফল্যমÐিত স্মৃতি। তখন আমি ‘নাহবেমির’ পড়ছি। আমার সব শিক্ষকের হৃদয়ের একান্ত বাসনা ছিল, আমি বৃত্তি পাব। সবচেয়ে যিনি আশাবাদী ছিলেন তিনি হলেন আমাদের দায়িত্বশীল শিক্ষক শ্রদ্ধেয় মুহাম্মদ হাবিবুল্লাহ। তিনি আমাদের আশার বাণী শোনাতেন। তিনি হাতে কলমে আমাদের দেখিয়েছেন সাফল্যের পথরেখা। কড়া শাসনে হাতে তুলে দিয়েছেন সফলতার সোনালি চাবি। তাঁর থেকে শিখেছি হৃদয়ের উদারতা, ভাষার মাধুর্য, ভাবনার প্রসারতা। তিনি আমাকে মনের মতো করে গড়ে তুলতে লাগলেন। আমিও মেহনত করতে থাকলাম। দেখতে দেখতে বছর শেষ প্রান্তে। পরীক্ষার আর মাত্র এক মাস বাকি। কিন্তু ‘ললাটের লিখন, কে করিবে খÐন?’ হঠাৎ অসুস্থ হয়ে গেলাম। খোদায়ি ফয়সালা অম্লান বদনে মেনে নিতেই হয়। কিতাব অধ্যয়ন তো দূরের কথা, কিতাব খুলে বসার শক্তিও ছিল না। দিলে অসহনীয় পেরেশানি ও হতাশার কালো মেঘ জমতে লাগল। এ অসুখ নিয়ে কীভাবে আমি প্রস্তুতি নেব? পরীক্ষা কীভাবে দেব?
সপ্তাহ দুয়েক শয্যাশায়ী ছিলাম। আশার প্রদীপ উজ্জ্বল হয়ে জ্বলে ওঠার আগে নিভু নিভু করে নিভে যাওয়ার সংকেত দিচ্ছে। এই সঙ্গিন মুহূর্তে, এই হতাশার ঘোর অন্ধকার নিশীথে তিনি এলেন আমার ধ্রæবতারা হয়ে। এক সপ্তাহে তিনি আমাকে পরীক্ষায় ‘লড়া’র মতো তৈরি করে তুললেন। পরীক্ষার শেষ পর্যন্ত তিনি তাঁর সবটুকু বিলীন করে আমাকে নিয়ে সর্বাত্মক চেষ্টা করে গেলেন। আলহামদুল্লিাহ! আমার মনের গোপন কুঠিরে সযতেœ লালিত স্বপ্ন বানচাল হয়নি। আমাকে নিয়ে শেষ চেষ্টা করা মানুষটির চেষ্টা কিছুটা হলেও সার্থক হয়েছে। আমার শিক্ষকের শ্রম বৃথা যায়নি। তাঁর শুভ্র মুখে একটু হলেও হাসির ঝিলিক খেলেছিল। আমি বৃত্তি পেয়েছিলাম। মেধাতালিকায় সেরা বিশে স্থান করে নিয়েছিলাম। আমার সেই প্রিয় শিক্ষক হচ্ছেন আমার শ্রদ্ধেয় বড় ভাই মুহাম্মদ সাজ্জাদ কাসেমি। আমার ভাই আমার রাহবার, আমার অভিভাবক।
তিনি আছেন বলেই আমার কাছে পৃথিবী এখনো এত সবুজ। তাঁর স্নেহছায়ায় রয়েছি বলেই আকাশ এত নীল। তাঁর ভাবনায় থাকি বলেই প্রকৃতি এত মনোহর। তাঁর মমতায় ডুবে আছি বলেই সমুদ্র এখনো এত গভীর। তাঁর স্নেহছায়া আর দোআর ফলেই জীবনের শত অস্থিরতার মধ্যেও আমি এতটা প্রশান্ত, স্নিগ্ধ ও সুধীর। তাঁর শাসনের চাদরে আবৃত বলেই আমার জীবন ছন্দময়, আলোময়।
মহান প্রভুর দরবারে আকুল ফরিয়াদ, তিনি যেন আমাকে তাঁর স্নেহ ও শাসনের ছায়াতলে রাখেন সারা জীবন। তাঁর প্রতিটি পথনির্দেশনা যেন আমি অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতে পারি।
আমার শ্রদ্ধেয় সকল শিক্ষককে যেন উভয় জাহানে উত্তম প্রতিদানে ভূষিত করেন। তাঁদের দোআ যেন আমার জন্য সব সময় ছায়া হয়ে থাকে। আমিন।
জুন ২০১৮