কোথাও কেউ নেই। অন্তত এক মাইলের ভেতরে একটা পাতার নড়াচড়াও নেই। গা ছমছম নীরবতা যাকে বলে। তরতর করে হাঁটছি। তরতর করে আঁধারও এগুচ্ছে। আস্তে আস্তে ছাইরঙ জলের ভেতর চারদিকের গাছপালা ডুবছে।
আস্তে আস্তে তিনিও এগুলেন। চাঁদ। এখন আর আঁধার নেই। আঁধার যতো ঘন হচ্ছিলো জোছনা ততো গলছিলো। যেন মোম আর আগুন। তবে পথও ততো দুর্গম হচ্ছে।
ছোট্ট বন। তারপর বহুদূর বিস্তৃত কিছু জমি। বন পেরুতেই পেছন থেকে বিপদ বিপদ কণ্ঠে কারো কান্না মেশানো ডাক। তারপর স্পষ্ট কেউ কাঁদলো। যতো যাচ্ছি কান্নার আওয়াজ অবশ্যি ছোট হচ্ছে। কিন্তু করুণ হচ্ছে। আমার অন্তরে বিঁধছে। আমি কষ্ট পাচ্ছি। ভীষণ।
তবু যাচ্ছি। সে ভয় পাচ্ছে। তার ভয়কে আমি ছুঁড়ে মারছি। যেতে তো হবেই। হাঁটতে থাকো। পেছনে তাকিও না তো!
তখন আকাশের গোটা শরীরটা দুধের সমুদ্রচর। নুহাশের বাবার ভাষায়Ñ ‘উথাল পাথাল জোছনা।’
ঈষৎ সাদা বাতাস। বাতাসের চাপড়ানো ওর ভালো লাগছিলো। কিন্তু আরেকটু যাওয়ার পর আর বাতাস নেই। সে পা টিপে টিপে হাঁটছে।
যাচ্ছি। দেখলাম দূরের গাঙ পাড়ে কাশফুল আর কুয়াশার সরল আলিঙ্গন, পাশে ছোট্ট একখানা ডিঙি নৌকা। নৌকার গলুই ভর্তি জোছনা। ঝিলমিল ঝিলমিল করছে। সে মুখ ভরে হাসছে।
বিবর্ণ ভয়ার্ত ফ্যাকাশে একটা চেহারায় হাসির দাগ বড় নিñিদ্রভাবে লেপ্টে আছে। শিল্পকলা হলো প্রকৃতি থেকে অসীমের দিকে যাওয়ার একটা সিঁড়ি । আমার মনে হয় সে ওই সিঁড়ি ধরে কোথাও যাচ্ছে। হাসতে হাসতে ফেটে পড়ার উপক্রম। থামালাম। একটু জিরিয়ে নিই?
সে মাথা নেড়ে বললোÑ ‘না, আমি না, আপনি জিরান। আর আমি পেছন দিকে একটু যাই। গিয়ে চিৎকার করে কাঁদি। মনে করুন আমরা রোহিঙ্গা। আপনি আমার স্বামী, আমাকে ওরা…! আমার চিৎকার শুনে আপনি কী করবেন?’
‘আমি জান বাঁচিয়ে পালাতে থাকবো।’ জবাব দিই আমি। ‘কারণ আমি ষোলোর বাঙালি। আমি পালাতে শিখেছি। দু’হাজার ষোলো সালের বাঙালিরা পালাতে শিখেছে।’
কথাটা শুনে সে একটুও দুঃখ পায়নি। কারণ আমি নাকি সত্যকথাই বলেছি। সে স্বচক্ষে দেখেছে অসংখ্য পুরুষ তার নির্যাতিতা বিপদগ্রস্ত মা-বোন-স্ত্রীদের রেখে পালাচ্ছে।
তারপর সেও কাঁদছিলো। বাঙালি আমিও।
© 2021 নবধ্বনি - Developed by Shabaka IT