মিশরে তখন চরম দুঃসময়। জামাল আব্দুন নাসের ক্ষমতার মসনদে। খেদিভ শাসকদের দৌরাত্ম্যে বহুদিন থেকেই দিশেহারা মিসরবাসী। একদিকে অন্যায়-অত্যাচার, অন্যদিকে সেকুলারিজম ও ধর্মহীনতা। এরমধ্যেই নিভৃতে কাজ করে যাচ্ছিলেন শহীদ হাসানুল বান্নার অনুসারীরা। এইসময় ঘটে মানশিয়ার ট্রাজেডি। ইতিহাসের পাতায় তখন ১৯৫৪ সাল। আলকজান্দ্রিয়ার এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য প্রদান করছিলেন মিশরের প্রধানমন্ত্রী জামাল আব্দুন নাসের। হঠাৎ পিস্তল বের করে তাঁর ওপর গুলিবর্ষণ করে এক ব্যক্তি। সেদিন কপালে মৃত্যু লেখা ছিল না জামাল আব্দুন নাসেরের। সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান তিনি। ধরা পড়েন আব্দুল লতিফ নামের সেই ব্যক্তি।
তদন্তে জানা যায়, তিনি ইখওয়ানুল মুসলিমিনের বিশেষ স্কোয়াডের সদস্য। ইখওয়ানই তাকে পিস্তল ও গুলি সরবরাহ করেছে। তাদের নির্দেশে এই দুঃসাহসিক কাজ করতে সূদুর কায়রো থেকে এসে আলেকজান্দ্রিয়ায় হাজির হয়েছিলেন আব্দুল লতিফ।
আগে থেকে এমনিতে সরকারের সমালোচনা ও জনগণকে সরকারের বিরুদ্ধে উসকে দেয়ার অভিযোগ ছিল ইখওয়ানের বিরুদ্ধে৷ এবার তাদের পাকড়াও করার উপযুক্ত কারণ পাওয়া গেল। আর যায় কোথায়? এক এক করে শীর্ষ নেতাদের জেলে পুরতে শুরু করে জামাল আব্দুন নাসেরের স্বৈরাচারী সরকার।
ইখওয়ানের পক্ষ থেকে অবশ্য ভিন্ন বক্তব্য দেয়া হয়। ইখওয়ানের প্রধান নেতারা বলেন, এর দায় ইখওয়ানের নয়। অভিযুক্ত ব্যক্তি আগ বেড়ে এই কাজ করেছেন। কোনো মুসলিমের রক্ত দিয়ে হাত রঞ্জিত করার কথা ভাবতেও পারে না ইখওয়ানুল মুসলিমিন।
কিন্তু কে শোনে কার কথা! নির্বিচারে জেলে বন্দী করা হয় নেতাদের এবং তাদের ওপর নেমে আসে নির্যাতনের খড়গ। সেই সময় আটক হওয়া বন্দীদের একজন উস্তাদ কামাল আস সানানিরি।
কামাল আস সানানিরিকে পাঠকদের কাছে আগে পরিচয় করিয়ে দেয়া দরকার। আমাদের আজকের গল্প তাঁকে নিয়েই।
এমন ত্যাগী ও মহান মানুষ জন্মান না সব দেশে সবসময়। ১৯১৮ সালে মিসরের আসিয়ুতে জন্ম নেয়া কামাল আস সানানিরি তাঁর পুরো জীবন সঁপে দিয়েছিলেন দ্বীনের পথে।
জীবনের প্রথমভাগ বেশ ভালোই কাটছিল তাঁর। উচ্চমাধ্যমিকের পাঠ শেষ করে কয়েকবভহর সরকারি চাকরিও করেন। এরপর চাকরি ছেড়ে দিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণের৷ ফার্মাসিস্ট বাবার মেধাবী ছেলে ফার্মাসিস্ট হয়ে বাবার ঔষধালয়ে কাজ করবেন এই ছিল স্বপ্ন।
এর মধ্যে ইখওয়ানুল মুসলিমিনের সাথে পরিচয় ঘটে কামাল আস সানানিরির। নিজেকে ইখওয়ানের জন্য এতটাই সঁপে দিয়েছিলেন যে নিজের জীবনটাই উৎসর্গ করে দেন ইখওয়ানুল মুসলিমিনের জন্য।
১৯৫৪ সালের মানশিয়ার ট্রাজেডির পর ইখওয়ানের অন্যতম নেতা হিসেবে কামাল আস সানানিরিকেও গ্রেফতার করা হয়। বিচারে তাকে ফাঁসির রায় দেয় আদালত৷ যেহেতু ফাঁসির আসামী তাই মৃত্যুর আগেই তার স্ত্রীকে তালাক দেয়ার নির্দেশ দেয় আদালত।
একদিকে অন্যায় ফাঁসির রায়। তার সাথে আবার প্রিয়তমা স্ত্রীকে ত্যাগ করার নির্দেশ। স্ত্রীর পরিবারের লোকেরাও ইখওয়ানের সাথে সংশ্লিষ্ট। স্ত্রীর বড় ভাই এবং কামাল সানানিরি তো একই সেলে বন্দী ছিলেন। সরকারের নির্দেশে কামাল সানানিরি তার স্ত্রীকে ইচ্ছাধিকার দেন। চাইলে বিবাহবিচ্ছেদ অথবা এভাবেই থাকা। স্ত্রী দ্বিতীয়টি বেছে নেন। কিন্তু কোনো কারণে পরিবারের চাপে বিবাহবিচ্ছেদ করতে হয়।
কামাল সানানিরির জীবনে তখব ঘোর অন্ধকার৷ একদিকে ঝুলছে ফাঁসির রশি। যেকোনো সময় জীবনের আলো নিভে যাবে। এরমধ্যে স্ত্রীকেও ছাড়তে হলো। কে জানত তাঁর জন্য আল্লাহ অন্য কিছু রেখেছিলেন। কে জানত আবারও আশার আলো জ্বলে ওঠবে তাঁর জীবনে!
বিবাহবিচ্ছেদের কয়েকদিন পর নতুন আদেশ দিল আদালত। ফাঁসির সাজা মওকুফ করে বিশ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হলো তাঁকে। কারাদণ্ড দেয়া হলেও তাঁর মুক্তির জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন ইখওয়ানুল মুসলিমিনের নেতৃবৃন্দ। বিনা অপরাধে এমন দীর্ঘ সাজা তো কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না।
কামাল সানানিরিও আশায় বুক বাঁধেন। এভাবে কেটে যায় অনেকবছর। এরমধ্যেই কারাগারের হাসপাতালে তাঁর সাথে সাক্ষাত হয় সাইয়েদ কুতুবের। তাঁরই সহোদরা আমিনা কুতুবের জন্য বিয়ের প্রস্তাব দেন উস্তাদ কামাল আস সানানিরি।
পঁচিশ বছরের সাজাপ্রাপ্ত মধ্যবয়সী একজন রাজবন্দী। অন্যদিকে মিসরের বিখ্যাত লেখক সাইয়েদ কুতুবের বোন আমিনা কুতুব। নিজেও দেশসেরা লেখিকা এবং কবি। ত্রিশের কোঠায় বয়স। তাঁকে বিয়ে করতে উদগ্রীব এবং যুবকের অভাব নেই। একজন মধ্যবয়সী বন্দীকে বিয়ে করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।
কিন্তু সবাইকে অবাক করে আমিনা কুতুব সানন্দে গ্রহণ করলেন এই প্রস্তাব। কারাগারের বাইরে, মুক্ত পৃথিবীতে বিচরণকারী অল্পবয়সী নারী। তিনি বর হিসেবে নির্বাচন করলেন কারাগারের ভেতরে থাকা উস্তাদ কামাল আস সানানিরিকে। তখনো তাঁর প্রায় সতের বছরের সাজা বাকি। দুজনের আকদ সম্পন্ন হয়। আমিনা কুতুব কারাগারে এসে কামাল সানানিরির সাথে দেখা করেন। চিঠি লিখেন। কারাগারের প্রাচীরের আড়াল থেকেই ফুটতে শুরু করে নবদম্পতির ভালোবাসার ফুল।
আমিনা কুতুব স্মৃতিচারণ করেছেন সেই সময়ের। “কামাল সানানিরি প্রস্তাব আমার জন্য ছিল বিরাট এক চ্যালেঞ্জ। আমি নিজেকে উৎসর্গ করেছিলাম দ্বীনের পথে৷ তাই আমার যৌবনকে ত্যাগ করতে পেরেছিলাম। ”
দিন যেতে থাকে। কামাল সানানিরির বন্দীজীবন শেষ হয় না। প্রেয়সী স্ত্রীর সাথে মিলনের অপেক্ষায় সতের বছরের অপ্রক্ষা আরও দীর্ঘ হয়ে আসে। কামাল সানানিরি অধৈর্য হয়ে ওঠেন। তীব্র ভালোবাসেন আমিনা কুতুবকে। এভাবে চোখের সামনে তাঁর জীবনের সোনালী সময় কেটে যাচ্ছে। কারাগার থেকে যখন তিনি বের হবেন ততদিনে আমিনা প্রৌঢ়া হয়ে যাবেন।
প্রচণ্ড ভালোবাসা থেকেই অনুশোচনা জন্মে কামাল সানানিরির মনে।
একদিন আমিনাকে তিনি বলেন এ অনুশোচনার কথা।”তুমি চাইলে নিজের জন্য যা ভালো মনে করো তা বেছে নিতে পারো। অনেক সময় পার হয়েছে। আমার এ বন্দীদশা শেষ হবার নয়। এভাবে হয়ত আমার মৃত্যু হয়ে যাবে। তোমার সুন্দর জীবন আমি ধ্বংস করতে পারি না।”
আমিনা সেদিন খুব তিরষ্কার করতে চেয়েছিলেন স্বামীকে। কিন্তু সাক্ষাতের সময় শেষ বলে প্রহরী তাকে ফিরিয়ে দেয়৷ কোনো কিছু না বলেই তাকে ফিরে হয় সেদিন।
কামাল সানানিরি সেদিন কী ভেবেছিলেন? অন্ধকার কারাপ্রকোষ্ঠে বসে নিশ্চয়ই অপেক্ষা করছিলেন বিদায়ী বাণীর।
ওদিকে আমিনা কুতুব মর্মাহত হয়ে ফিরে যান৷ মনটা তার বিষিয়ে গেছিল খুব। একে তো এমন কথা তার স্বামী বলবেন তা ভাবনায়ও আসে নি৷ তার ওপর কিছুই বলে আসতে পারেন নি। না জানি স্বামী ভেবেছেন আমিনা হয়ত আগের স্ত্রীর মত নিজের পথ বেছে নিবেন।
আমিনা চিঠিতে জবাব লিখলেন কবিতায়। ‘দৃঢ়তার পথ বেছে নিয়ে ছি আমি, যে অঙ্গীকার করেছিলাম দুজনে….”
আমিনার এ জবাব শুনে কামাল সানানিরির কাছে বন্দী জীবনের দুঃখ অনেকটাই ম্লান হয়ে যায়। কারাগারের লৌহ শেকলে আবদ্ধ থেকেও ভালোবাসার অসীম সাগরে নিজেকে অনুভব করতে পেরেছিলেন তিনি।
এই কবছরে এমন বহু কবিতা লিখেছেন আমিনা। জীবনের প্রথমদিকে গল্পই লিখতেন বেশি। মিসরের সেরা পত্রিকাগুকোতে ছাপা হত সেসব গল্প। এরপর হঠাৎ অনুভব করলেন হৃদয়ের কোণে কবিতার ঝরনাধারা৷ স্বামীর প্রতি ভালোবাসা ও আবেগকে প্রকাশ করা এবং পাশাপাশি অতাচারী শাসকের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য এর চেয়ে মোক্ষম আর কোনো অস্ত্র ছিল না তার কাছে।
আমিনা কুতুবের সেসব কবিতা মলাটবদ্ধ হয়েছে ‘শহীদের কাছে চিঠি’ নামে। স্বামীর বিরহ ও শোকে লেখা কবিতাগুলোর আছে এই গ্রন্থে। আছে আপন ভাই সাইয়েদ কুতুবের শাহাদাতের পর লেখা কবিতাও। আরবি সাহিত্যের সম্পদে আমিনা কুতুবের কবিতাগুলো এক অনন্য সম্পদ৷ কারণ স্ত্রীদের জন্য লেখা অনেক শোকগাঁথা পাওয়া যায় আরবি সাহিত্যের ইতিহাসে। কিন্তু স্বামীর জন্য শোকগাঁথা এভাবে আর কোনো মহিলা কবি লিখে যান নি।
আমাদের গল্প কিন্তু এখানে শেষ হয় নি। কামাল সানানিরি ও আমিনা কুতুবের অপেক্ষার পালা শেষ হয়। দীর্ঘ সতের বছর পর মিলন হয় তাদের। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তারা সুখের সংসার গড়েন। এর মধ্যে কামাল সানানিরি তাঁর দাওয়াতি কার্যক্রম চালিয়ে যান। আরব বিশ্বের নানা দেশ ভ্রমণ করেন। আফগান জিহাদে বিশেষ অবদান রাখেন৷ আফগান জিহাদের সময় তালেবান ও অন্যান্য মুজাহিদদের মধ্যে যে দ্বন্দ দেখা দেয় তা নিরসণে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করেন কামাল আস সানানিরি।
দুঃখের পর সুখ আসে। তাই সুখ এসেছিল আমিনা-কামাল দম্পতির জীবনে। কিন্তু সুখের পর আবার দুঃখ আসতে পারে কে জানত সে কথা? ১৯৭৪ সালে মুক্তির পর ১৯৮১ সালে আবারও তাঁকে গ্রেফতার করে আনোয়ার সাদাতের সরকার৷ আমিনা কুতুবের জীবনে আবারও বিরহ নেমে আসে। সওয়ামীর বিরহে তিনি রচনা করেন তাঁ্র বিখ্যাত কবিতা ‘আবার কি দেখা হবে?’। আরব অনেক শিল্পিই কবিতাটি গেয়েছেন সুর দিয়ে। মর্মভেদী কবিতাটি শুনলে এখনো যে কারও চেওখবভিজে ওঠে। জেলে নেয়ার পর কামাল সানানিরির আবারও চলে নির্যাতন। বয়সের ভারে এমনি ন্যুজ কামাল সানানিরি। নির্যাতনের ভার সইতে না পেরে জেলখানায় মৃত্যু হয় তার।
সরকারি নির্দেশে তাঁর মৃত্যুকে ধামাচাপা দেয়া হয়। ঘোষণায় বলা হয়, কামাল সানানিরি জেলখানার গোসলখানায় রশি ঝুলিয়ে গলায় ফাঁস দিয়েছেন। মৃত্যুর আগে দেয়ালে লিখেছেন, “এ জীবন থেকে আমি নিরাশ হয়ে গেছি”।
তাঁর মৃতদেহে অসংখ্য নির্যাতনের চিহ্ন পাওয়া যায়। আমিনা কুতুব তাঁকে গোসল না দেয়ার অনুরোধ করেন। স্বামীর শোকে তিনি রচনা করেন মর্সিয়া।
বিশ্ববাসীর কাছে, বিশেষ করে মিশরের ইখওয়ান কর্মীদের কাছে আমিনা-কুতুব দম্পতির ভালোবাসার গল্প এক অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। হুসনি মুবারক কিংবা এখনকার সিসির আমলে ইখওয়ানের হাজার হাজার কর্মী শহীদ হয়েছেন। বিনা বিচারে বন্দী আছেন আরও বহু কর্মী। আমিনা কুতুবের কবিতাগুলো তাদের জন্য প্রেরণা হয়ে আছে।
নবধ্বনির পাঠকদের জন্য এই লেখাটি যখন লিখছি, তখন মনে পড়ছিল ‘লাভ জিহাদে’র কথা। সন্ত্রাসীদের শয্যাসঙ্গী হওয়ার জন্য দেশ ছেড়ে এসেছিল কত শত তরুণী। শয্যাসুখ না পেলে মুজাহিদদের কষ্ট হবে এজন্য তারা এই মহান জিহাদে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। আমিনা কুতুবের ত্যাগ ও কুরবানি নিশ্চয় এসব গল্পের কাছে লজ্জায় মাথা হেঁট করে।
পুনশ্চঃ কামাল সানানিরির মৃত্যুর রহস্য আজও সমাধান হয় নি। আল জাজিরা এ বিষয়ে অনুসন্ধান করেছে। কামাল সানানিরির সহবন্দীরা জানিয়েছেন, মৃত্যুর আগের তাঁকে জেল থেকে বের করে অন্য কোথাও নেয়া হয়েছিল। তাঁর মত মহান মানুষ আত্মহত্যা করবেন এটা তাঁর শত্রুরাও বিশ্বাস করবে না। তাছাড়া জেলখানায় আত্মহত্যা করার মত রশিও ছিল না। হুসনি মুবারকের আমলে ইখওয়ানের সাথে একরকম সমঝোতা হয় সরকারের। নির্বাচনের মাধ্যমে পার্লামেন্টেও স্থান পান কয়েকজন। এভাবে অতি আশ্চর্যজনকঅভাবে অমীমাংসিত থেকে যায় এই মহান ব্যক্তির মৃত্যুরহস্য। ২০০৭ সালে আমিনা কুতুবও পরপারে চলে যান।