ঝুম ঝুম। ঝুম ঝুম। বৃষ্টি। বর্ষণ থেকে বর্ষা?
সব লোক বৃষ্টি লিখে কেন? আমার কাছে তো ভালো লাগে, বৃষ্টির মতন লাগে বর্ষা। শব্দের মধ্যেই বর্ষণের সুর। মেঘের ছন্দ। পড়তে পড়তে বরষা নামল। বৃষ্টির ছিটেছিটি বারান্দার গ্রিলে বাড়ি খেতে খেতে ভেতরে ঢুকছে দেখি। রশিতে সাদা পাজামা ঝুলছে। ভিজছে। ভিজুক, আবার শুকোবে। ভাবলাম।
উঠতে মন চাচ্ছিল না। উঠলাম। পাজামা এনে নাড়ব কোথায়? ঘরের মধ্যিখান দিয়ে দড়ি টাঙাব নাকি? হিটলারের বন্দীখানার মতো! কাঠের দরোজা আধখানা ভেজিয়ে তার ঘাড়ে মেলে দিলাম। ফ্যানের বাতাসের খুব কাছাকাছি। ঘরের ওপরের অংশে ঝুলছে তো, এতক্ষণে শুকিয়ে এলো বোধহয়। ধরে দেখি? কলিংবেলটা বাজল।
বর্ষার গতি তেজে বাড়ছে। গরম তেলের তেজের মতো। মাখা বেগুন দিলে যেমন ছ্যাঁত ছ্যাঁতÑমিউজিকের মতো একরকম প্রাকৃতিক শব্দ বেজে ওঠে, বৃষ্টি ঝেঁপে ঝেঁপে মাটিতে পড়ার, ইটের ওপর পড়ার, কংক্রিটের ওপর পড়ার শব্দ ওইরকম। রান্নাঘরে কেউ কি ইফতারির জন্য বেগুনি পেঁয়াজু ভাজছে? আম্মু। রান্নাঘরে। শাওয়ালের ছয় রোজা এসে আবার রমজান মাসের মতো মনে হচ্ছে। আম্মু, সে কি আমার চাকরি করে? মাসে বেতন দিই? বাসায় খাওয়ার বাজার করি? না তো! কিচ্ছু তো করি না! এত সেবা পাই, এত যে মুফতে জিনিস পাই, কেন? বাসার বাইরে কী দেখি? মা এক পয়সাও কাউকে মাগনা তো দেয় না! আহা মা! নারীবাদী কেউ নাকি মাতৃত্ব নিয়ে অস্বস্তি ছড়ান? হীনমন্যতার দুঃখ, আহা প্রাকৃত নিয়ম, অমান্যের দুঃখ!
একটা গল্প লিখতে চাইছিলাম। বসছিলাম। এইজন্য লেখার শুরুতে শব্দপ্রয়োগের একটা ফিনফিনে আলাপও তুলেছিলাম। তারপর কীভাবে আলাপ চলে গেল অন্যদিকে? একেবারেই নিজেনিজে, লেখাটা অন্যকিছু হয়ে গেল দেখছি! লেখারও কি থাকে জীয়ল প্রাণ? অংকিত অক্ষর কি জীব, সন্দিগ্ধ চোখে লেখকের কলমের নিবে তাকিয়ে থাকে, শুয়ে হাঁটে এমন কোনো প্রাণী কি সে?
ভেবেছিলাম তো ভিন্ন। আমি যে গল্প লিখতে চাইছি কিন্তু পারছি না, টেবিলে বসছি, এই গল্পটাই বলার জন্য। এইটাও তো একটা গল্প, তাই না? আমার গল্পটা বলছে গল্পের চরিত্র নিজেই। আমি না।
আমার গল্প কেন ওর মতো ন্যাকা ন্যাকা হয় না? আমার গল্প ওর মতো কেন ফালতু ফালতু হয় না?
জি, কলিংবেল বাজার কথা বলছিলেন লেখক।
গেট খুলে দেখি ও এসেছে। ও এসে পড়েছে! বোরকাওয়ালি এক, গেটের ওইপাশে দাঁড়িয়ে। পিপহোলে দেখলাম। গেট খুললাম। ওর অবয়ব চোখের সামনে বাস্তব হতেই আমার মাথায় পড়া শুরু হলো।
কী?
ভরপুর কলস তুলে মুখ উল্টো করে দিলে যেমন হয়। মাথায় হুড়মুড় করে, খালি ঠনঠনে ঘিলুতে কিংকর্তব্যবিমূঢ় বেগে গল্পের প্লট নেমে ভরতে থাকল।
ওকে দেখেই? বাব্বাহ!
গল্পের বেলে কাদামাটি করোটিতে ঘোট পাকাতে থাকলে অন্যমনস্ক হয়ে যাই না? যাই তো। চাক্ষুষী জগতের অন্তরালে অন্যজগত ভেতরে নির্মিতি পেতে থাকে, সেই নলের ভেতর দৃষ্টিপাত ঘটাতে হয় না? হয় তো।
দরোজা খুলে দাঁড়িয়েই রইলাম। কল্পনামহলের দরোজাও খুলে গেছে হাট করে। কতক্ষণ চলল?
মাইমুনা… আমার নামের শেষ ভাগ। নামের শেষ ভাগ কী? পদবি। ধরি আমার নাম হোসেন। সুতরাং মাইমুনা হোসেন ।
মাইমুনা হোসেন! উঁহু, আমি বললেই হলো?
ও নিজের নামের সঙ্গে পুরুষালি নাম মেশাবে না।
ওকে প্রথম যখন পাই, তার মাসখানেক পর আমার অনেক দিনের লালিত একটা ইচ্ছেপ‚রণ ঘটে। অনেক দিন কত দিন? সহ¯্র দিন তো হবেই! কলিকাতার দেশ পত্রিকা আমি এক যবনের গল্প ছাপল। ছাপল কী, ছাপতেই নাকি হলো, অমন অসাধারণ গল্প! আমি বলিনি, সম্পাদকই বলেছিলেন ফোন করে। সুতরাং আমার বউ আমার ল²ী । মানতেই হয়।
ওর মেয়েলি আঙুলের মৃদু চাটি পড়ল চোখের ওপর, কপালে। ঘোর ভাঙল। কত দিন, এবং, কত রাত, এমন একটা ঘোরের জন্য কাতরাচ্ছি!
‘ঢুকতে দেবে তো আগে, নাকি বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেই গল্প ভাবতে থাকবে? দুইমাস পর ফিরলাম।’
হু, দুইমাস ধরে আমি গল্প লিখতে পারছিলাম না। গল্পের ‘গ’-ও না।এই বন্ধ্যা সময়টাতেই বক্ষমান গল্পটাÑযার সঙ্গে এই কিছুটা সময় ছিলেন আপনারাÑলেখা।
ও চলে আসার পর কী সুখ কী সুখ সময়ে, বলি, মনে হচ্ছে এই গল্পটা আসলে গল্পের ‘গ’-ও না…।
সেপ্টেম্বর ২০১৮