আহমদ ছফা ‘যদ্যপি আমার গুরু’ লিখে জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাককে শিক্ষক হিসেবে যেভাবে উপস্থাপন করেছেন, প্রিয় শিক্ষকের অমন চিত্র আমাদের দেশে মনে হয় আর কেউ ওভাবে আঁকতে পারেননি।
পৃথিবীতে যে স¤পর্কটা সবচেয়ে গভীর, নিরেট এবং দীপ্ত প্রেমময় সেটি বোধকরি ছাত্র এবং শিক্ষকেরই। পবিত্র এ সম্পর্কে কোনো ভণিতা নেই। শঠতা নেই, নেই কোনো মোহও। কোনো পার্থিব আকাক্সক্ষায় একজন প্রকৃত শিক্ষক কখনোই তাঁর ছাত্রদের পাঠ দেন না। জ্ঞান বিতরণের এ হৃদ্যিক প্রেমময় সেতুবন্ধনে শুধুই শুদ্ধির অবগাহন।
আমি ছাত্র। এই জগত, প্রকৃতি, স্রষ্টা এবং নিজেকে চেনাতে যাঁরা আমাকে শিখিয়েছেন, যাঁরা আমাকে জ্ঞান দান করেছেন তাঁদের উপচানো ভাÐার থেকে, তাঁরা সকলেই আমার গুরুজন। আমার সমস্ত কিনে নেওয়া কুশলী খরিদ্দার। তাঁরা আমার পরম শ্রদ্ধেয়। আমার নিবেদিত আত্মার মহাজন। তাঁদের সঙ্গে জমে আছে আমার কথা, আকুল মনের নিশ্চুপ আবেদন। তবে আমার হৃদয় একজন গুরুর কাছে জীবনভর নিবেদন করে গেছে সমস্ত অভিপ্রায়, আবেগ, অনুরাগ; কখনো প্রকাশ্যে কখনো অনুভবে। চুপটি করে যখন বসে থাকি, জীবনের গলিপথ ধরে যখন হেঁটে যেতে চাই কোথাওÑকোনো লক্ষ্য অথবা ইচ্ছের শেষটায়, বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে সবচেয়ে বেশি অনুভব করি তাঁকেই। আমার মন বলে ওঠেÑআমি তাঁকে ভালোবাসি। এ মানুষটিই আমার প্রিয় শিক্ষক।
যদি গল্প বলি, ছবি আঁকি তাঁর, তাহলে কেমন লিখতাম? কতটুকু আবেদন মেখে আঁকতে পারতাম তাঁর ছবি এ আমার বোধে আসে না। মনে পড়ে, মফস্বল থেকে সেই কবে যেন ঢাকা এলাম। আমার গ্রাম, জলডোবা পুকুর। পাটের সবুজ বিল, ভরা বর্ষা আর বহতা পদ্মার ঢেউয়ের কলস্বর আমার থেকে কত দূর যেন চলে গেল। এই শহর, ইট-পাথরের দালানে গুমোট হয়ে থাকত আমার মন। এখানে পাখির কুজন নেই। শালিক, গাঙচিল, বকের উড়ে যাওয়া দেখি না কত কাল। পাড়াগাঁয়ের উচ্ছল মনটা একদম নেতিয়ে থাকে সমস্ত সময়। আমার ভালো লাগে না। কোথায় আমার সেই পলিমাটির গন্ধ। কারও নুপুরের ছাপ। এসব ভেবে ছাত্রদের থেকে আলাদা হয়ে গুটি মেরে বসে থাকতাম এককোণে। ক্লাসের পড়াটুকু যাÑবাকি সময় কেটে যেত ভাবনায়, গ্রামের পথে হেঁটে হেঁটে।
বই কী? বই পড়লে কী হয়? পৃথিবীকে জানা, নদী, পাখি, পুকুর আমার সেই গ্রামÑসবটাই যে বইয়ে পাওয়া যায়, জানতাম না তখনও। জানতাম না বই পড়ে লেখা যায় কত কী! কিন্তু পুরো মাদরাসায় একজন মানুষকে দেখতাম দিনভর গাদাগাদা বইয়ের মধ্যে ডুবে থাকতেন তিনি। তাঁর থাকার ছোট্ট রুমটি ছিল আমাদের পাশেই। রাতদুপুর ছাত্রদের ভিড় লেগেই থাকে। কেউ আসে, কেউ যায়, কেউ কথা বলে, কেউ হাসে, কেউ কাঁদেÑসব কিছু বই নিয়ে। বইয়ের বিভিন্ন পাতা থেকে কী সব লিখে লিখে মুখস্থ করতেন। বড় ছাত্রদের ক্লাস করাতেন তিনি। আড্ডায় ছাত্ররা বলত, হেন বিষয় নেইÑযা মানুষটার অজানা। সবাই তাঁর কাছে যেত। তাঁর দীপ্তিভরা দু’টো চোখ মনে হয় স্বপ্নই বুনে দিত। নইলে অমন হুলস্থুল কেন ছাত্রদের!
একদিন হলো কী, চুপিচুপি তাঁর রুম দেখতে গেলাম। ভেবেছিলাম তিনি রুমে নেই বোধহয়। ও মা, উঁকি দিতেই দেখি নিবিষ্ট মনে লিখছেন। আমার চুপিচুপি উঁকি দেওয়া দেখে ফেললেন। ডাক দিলেন, ‘এই ছেলে, কী খবর তোমার? কেমন আছ? কি পড়ছ আজকাল?’ এই ছিল একান্ত আমাকে তাঁর প্রথম সম্বোধন। এক সঙ্গে অনেকগুলো প্রশ্ন। এরপর কাছে টেনে বসালেন। আমি গল্প করতে ভালোবাসি টের পেয়ে গল্প করলেন মন খুলে। উঁচু তাক থেকে এতগুলো গল্পের বই নামিয়ে দেখালেন। ‘এটা সুন্দর বই। ‘এখানের গল্পগুলো ভারি চমৎকার। পড়ে দেখো ভালো লাগবে।’ সামনে মোটা মোটা আরবি বই-পুস্তকে ভরা মানুষটার। তিনিই আবার ধূলো ঝেড়ে মেঝ থেকে নামচ্ছেন কোনকালে তুলে রাখা গল্পসম্ভার। এমন পÐিত লোকটাই কিনা মুহূর্তে বাৎসল্যপনায় জড়িয়ে গেলেন। হাদিসের মসনদে বসা গুরুগম্ভীর শিক্ষকটিই হয়ে উঠলেন গল্পের গুরু। তাঁরাই কি বেঁচে থাকেন আমাদের ভেতর-বোধে? তারপর অনেক কথা, অজস্র স্বপ্নের সুরম্য সৌধ নির্মাণ করে দিলেন আমার চোখের শার্সিতে। আখেরে ‘মণির পাহাড়’ (বিশ্বের বিখ্যাত সব গল্প সমগ্র) বইটা দিয়ে বললেন, ‘পড়ে জানিয়ো।’
সেই শুরু। তারপর এই আজ অবধি। ছাত্রজীবনে সবচেয়ে বেশি কিতাব/বই পড়েছি তাঁর কাছেই। আমাকে শব্দ থেকে বাক্যে জোড়া, বাক্য থেকে কবিতার ছন্দালাপ, কথা থেকে গল্পের বুননÑসবটাই শিখিয়েছেন তিনি। হ্যাঁ! আমি পারিনি বা কতটুকু পেরেছি সে ভিন্ন কথা।
পাঠক, লেখাটা মাত্র শুরু করেছি। বলতে পারেন, ভূমিকাতেই আছি এখনও। কিন্তু এইখানে এসে আমি আর লিখতে পারছি না। প্রচÐ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছি। অনেক অনেক কিছু, অনেক স্মৃতি, গল্প, মূল্যায়ন আর কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য আমি লিখতে বসেছিলাম। কলম যে আর এগুচ্ছে না! এ কি আমার দোষ? জানি না। হয়তো দোষ। কিন্তু তাঁকে নিয়ে আমার বিস্তর লেখার আছে। যে লেখার হয়তো সমাপ্তি হবে না এক জীবনে।
কবি ও জ্ঞানতাপস মাওলানা ফয়জুল্লাহ আমান কাসেমি। তিনিই আমার জ্ঞানের পরমেশ, আমার প্রিয় শিক্ষক।
জুন ২০১৮