চাটগাঁর ছেলে চাটগাঁর মৃত্তিকাতলেই শায়িত হলেন শেষমেষ৷ প্রাণের আঙিনায়৷ বেড়ে ওঠা ও সমৃদ্ধির নিকেতনেই শেষশয্যার আখেরি বন্দোবস্ত করে নিলেন তিনি৷ অথচ তাঁর বিশ্বপ্লাবী বিজয়কাহিনি মুখে মুখে ফুটছে খৈয়ের মতো। তাঁর আলোময় দীর্ঘ জীবনের ভাবনা আমাদের তাড়িয়ে নিয়ে যায় তাঁর শ্রম, সাধনা ও ইলম-ভাবনার বলিষ্ঠ বটবৃক্ষতলে। শতবর্ষী এই মানুষটাই তো একসময় অনালোচিত ছিলেন; আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম তো দূরের কথা আঞ্চলিক পত্রিকাগুলোরও সংবাদশিরোনাম হতেন না। কেবল মাদরাসা, ছাত্র-শিক্ষক ও পরিবার—এই তিন গণ্ডির ভেতরেই আবদ্ধ রাখতে চেয়েছেন নিজেকে। বাইরে ঘুর ঘুর করে অন্যদের মতো নিজের ‘ফর্মালিন পরিচয়’ বিকশিত হোক—চাইতেন না কখনো। ঘরকোণো নিমগ্নতাকে শ্রেয়তর জানতেন। শুধু শুধু অফলপ্রসূ মিটিং-মিছিলে নিজে তো যেতেনই না। অন্যদেরও বলতেন—‘মাত যাও’। বাইরে যেতেন না। যাওয়ার প্রয়োজনও ছিল কই? প্রচলিত রাজনীতির ভ্যাপসা গরম থেকে তিনি ‘লা হাওলা ওয়ালা কুওয়্যাতা’ দূরে ছিলেন। আত্মধ্যান, জ্ঞানচর্চা, তাসাউফ ও সুলূকের স্বর্ণোজ্জ্বল পথে লিওয়াজহিল্লাহ ছুটে বেড়িয়েছেন আমরণ। রাজনীতি না করেও এ দেশের রাজনীতিবিদদের সাথে বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনে বিজয়ী তো হয়েছেনই, দেশের আপামর জনতার চোখের মণিতে পরিণত হয়েছেন। একজন আহমদ শফীর ক্ষীণতর আহ্বান ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল ছাপিয়ে সুদূরের আরব বসন্তের জন্মভিটায়ও তরঙ্গায়িত হয়েছে। যদিও মিশরের আল-হামরাসহ কোনো কোনো আরবনিউজ শাপলার আন্দোলনকে জামায়াতের আন্দোলন বলে প্রচার করেছে। সেখান থেকেই আহমদ শফী রাজনীতিবিদদের রোষানলে পড়ে গেলেন এবং ‘জামাতি জামাতি’ বলে গালিও কম খাননি। যে জামায়াত ইসলামি ব্যানারে গণতন্ত্রের সুরে সুরে এগিয়ে যাচ্ছিল। গণতন্ত্রের রাজনীতি মূলত ‘তথ্য গোপন’ ও সব কিছু জেনেও ‘জানি না’র ভান ধরার রাজনীতি। আল্লামা আহমদ শফী এটা বুঝতে পেরেছিলেন শতভাগ। কারণ দেওবন্দে পড়াকালে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের কার্যপ্রণালী, সংগঠনের উত্থান-পতন, সভা-সেমিনারের রিপোর্ট, সর্বোপরি হোসাইন আহমদ মাদানির একান্ত সাহচর্যে ভেতরের সব ‘সিয়াসাতি হুনার’ আত্মস্থ হয়ে গিয়েছিল তাঁর। বিদ্যমান বৃটিশ বেনিয়াদের ভারতশাসন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দুন্ধুমার পরিস্থিতি, সাতচল্লিশে ধর্মের দায়ে দেশভাগ, বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন ও একাত্তরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ তো তাঁর চোখের সামনে ছিল। এ সবই তো বিশ্বরাজনীতির ‘খেলখিলাড়িকা’র কৌশলি ছক ছিল। যদিও প্রত্যক্ষভাবে আল্লামা আহমদ শফী রাজনীতিতে জড়াননি কখনো। তাঁর দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতা হয়তো রাজনীতির সরগরম মাঠে একজন ‘ঝানু অভিনেতা’ হতে বারণ করেছে। তবে ইসলামি রাজনীতির শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। বড় বড় ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলোর দেওলিয়াত্বের মুহূর্তে সবসময় দিলখোলাসা দুআ দিয়েছেন। উত্তর উত্তর সমৃদ্ধি ও দুর্বার সাহসী হবারও মন্ত্র দিয়েছেন। যেমনটা করেছিলেন হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলি থানভি। আমার মনে হয় রাজনৈতিক দুরদর্শিতা ও পলিটিক্যাল সাইন্সের সবরকমের গলিঘুপচির সন্ধান আশরাফ আলি থানভির নাকের ডগায় ছিল। মানতেক, ফালসাফা, ইলমুল কালাম ও সিয়াসাতের আঁতুড়ঘর ছিল আশরাফ আলি থানভির খানকা। তবে প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে বরাবরই দূরে ছিলেন হাকিমুল উম্মত। আর এর বাস্তবরূপ দেখলাম আল্লামা আহমদ শফীর কর্মময় জীবনেও। তিনি শাগরিদ ছিলেন একজন রাজনীতিবিদের, আধ্যাত্মিক সবক নিয়েছেন সেই একই রাজনীতিবিদের নিকট থেকে৷
কিন্তু তিনি কেবল তাঁর আধ্যাত্মিক সবককেই জীবনের আসল ও মৌলিক সাধনা হিসেবে গ্রহণ করলেন, রাজনীতিকে নয়, কেন? প্রশ্ন হতেই পারে। তবে এর সুন্দরতম উত্তর একমাত্র আল্লামা আহমদ শফীই দিতে পারতেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দিয়েছেনও হয়তো। আমরা যদি ব্যাখ্যা করতে যাই, তাহলে নানা কিসিমের ‘বকওয়াস’ ঝাড়তে হবে। কেউ হয়তো তাঁর মূল থিমটা ধরতে পারব কেউ হয়তো পারব না। কিন্তু আলোচনা-সমালোচনা চলতে থাকবে দেদারসে, গতিময়তার সাথে।
তবে এটা বলতেই হবে যে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মদিনাশাসন কোনোভাবেই কল্যাণময় রাজনীতির বাইরে ছিল না। গণতন্ত্র-সমাজতন্ত্র তো ফটকা মাল-মসলা মাত্র। যা স্বার্থান্বেষী মহলের রাতদিন পরিশ্রমের বেফায়দা ফলাফল। কিন্তু নবীজির মদিনা-শাসননীতি সর্বাঙ্গীন কল্যাণময় রাজনীতির মুখ্যদ্বার ছিল। কালের দুর্যোগখ্যাত রোম-পারস্যের সাথে সংঘাত ও ফতহে মুবিনের দিগন্তপ্রসারিত সুশাসন একটা কল্যাণঋদ্ধ রাজনীতি কৌশল ছাড়া কখনোও সম্ভব না। হাল-জামানার ইসলামি চিন্তাবিদগণও বর্জ্যে ভরা গণতন্ত্রের শোষণনীতির ভেতর থেকে মদিনার অনুশাসন তথা খেলাফতের স্বপ্ন দেখে আসছেন বছর বছর ধরে। কিন্তু রাষ্ট্রক্ষমতা যখন বাতিলপূজারি হয় এবং আমলাতান্ত্রিক বৈষম্যমূলক বিধিমালায় আবদ্ধ থাকে, তখন সুদৃঢ় ও স্বচ্ছ জনশাসন প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে ইউরোপের দ্বন্দ্ব-সংঘাতময় কূটশাসনের জন্মলাভ হয়। যেখানে গির্জার বাইবেল-নীতি চার দেয়ালে আবদ্ধ হয়ে পড়ে এবং রাষ্ট্রক্ষমতা চলে যায় স্বার্থবাদীদের কোর্টের ভেতরে। ইউরোপের শিল্পবিপ্লব, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, হিটলারের অগুনতি মানুষের প্রাণহরণ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, সাতচল্লিশের দেশভাগ, ঊনসত্তরের গণঅভ্যূত্থান ও একাত্তরের রক্তঝরা সংগ্রামের মতো মরণপণ লড়াই করতে হয়। কিন্তু মানবতার মুক্তি মিলে না কখনো। কারণ গণতন্ত্র কখনো পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আসেনি।
আমাদের দুর্ভাগ্য যে গত কয়েক দশকে আমাদের মিডিয়া ইসলামকে দেখেছে প্রথমে কমিউনিজমের তাত্ত্বিক কাঠামোয় আর এখন দেখছে বিশ্বব্যাপী ওয়ার অন টেররের পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গিতে। এসবের রং-ছাপ ছাপিয়ে একজন ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের জন্য নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ ক্ষমতায়িত দলের সাথে ‘সালাম-মুসাফাহা’ অনেককে মর্মাহত করলেও এটাই ছিল আল্লামা আহমদ শফীর দুরদর্শিতা। কাদিয়ানি ইস্যু ও নাস্তিকদেরকে ব্যান করার জন্য এরচেয়ে সুবিধাজনক কায়দা আর নেই। অন্তত রাষ্ট্র তো আর ইসলামকে অস্বীকার করে বসেনি!
আধুনিক শিক্ষাপদ্ধতির নজরকাড়া ‘প্রচ্ছদে’ প্রভাবিত না হয়ে আল্লামা আহমদ শফী প্রাচীন শিক্ষাধারারই প্রতিনিধিত্ব করেছেন। যেখানে দেওবন্দ, নদওয়া, আলিগড় ও সর্বশেষ পাকিস্তানে মুফতি মুহাম্মদ শফি রহিমাহুল্লাহ প্রবর্তিত নতুন ধারার ইসলামি শিক্ষাকারিকুলাম সমান্তরালে বিদ্যমান আছে। তবে সমসাময়িকতাও একেবারে ভুলে যাননি। ভুলে যদি যেতেন তাহলে হাটহাজারির ইফতা, উলুমুল হাদিস, আরবি সাহিত্য, কেরাত, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য ও কৃষিবিভাগের মতো আধুনিক ও সময়োপযোগী শিক্ষাধারা চালু করতেন না তিনি। আর হেফাজতে ইসলামের আত্মপ্রকাশ এবং পরবর্তী সময়ে ২০১৩ সালে এপ্রিলের লংমার্চ ও ৫ই মের ইতিহাস সৃষ্টিকারী অবরোধ আল্লামা আহমদ শফীকে বিশ্বমোড়লদের মজলিসেও আলোচনার পাত্র বানিয়েছে। যদিও অবরোধ-পরবর্তী ট্রাজেডি বাংলাদেশের ইতিহাসে একটা কালো অধ্যায় হয়ে আছে। আর রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় কেউ কেউ হেফাজতে ইসলামকে ধর্মীয় চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী বললেও হেফাজত কখনো কোনো চাপ সৃষ্টি করেনি। বরং বহিঃশত্রুর নগ্নচাপ কঠোরভাবে ঠেকাবার চেষ্টা করেছে। সফলও হয়েছে। মারপিটও খেয়েছে। কিন্তু এও হিকমাহ থেকে খালি নয়। সত্যের জন্য, বাতিল প্রতিরোধে রক্ত তো দিতেই হতো, সেটা নতুন কিছু কি?
আল্লামা আহমদ শফী নতুন প্রজন্মের জন্য ইতিহাস হয়ে থাকবেন। তাঁর শতবর্ষ জীবনের ইলম-আমল, তাযকিয়াহ-তারবিয়াহ ও বাতিলের মুখে অনড়-অবিচল থাকার দৃপ্তশিক্ষা আমাদের জীবনে বাস্তবায়ন করতে পারলেই অনেকটা পথ এগিয়ে যাব মানযিলে মাকসাদের দিকে।
শিবপুর, নরসিংদী
অক্টোবর ২০২০