সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের প্রায় সাত বছর পার হয়ে গেল। আশ্চর্য কারণে বিশ্ব নেতারা এখনো এর সুরাহা করতে পারেননি। পারেননি বললে ভুল হবে। করেননি। সিরিয়াকে তারা নিজেদের শক্তি প্রদর্শনের ক্ষেত্র বানিয়েছেন। ভিয়েতনাম বা কোরিয়ার মত এখানেও পর্দার আড়ালে দুই খেলোয়াড়। আমেরিকা ও রাশিয়া। তাদের সাথে যোগ দিয়েছে নতুন পাখা গজানো ইসরাইল, ইরান ও সৌদি আরবের মত দেশগুলো।
২০১০ সালে তিউনিসিয়ার এক হতভাগা যুবকের য়াÍহুতির মাধ্যমে আরব বিশ্বে যে বিদ্রোহের সূচনা হয় তা ছড়িয়ে পড়ে প্লাবনের মত। সেই প্লাবনে টিকতে পারেনি হুসনি মুবারকসহ মুয়াম্মার গাদ্দাফির মত ক্ষমতাধর শাসকরাও। পশ্চিমা বিশ্ব এই বিদ্রোহের নাম দিয়েছিল আরব বসন্ত বলে। বসন্তে ফুল ফোটে। প্রকৃতি মনোরম সাজে সজ্জিত হয়। কিন্তু এতদিন পর সিরিয়া ও ইয়েমেনের ধ্বংসাবস্থা দেখে আমরা নিশ্চিত বলতে পারি এই নামকরণ স¤পূর্ণ ভুল। এই বিদ্রোহের জাগরণকে আর যাই বলা হোক বসন্ত বলা যায় না।
এই বিদ্রোহের প্লাবনে টিকে গেছেন একজন। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ। টিকে গিয়েছেন বলতে তাকে টিকিয়ে রাখা হয়েছে। আমেরিকা ও রাশিয়া তাকে ক্রীড়নক বানিয়েছে। তাকে ক্ষমতায় রাখতে গিয়ে অবলীলায় তারা হত্যা করেছে সাড়ে তিন লাখ মানুষ। শরণার্থী হয়েছে প্রায় ছয় মিলিয়ন। সিরিয়ার মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫৩% শতাংশ এখন গৃহহারা।
সিরিয়ার এই দীর্ঘ সময়ের গৃহযুদ্ধে নানা গোষ্ঠীর আবির্ভাব হয়েছে। নানা ইতিহাস তৈরি হয়েছে যেগুলো রূপকথার গল্পের চেয়েও বেশি চমকপ্রদ। কুর্দিরা এই সুযোগে নিজেদের একটি রাষ্ট্র গঠন করার চেষ্টা করেছে। শিয়ারা বুঝিয়ে দিয়েছে তাদের উপস্থিতি। আরব-অনারব শিয়ারা একত্র হয়েছিল এই উপলক্ষে। তারা অবিচল থেকেছে বাশার আল আসাদকে ক্ষমতায় রাখার জন্য। শিয়া প্রধান দেশ ইরান একে সুযোগ হিসেবে নিয়েছে সৌদি আরবের বিরোধিতার জন্য। এর মধ্যে জন্ম এবং মৃত্যু হয়েছে আইএসের মত দলের। সারা বিশ্বে নিজেদের ভ্রান্ত ধারণা ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল তারা। বাংলাদেশের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশ এবং এমনকি যুক্তরাজ্যের মত উন্নত দেশেও তাদের সহযোগীর অভাব হয়নি। পথহারা যুবকদের সাথে সাথে নারীরাও যোগ দিয়েছিল তাদের দলে। উদ্ভব হয়েছিল জিহাদুন নিকাহ নামে নতুন জিহাদের। বিশ্বের নানা উন্নত দেশ থেকে বহু মানুষ পাড়ি জমিয়েছিল তাদের খেলাফতে। ফেসবুক প্রোফাইলে আইএস যোদ্ধাদের ছবি দিয়ে আর আবু বকর আল বাগদাদীকে আমিরুল মুমিনীন ডেকে মুখে ফেনা তুলেছিল বহু মানুষ।
সিরিয়ার ভাগ্যে কী আছে তা এখনো কেউ বলতে পারে না। পৃথিবীর নানা দেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা নানা মতামত ব্যক্ত করেছেন সিরিয়া নিয়ে। সেসব বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে। সর্বশেষ তুর্কি সেনাবাহিনী অভিযান চালিয়েছে আফরীনে। একদিকে যখন তারা বিজয়োল্লাস করছে অন্যদিকে গৌতা তখন মৃত্যুপুরী। এদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্প সিরিয়ায় সেনাবাহিনী পাঠানোর জন্য রাশিয়াকে হুমকি দিয়ে চলেছেন। সাথে সাথে সৌদি যুবরাজের কাছে সিরিয়া যুদ্ধের ব্যয় দাবি করে ফেলেছেন। অত্যন্ত অযৌক্তিক ও নির্লজ্জ এই দাবি আশ্চর্য কারণে পৃথিবী স্বাভাবিক চোখে দেখেছে।
সিরিয়া নিয়ে রাজনৈতিকদের নেতৃবৃন্দের অবস্থান পরিবর্তিত হয়েছে একাধিকবার। তুরস্ক শুরুর দিকে সৌদি আরবের অন্যতম মিত্র থাকলেও এখন ঘোষিত শত্র“তে পরিণত হয়েছে। তবে সিরিয়ার সাধারণ জনগণের অবস্থা অপরিবর্তিত রয়ে গেছে। বিদ্রোহের শুরু থেকে তাদের জীবন বিপর্যস্ত। কেউ নিহত হয়েছে নির্মম্ভাবে। কেউ সীমান্ত পার হয়ে কোনো দেশে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। তরুণরা যোগ দিয়েছে কোনো যোদ্ধা দলে। তাদের সবার গল্প প্রায় এক রকম।
তবে ইতিহাস কাউকে কাউকে ক্ষমা করে না। আজকের প্রতাপশালী শাসককে কাল নত হয়ে হাজির হতে হয় আদালতের সামনে। গাদ্দাফীর কথাই ধরা যাক। চার দশকেরও বেশি সময় ধরে লিবিয়ার মত ধনী দেশের শাসক থাকার পরও তাকে মরতে হলো ক্ষিপ্ত জনতার হাতে মার খেয়ে। তাকে হত্যার ভিডিও দেখলে মনে হয় গাদ্দাফী পবিত্র কুরআনের সূরা আলে ইমরানের আপনি যাকে ইচ্ছা রাজত্ব দান করেন আর যাকে ইচ্ছা তার থেকে রাজত্ব ছিনিয়ে নেন এই আয়াতের উৎকৃষ্ট উদাহরণ। ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসাইনের কথাও বলতে পারি। প্রবল সাহসী এই রাষ্ট্রনায়ককে ভাগ্যের জেরে ফাঁসির দড়ি গলায় পরতে হয়েছিল। হাল জমানার এসব উদাহরণ বাদ দিলে অতীত ইতিহাসের হাজারোপ উদাহরণ আমাদের চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে।
বাশার আল আসাদের ক্ষেত্রেও এমন সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। কোনোদিন হয়তো তাকেও দাঁড়াতে হবে কাঠগড়ায়। হিসাব দিতে হবে প্রতি ফোঁটা রক্তের। ক্ষমতার লিপ্সায় তার বাহিনী যে নৃশংস হত্যাকান্ড চালিয়েছে তার খবর গণমাধ্যমে আসা তো দূরের কথা জানতে পেরেছে খুব কম মানুষ।
সিরিয়ার ধ্বংস্ত‘পের মধ্য ত্থেকে এমন আশা করাটা কঠিন। বাশার আল আসাদ আমেরিকারর চোখ রাঙ্গানি উপেক্ষা করে টিকে আছেন দীর্ঘ দিন। এরপরও জেগে ওথেছেন সিরিয়ার একদল তরুণ যারা যুদ্ধের দলিল সংগ্রহের মত সাহসিকতার কাজ করছেন স্বেচ্ছায়। এই তরুণদের গল্প অন্যদের চেয়ে আলাদা। ধ্বংসস্তুপের মধ্য থেকে তারা আশার প্রদীপ নিয়ে দাঁড়িয়েছেন। দলিল ও হত্যাকান্ডের আলামত সংগ্রহের মত অসামান্য কাজে নিয়োজিত হয়েছেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। তাদের কথা সবার চোখের আড়ালে রয়ে গেছে এখনো।
যে কোনো যুদ্ধে দলিল একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যুদ্ধের অপরাধ ও নানা ঘটনা প্রমাণের জন্য দলিল অবশ্য প্রয়োজন।বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধেরও দলিল রচনা করা হ্যেছে দীর্ঘ দশ খন্ডে। নানা গোষ্ঠীর আক্রমণে সিরিয়ায় যখন বেঁচে থাকাটাই দায় তখন এমন কাজে এগিয়ে আসা সত্যিই অনেক সাহসের। বরং মনে হয় সিরিয়ায় যারা অস্ত্র হাতে শত্রুদের প্রতিহত করছে তাদের চেয়ে এই যুবকের বেশি সাহসী।
আল-জাজিরার নির্মিত তথ্যচিত্রে উঠে এসেছে এমন কয়েকজন যুবকদের কথা। সিরিয়ার সীমান্তবর্তী তুরস্কের শহর আনাতোলিয়ায় এদের বেশির ভাগের বসবাস। তথ্যচিত্রে দেখা যায়, তরুণ ইবরাহিম সারাকেব অঞ্চল থেকে রাসায়নিক বোমা হামলার নমুনা সংগ্রহ করছেন। আনাতোলিয়া থেকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে তিনি ঘুরে বেড়াচ্ছেন সারাকেবের গ্রামে গ্রামে। বোমা হামলায় বিধ্বস্ত বাড়ি-ঘরের ছবি তুলছেন। প্রত্যক্ষদর্শী লোজকজনের বক্তব্য ভিডিও করছেন।
ইবরাহিম ক্যামেরা দিয়ে হেলিকপ্টার থেকে বোমা বর্ষণের দৃশ্য ধারণ করেন। হিসাব করে হেলিকপ্টারের গতি বের করেন। তার মতে এসব ভিডিও বোমা হামলার প্রত্যক্ষ দলিল। সারাকেব সহ প্রায় ষোলটি স্থানে রাসায়নিক বোমা হামলার প্রমাণ রয়েছে তার সংগ্রহে।
ইবরাহিম ও তার দল এসব প্রমাণ নিয়ে যোগাযোগ করেছেন জাতিসংঘের সাথে। পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া সিরিয়ার মধ্য থেকে কাজটি সহজ ছিল না। তাদের আশা ছিল হয়ত বিশ্ববাসী এগিয়ে আসবে বাশার আল আসাদের নিপীড়নের বিরুদ্ধে।
প্রথম দিকে তারা যেসব নমুনা সংগ্রহ করেছিলেন সেগুলো পূর্ণাঙ্গ ছিল না। এসব প্রমাণের মাধ্যমে রাসায়নিক বোমা হামলার অভিযোগ পুরোপুরি সাব্যস্ত হয় না।
তবু হাল ছাড়েনি সাহসী এই তরুণরা। অপেক্ষায় থেকেছেন নতুন হামলার। ২০১৩ সালের আগস্টে দামেশকের গৌতায় ভয়াবহ রাসায়নিক হামলা করে আসাদ বাহিনী। এত কইয়েকশ সিরিয়ান নাগরিক নিহত হয়। হামলার পর ইবরাহিমের মত তরুণরা এর নমুনা সংরহ করে জাতিসংঘের এক কর্মকর্তার কাছে পাঠান। কিন্তু তাদের এসব নমুনা অভিযোগ প্রমাণের জন্য যথেষ্ট নয় বলে জানিয়ে দেয়া হয়। তদন্তকারীদের পক্ষ থেকে বলা হয়, অভিযোগ প্রমাণের জন্য আরো ¯পষ্ট প্রমাণের প্রয়োজন। কারা হামলা করেছে তার কোনো প্রমাণ নেই। সিরিয়ায় কয়েকটি পক্ষ লড়াই করছে। সবাই রাসায়নিক বোমা হামলার বিষয়টি অস্বীকার করেছে। তাছাড়া হামলায় যারা নিহত হয়েছে তাদের মধ্যে শুধু মারইয়াম নামের এক নারীর পরিচয় উলেখ করা হয়।
সিরিয়ার অভ্যন্তরে ঘটে যাওয়া মানবতাবিরোধী কর্মকান্ডের বিস্তারিত প্রমাণ পাওয়া কখনো সম্ভব ছিল না। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা নিরাপত্তার বিবেচনায় তাদের কর্মীদের সিরিয়ায় প্রবেশ করতে নিষেধ করে। তবে তারা সিরিয়ানদের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহের কাজ অব্যাহত রেখেছিল। সিরিয়ায় যারা প্রমাণ সংগ্রহ করতেন তারা কেউই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মী ছিওলেন না। ছিলেন সাধারণ মানুষ। প্রমাণ কীভাবে সংগ্রহ করতে হয় সে স¤পর্কে তাদের কোনো ধারণাও ছিল না। বগিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে এসব স্বচ্ছাসেবী যুবকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তবু তাদের সংগৃহীত প্রমাণ আসলে কী কারণে গ্রহণযোগ্য হয়নি তা সত্যিই রহস্যাবৃত।
রাসায়নিক হামলা সুপ্রমাণিত না হওয়ার বিষয়টি জানা যায় বারাক ওবামার বক্তব্য থেকেও। আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট একটি বক্তব্যে বলেন, সিরিয়ায় রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে তার প্রমাণ আমাদের কাছে আছে। কীন্তু কখন কীভাবে রবং কারা তা ব্যবহার করেছে তার প্রমাণ আমাদের হাতে নেই।
যেই আমেরিকা পারমাণবিক অস্ত্র থাকার অভিযোগে প্রায় এক দশক ধরে ইরাকে আগ্রাসন চালিয়েছিল এবং যুদ্ধ পরবর্তী রিপোর্টে বলেছিল ইরাক হামলা ছিল একটি ভুল সেই আমেরিকা যখন এত সাবধানী হয়ে ওঠে তখন সত্যিই অবাক লাগে। বারাক ওবামার এই বক্তব্যের কারণে আরো সুযোগ পেয়ে যায় আসাদ বাহিনী। রাসায়নিক বোমা হামলা এখনো তারা অব্যাহত রেখেছে সিরিয়ায়।
দলিল প্রমাণ সংগ্রহের এই যুদ্ধে নেমেছিল অনেক তরুণই। এদের মধ্যে পশ্চিমা বিশ্বের মানবাধিকার কর্মীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সময় লেগে যায় অনেক। ২০১৪ সালের কায়সার নামের এক ব্যাক্তির তোলা ছবি ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে। তিনি এক সময় ছিলেন আসাদ বাহিনীর ফটোগ্রাফার। আসাদ বাহিনীর অমানবিক নির্যাতন মর্মাহত করেছিল তাকে। ২০১৩ সালে দামেশকের বিভিন্ন কারাগারে হত্যা করা প্রায় ১৩ হাজার মৃতদেহের প্রায় ৩৫ হাজার ছবি তুলেছিলেন কায়সার। এসব মৃতদেহে অত্যাচারের ছাপ ছিল। না খাইয়ে অত্যাচার করে হত্যা করা হয়েছিল তাদের।
কায়সার আসাদ বাহিনীতে চাকরিরত অবস্থায়ই এসব ছবি ছড়িয়ে দেয়ার দুঃসাহসিক উদ্যগ নেন। যোগাযোগ করেন তার এক বন্ধুর সাথে। সামির নামে সেই বন্ধু ছিলেন বিপ্লবী দলের একজন।
কায়সার একদিন ফোন করে দেখা করেন সামিরের সাথে। সামিরকে জানান তার কাছে আসাদ বাহিনীর নির্ম্ম অত্যাচারের বেশ কিছু প্রমাণ আছে। সামিরের সহায়তায় সেসব ছবি বিভিন্ন সংবাদ ও মানবাধিকার সংস্থার কাছে পাঠানো হয়।
কায়সারের তোলা এসব ছবি দেখে ফ্রান্সের পররাষ্ট্র মন্ত্রীর উদ্যোগে জরুরী সভা বসে প্যারিসে। ফ্রান্স কয়েক মাস ধরেই আসাদ বাহিনীর নির্মম অত্যাচারের অভিযোগ করে আসছিল। কায়সারের তোলা ছবিগুলো সেই অভিযোগের সত্যতা প্রমাণ করে।
প্যারিসে অনুষ্ঠিত ওই সভায় কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া যায়নি। জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ ছাড়া কিছু করাও সম্ভব ছিল না তখন। তাই সব শেষে জাতিসংঘেই বিষয়টি উত্থাপন করা হয়।
জাতিসংঘে কী ঘটবে তা জানা ছিল অভিযোগকারীদের। রাশিয়া এই অভিযগের বিরুদ্ধে ভেটো প্রদান করে। এই একটি শব্দ ভেস্তে দেয় সব কিছু। ফলে আবারো আসাদ বাহিনীর অত্যাচারের এসব প্রমাণ ব্যর্থ হয়। তবে এই ঘতনা বিশ্ববাসীকে জানানোর জন্য ফ্রান্সের পক্ষ থেকে একতি সংবাদ সম্মেলন ডাকা হয়। ওই সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে সারা পৃথিবী জেনে যায় আসাদ বাহিনীর নৃশংসতার কথা। সম্মেলনে কয়েকটি চিত্রও দেখানো হয়।
এই ঘটনার পর ঝুঁকিতে পড়ে কায়সারের জীবন। বিপ্লবীদের সাহায্যে সিরিয়া ত্যাগ করতে বাধ্য হন তিনি। তবে থেমে থাকেনি তার প্রচেষ্টা। জাতিসংঘ থেকে ব্যর্থ হওয়ার পর কায়সার যোগাযোগ করেন মার্কিন কংগ্রেসের সাথে। কংগ্রেসের একজন নেতা কায়সারকে প্রস্তাব দেন সরাসরি দেখা করার জন্য। কায়সার তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে ওয়াশিংটন পৌঁছেন। এক্ষেত্রে কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়। কায়সারের সাথে যে কক্ষে বৈঠক করা হয় তা ছিল মাটির নীচে অবস্থিত। ওই কক্ষের এবং আশেপাশের সব ক্যামেরা খুলে ফেলা হয়। কায়সার একটি নীল জ্যাকেট পরে উপস্থিত হন। জ্যাকেটের হুডি দিয়ে তার মাথা ও মুখ ঢাকা ছিল।
বৈঠকে কায়সার তার কাছে থাকা আরো কিছু ছবি কংগ্রেস নেতৃবৃন্দকে দেখান। ভয়ংকর পাশবিক নির্যাতনের এসব দৃশ্য দেখে বৈঠক কক্ষে ¯ব্ধতা নেমে আসে। এক ঘন্টার বেশি সময় ধরে চলমান ওই বৈঠকে দেখান কায়সারের ছবিগুলো সবাইকে ব্যাথিত করে। কংগ্রেস নেতারা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
আল জাজিরাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে এক কংগ্রেস নেতা বলেন, মার্কিন কংগ্রেসের বৈঠক কক্ষে এমন নিস্তব্দধতা কখনো দেখা যায়নি। আমরা যা দেখেছিলাম সত্যিই বেদনাদায়ক। কিন্তু দুঃখ যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বা বিশ্বের কোনো নেতাই এখন পর্যন্ত সিরিয়ার বিষয়ে একটি কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি।
তবে কিছুটা কাজ অবশ্যই হয়েছিল। সিরিয়ান তরুণদের সাহায্যে এগিয়ে আসে কানাডার একটি সংস্থা। সিরিয়ানদের সংগৃহীত তথ্যগুলো তারা বিশ্লেষণ করে আরো শক্ত দলিল তৈরি করে। এই দলিল এখন কাজে না এলেও একদিন আদালতে বাশার আল আসাদ ও তার বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণে কাজ করবে।
কানাডার ওই সংস্থা পরব্ররতীতে আরো অনেক সিরিয়ান তরুণদের খুঁজে বের করে যাদের কাছে এমন আরো অনেক প্রমাণ ছিল। এক ব্যাক্তির কাছে তারা প্রায় দশ কেজি ওজনের কাগজ পত্র খুঁজে পায় যেগুলোতে হত্যা ও নির্যাতনের বহু প্রমাণ রয়েছে।
এদিকে ফ্রান্সের প্রচেষ্টা থেমে থাকেনি। কিন্তু সরাসরি সিরিয়া সরকারকে দোষী সাব্যস্ত করে কোনও উদ্যোগ গ্রহণের সুযোগ তাদের ছিল না। কারণ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিরুদ্ধে এক একা কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার তাদের নেই। তবে কায়সারের তোলা ছবিগুলো থেকে ফ্রান্স তাদের এক নাগরিকের মৃতদেহের ছবি শনাক্ত করে। ওই নাগরিকের মৃত্যুর জন্য ফ্রান্স সিরিয়ার সরকারকে দায়ী করে। সিরিয়ার মিত্র রাশিয়ার কাছে জবাবদিহিতা দাবি করা হয়।
রাশিয়া এর জবাব দেয় হামলার মাধ্যমে। পরদিন তারা সিরিয়ার নানা স্থানে বিমান হামলা চালিয়ে অসংখ্য সাধারণ নাগরিককে হত্যা করে। এভাবে ফ্রান্সের অভিযোগ ধামাচাপা পড়ে যায়।
সব শেষে ফলাফল শূন্য মনে হলেও সিরিয়ার দেশপ্রেমী তরুণরা কাজ করে চলেছে সাক্ষ্য প্রমাণ সংগ্রহে। এজন্য একটি সংস্থাও গড়ে তুলেছে তারা । সংস্থাটির অফিস তুরস্কে । কিন্তু নিয়মিত সিরিয়ার বিভিন্ন স্থানে থাকা প্রতিনিধিদের সাথে যোগাযোগ করে প্রতিদিনের হামলা ও হতাহতের প্রমাণ রাখা হয়। সে সাথে চলে নমুনা সংগ্রহ।
সিরিয়ার এই সাহসী তরুণরা এখনো স্বপ্নে দেখে কোনো একদিন বিজয় আসবে। বাশার আল আসাদকে দাঁড়াতে হবে কাঠগড়ায়। এইসব দলিল সেদিন তাদের অপরাধ প্রমাণ করবে। শাস্তি পাবে অন্যায়কারীরা। শোধ হবে প্রতি ফোঁটা রক্তের ঋণ।