জেনারেল ইয়াদের অট্টহাসিতে বিলিন হয়ে যায় আহেদের আর্তনাদ। আহেদ আর কাঁদতে পারে না। চোখের পানি শুকিয়ে আসে। মনের সাহস হারিয়ে যায়। ‘এরিয়া ২১’ ক্যাম্পের একটি বদ্ধরুমে আহেদের সামনে বিভৎস মৃত্যু নগ্ন নৃত্য করে। পাহাড়ের আঁকাবাঁকা সুড়ঙ্গপথ অতিক্রম করে, তিরিশ ফুট মাটির নিচে নির্মিত ‘এরিয়া ২১’ ক্যাম্প। ইসরায়েলি সেনারা ভয়ানক ব্যক্তিদের এই ক্যাম্পে বন্দী রাখে। মুষ্টিমেয় সেনা জেনারেল ছাড়া কেউ কিছু জানে না ‘এরিয়া ২১’ সম্পর্কে। তাই পৃথিবীর আলো-বাতাস কোলাহল থেকে বিচ্ছিন্ন এই ক্যাম্পে কী ঘটছে, কার সাথে ঘটছেÑএসব তথ্য চিররহস্যময়। ইউকিলিকসের মতো কেউ যদি হাটে হাঁড়ি ভাঙে তবে হয়ত ‘এরিয়া ২১’ ক্যাম্পে ঘটা নৃশংস কাহিনির কিছুটা তথ্য জানা যাবে। জানা যাবেÑঅসহ্য নির্যাতন সয়ে সয়ে, শরীর ক্ষয়ে ক্ষয়ে, আহেদের মতো দূর্দান্ত কত জীবনের ইতি ঘটেছে সেখানে।
সকাল থেকে আহেদের কাছ থেকে তথ্য তালাশ করছে মোসাদের বø্যাক টিম। সব ধরনের কায়দা-কানুন প্রয়োগের পর উদ্ধারকৃত তথ্যকে বø্যাক টিম মনে করে নিতান্ত মিথ্যে প্রলাপ। আসল তথ্য এখনো কিছুই উদ্ধার হয়নি। আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে তারা। শারীরিক নির্যাতনের বিভিন্ন আধুনিকপন্থা প্রয়োগ করতে থাকে। আহেদের করুণ আর্তনাদ মিশে যায় বদ্ধঘরের অন্ধকারে।
জেনারেল ইয়াদ ভেতরে ঢুকলেন। হাতে একটি চিরকুট। লিখেছেন আহেদের বাবা বাসেত তামিমিÑ
‘আহেদ, মা আমার! আজ তোমার জন্য আমার থেকে আনন্দিত আর কেউ নাই। প্রিয় মা! তুমি ফিলিস্তিনিদের স্বপ্নের অভিযাত্রী! যেখানে মায়েরা সন্তান জন্মায় হারাবে বলে, পিতারা কন্যার মুখে দেখে দিগি¦জয়ী বীরের প্রতিচ্ছবি। তুমি আমাদের নতুন প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিনিধি। এই প্রজন্মকে ফিলিস্তিন স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত জিহাদ করে যেতে হবে ইসরায়েলের আগ্রাসনকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে। অন্যদিকে নিজেদের জাতির স্থবিরতা ও রাজনৈতিক অধঃপতন মুকাবেলা করতে হবে। আহেদ! তোমার বয়েস মাত্র ১৬ বছর। এই বয়েসে যা করেছো তা-ই আমাদের জন্য বিরাট প্রাপ্তি। জালিমের বন্দীদশা থেকে যদি মুক্তি পাও তবে আরো এগিয়ে যেতে হবে স্বাধীনতার পথে। লড়তে হবে মুসলিমদের রক্ত নিরাপদ করতে। আর যদি জালিমের কারাগারে তোমার মৃত্যু হয়ে যায় তবে মনে রেখো! তুমি একজন শহিদ, তোমার জিহাদ ছিলো শান্তির পক্ষে। পৃথিবীর তাগুত শক্তির বিপক্ষে। তুমি তোমার কাজের প্রকৃত প্রতিদান পাবে অপারে। আল্লাহ তায়াল তোমাকে শহিদের কাতারে শামিল করবেন। আল্লাহ সর্বোত্তম অভিভাবক।’
চিরকুট পড়ে ইয়াদ বলেন, ‘তুই ফিলিস্তিন স্বাধীন করবি! জেরুসালেম ফিরিয়ে নিবি!’
আহেদ বলে, ‘আমি একজন মুসলিম মেয়ে। জেরুসালেম আমার প্রাণ। প্রাণ ছাড়া যেমন মানুষ বাঁচে না, তেমনি জেরুসালেম ছাড়া আমি বাঁচতে পারি না।’
উন্মাদের মতো হাসতে থাকেন জেনারেল ইয়াদ। তাঁর অট্টহাসির মধ্যে বিলিন হয়ে যায় আহেদের আর্তনাদ।
দুই
কুশিয়ারার তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা ভাঙা টিন-টুঙের চায়ের দোকান ওরফে ‘হুসাইন সিটি’। সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে হুসাইন সিটিতে জমে ওঠে রসময় চা সন্ধ্যা। সন্ধাকালীন পড়তে যাওয়ার আগে আমরা চায়ে চুমুক দিতে দিতে সা¤প্রতিক বিশ্বকে একবার চিবিয়ে নিই। পক্ষে-বিপক্ষে ঢের কথাবার্তা, যুক্তি পাল্টা যুক্তি চলে। যদিও বিতর্ক হয় কিন্তু সহনশীল আচরণ ও বিন¤্র শব্দ চয়নে সেটাকে বিতর্ক বলে মনে হয় না।
সেদিন একটু ব্যতিক্রম ঘটে যায়। ইসরায়েলের সাথে সৌদি আরবের গোপন যোগাযোগ-তথ্য ফাঁস নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। তখন সৌদি প্রিন্স মুহাম্মদ বিন সালমানকে ইসরায়েলের দালাল বলে তকমা লাগিয়ে দেয় জায়েদ। কথাটি শুনে তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে নোমান। আমাদের মধ্যে নোমান হচ্ছে সৌদি রাজপরিবারের একনিষ্ঠ ভক্ত। ইদানীং প্রিন্স মুহাম্মদকে নিয়ে মুসলিম জাহানে যে সমালোচনা বইছে, বিশেষ করে অযৌক্তিক দাবি তুলে কাতার অবরোধ ও হেজাজ ভূমিতে শরিয়াহবিরোধী নানান প্রজেক্ট হাতে নেয়াকে কেন্দ্র করে, তখন নোমানের মগজে ক্রোধ জমে গিজগিজ করছে। তার এককথা, মুহাম্মাদ গতানুগতিক কোন নেতা নন। তিনি আধুনিক সমরশক্তি সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন। তিনি যা করছেন বুঝে-শুনেই করছেন। ইরান ও হিজবুল্লাহকে দমিয়ে রাখতে বিশ্বশক্তির সমর্থন প্রয়োজন। সে জন্য কিছুকিছু বিষয়ে উদার হওয়া ভুল সিদ্ধান্ত নয়। কিন্তু মুহাম্মদের বিচক্ষণতা না বুঝেই অন্যরা লাফালাফি করছেন।
নোমানের সেই ক্রোধের একটু জায়েদের দিকে তেড়ে গেলো। সে আঙুল তুলে জায়েদকে বলল, ‘মুহাম্মাদকে নিয়ে আর একটা কথাও বলবে না। আদার ব্যাপারীর জন্য জাহাজের খবর রাখা উচিত না।’
জায়েদ কিছু বলতে উদ্যত হলো। আমি আলোচনার টপিক ঘুরিয়ে দিলাম। নোমানকে লক্ষ্য করে বললাম, ‘আহেদ তামিমি নামের যে মেয়েটি গ্রেপ্তার হলো সেদিন, তার ব্যাপারটা তোমার কাছে কেমন মনে হয়?’ নোমান উত্তর দেয়ার আগেই জায়েদ বলল, ‘মেয়েটি নোবেল পাওয়ার দাবি রাখে। কী সাহসই না দেখিয়েছে! ইহুদি সেনার মুখে চড় মারা মামুলি কোন কথা নয়। আহেদের বীরত্বে মুসলিম জাতির প্রকৃত চেতনা ফুটে উঠেছে।’
নোমান বলল, ‘তোমাদের সমস্যা হচ্ছে, সবকিছুতে জাতিগত ভেদ টেনে আনো। আহেদের বিষয়টি মানবিক বিচারে দেখতে হবে। জাত-ধর্ম বিভেদের ক্ষুদ্রতা থেকে আমাদের উত্তরণ কাম্য।’
আমি বললাম, ‘আচ্ছা নোমান! মালালার নোবেল প্রাপ্তির বিষয়টি নিয়ে ভেবেছো কখনো?’
‘অবশ্যই। এই তো সুন্দর পয়েন্টে এসেছ। মালালা মুসলিম মেয়ে। শিক্ষা-সংস্কৃতির জন্য লড়ছে। সেই ছোট মেয়েটির ওপর হামলা করে বসল তালেবান। বিশ্ব যদি আমাদের মতো জাতভেদে আক্রান্ত থাকত, তবে মালালা কখনো নোবেল পেত না।’
‘যদি তাই হয় তবে আহেদও নিজ জাতির স্বাধীনতার জন্য লড়েছে। এখানে মালালার সাথে আহেদের মিল হয়ে গেল?’
‘হুম।’
‘তাহলে ইসরায়েলি সেনাদের তালেবানের স্থানে দাঁড় করিয়ে মালালার মতো আহেদকেও নোবেল দেওয়া উচিত, তাই না?’
‘হুম।’
‘তো দেওয়া হচ্ছে না কেন?’
নোমান কোনো উত্তর না দিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিতে থাকে।
আমি এ বছরের বøকবাস্টার হলিউডি সিনেমা ‘ওয়ান্ডার উইমেন’-এর নায়িকা গাল গাডটের কথা বললাম। তার সঙ্গে আহেদের তুলনাও করতে চাইলাম।
গাল গাডট সেনাবাহিনীর অফিসার ছিলেন। গাজায় হামলার সময় ফিলিস্তিনিদের হত্যার জন্য উদ্বুদ্ধ করে তার বাহিনীকে টুইট বার্তা পাঠান। পরে বিয়ে করেন একজন ইসরায়েলি রিয়েল স্টেট ডেভেলপারকেÑযার ব্যবসা ফিলিস্তিনি জমিতে আবাসন নির্মাণ। ‘ওয়ান্ডার উইমেন’-এর গল্পেও তিনি দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন এক দ্বীপের কন্যা হিসেবে অভিনয় করেন। অভিনয়ে আমেরিকান পাইলটের প্রেমে পড়ে দুনিয়ার সেরা খলনায়ককে হত্যা করে পৃথিবীকে রক্ষা করেন। এদিকে বাস্তবেও ইসরায়েল আরব ভূমিতে দ্বীপের মতো বিচ্ছিন্ন। ইসরায়েল ও আমেরিকা মিলে ইরান, হিজবুল্লাহ, হামাস ও ফিলিস্তিনিদের হাত থেকে দুনিয়াকে রক্ষা করার নামে আগ্রাসন ও নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। একটি বর্ণবাদী সা¤্রাজ্যবাদী চরিত্রকে মানবতাবাদী বলা অবশ্যই সমালোচনার জন্ম দেয়। কিন্তু ‘ওয়ান্ডার ইউমেন’ নায়িকা সমালোচনার বদলে সম্মাননা পাচ্ছেন। হলিউড ও পশ্চিমা গণমাধ্যম এবং কোনো কোনো রাষ্ট্রনেতা সেই মানবতাবিরোধী আগ্রাসী চরিত্রটিকে আড়াল করে যাচ্ছেন। বর্ণবাদী ইসরায়েলি সেনা এভাবেই ‘ওয়ান্ডার উইমেন’-এর নায়িকার বেশে হয়ে যান দুনিয়ার শান্তি কায়েমের ‘নায়িকা’। আর আহেদ তামিমির মত মানবতার বীরকিশোরীদের বানিয়ে দেওয়া হয় ‘বিপজ্জনক’ ‘সন্ত্রাসী’ ও শান্তির জন্য ‘হুমকি’।
নোমান বেশ নরম হয়ে গেছে।
‘এখন বলো, আহেদ নিগ্রহের শিকার হওয়ার কারণ কী?’
‘মানবতাবাদীদের অপার বুলিতে সু² জাতিভেদ কিংবা অন্ধ স্বার্থ নিহিত কি-না?’ আসলে এভাবে আমি ভাবিনি!
তিন
নিউইয়র্কের একটি হলে বিশাল অনুষ্ঠান চলছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ, বিজ্ঞানী জমা হয়েছেন একই প্লাটফর্মে। সঞ্চালক ঘোষণা করলেন, ১৯ বয়েসি একটি মেয়ের নাম। গুটিগুটি পায়ে মঞ্চের দিকে এগিয়ে গেলো মেয়েটি। রবার্ট জনসন মেয়েটির হাতে তুলে দিলেন একটি ক্রেস্ট। একটি পুরষ্কার। যাকে বলে নোবেল। ঊনিশ বছরের এই মেয়েটির হাতে উঠল এবারের শান্তির নোবেল পদক। সেই মেয়েটি কে, জানতে চান?
মেয়েটি আহেদ তামিমি।
আহেদ ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে বন্দী হওয়ার পর বিশ্বব্যাপী ইসরায়েলের নিন্দার ঝড় ওঠে। একটি ছোট্ট মেয়ের সামনে ইসরায়েলি বাহিনীর অসহায়ত্ব ধরা পড়ে বিভৎসভাবে। তাই ইসরায়েলের পক্ষে আহেদকে বন্দী রাখা সম্ভব হয়নি। সে বন্দীদশা থেকে মুক্ত হয়। আরো সোচ্চার হয় তার কাজের গতি। ফিলিস্তিনি জনগণের স্বাধীনতার প্রতীক হয়ে ওঠে আহেদ। ধীরে ধীরে তার কাজের পন্থায় পরিবর্তন আসে। সে মানুষকে বুঝায়Ñসশস্ত্র আক্রমণ কখনও শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য দু’পক্ষের আন্তরিকতা প্রয়োজন। একে অন্যকে ছাড় দিতে হবে। শান্তির জন্য যদি জেরুসালেম ছেড়ে দিতে হয় সেটা হবে মানবতার অমরস্বাক্ষর। রক্তপাতের চেয়ে মিলেমিশে বাস করা কি উত্তম নয়? তাই হামাস বা অন্য সশস্ত্র বাহিনীর বিলুপ্তি হবে ফিলিস্তিন স্বাধীনতার প্রথম পদক্ষেপ। বিশ্ব মিডিয়ায় বেশ গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার হতে থাকে আহাদের কর্ম-প্রলাপ। বিশিষ্ট ব্যক্তি, নামিদামি সংস্থা আহেদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠে।
সর্বশেষ শান্তির নোবেল উঠল আহেদের ঘরে।
ভাবছেন ‘এরিয়া ২১ বন্দি আহেদের কথা? যে বলেছিল, ‘আমি একজন মুসলিম মেয়ে। জেরুসালেম আমার প্রাণ। প্রাণ ছাড়া যেমন মানুষ বাঁচে না তেমনি জেরুসালেম ছাড়া আমি বাঁচতে পারি না।’ অথচ সেই প্রাণকেই আজ তুলে দিচ্ছে ইসরায়েলের হাতে!
তাহলে আহেদের গল্পটা শুরু থেকে শোনা যাক।
‘এরিয়া ২১’ ক্যাম্পে আহেদের কাছ থেকে বেশ কিছু তথ্য সংগ্রহ করে মোসাদ। কিন্তু এই তথ্যগুলো নেহায়েত কম মনে হয় তাদের কাছে। ফলে আরো অমানবিক, আরো কঠোর নির্যাতনের শিকার হয় আহেদ। ধীরেধীরে তার শরীর কঙ্কালসার হয়ে ওঠে।
একরাতে ভীষণ তৃষ্ণায় কাতরাতে লাগে আহেদ। প্রহরী এগিয়ে দেয় পানির গøাস। কঠিন বিষ মিশ্রিত পানির গøাস। আহেদ পান করে। প্রচÐ এক চিৎকারে কেঁপে ওঠে কুখ্যাত ‘এরিয়া ২১’ ক্যাম্প। আহেদের নাড়িভুঁড়ি টুকরো টুকরো হয়ে যায়। মৃত্যু হয় আহেদের।
মৃত আহেদের দেয়া তথ্য ও প্লাস্টিক সার্জারির রঙ-রূপ নিয়ে জন্ম নেয় আরেক আহেদ। ইসরায়েল বাহিনীর প্রশিক্ষিত একটি মেয়ে। যার হাতে আজ শান্তির নোবেল শোভা পাচ্ছে।
লেখক : শিক্ষার্থী, জামিয়া আঙ্গুরা-মোহাম্মদপুর, সিলেট
নবধ্বনি, ফেব্রুয়ারি ২০১৮