বয়েসের কাঁটা তখন দশ ছুঁইছুঁই। হিফজখানায় পড়ি মৌলভীবাজারের পাহাড়ি এলাকার এক প্রাচীন মাদরাসায়। আব্বা মাদরাসার মুহতামিম। আমাদের বাড়ি থেকে বেশ অনেক দূরে মাদরাসা। আব্বার সঙ্গে লজিংবাড়ি থাকি। লজিংবাড়ি একটি ঘর বরাদ্দ ছিল আব্বার জন্য। আব্বার জন্য বলতে মাদরাসার মুহতামিমের জন্য। ব্রিটিশ আমলের মাদরাসা। এলাকার মানুষের মেহনত ও ভালোবাসায় দাওরায়ে হাদিস পর্যন্ত মাদরাসার সমৃদ্ধি। মাদরাসার মুহতামিম যিনি হবেন, এই ঘরেই তাঁর থাকার বন্দোবস্ত হবেÑএটাই নিয়ম। বাড়িওয়ালা এ উদ্দেশ্যেই বানিয়ে রেখেছেন ঘরটি।
সুন্দর পরিপাটি করে সাজানো ছ্ট্টো কামরা। এক পাশে পড়ার টেবিল, আরেক পাশে শোবার খাট। পড়ার টেবিলে দরসি কিতাবের পাশাপাশি একগাদা মাসিক পত্রিকা সবসময় ছাড়ানো-ছিটানো থাকত। আব্বা তখনকার প্রায় সবগুলো ইসলামি মাসিক পত্রিকার গ্রাহক ছিলেন। ঢাকা থেকে মাসিক মদীনা, আদর্শ নারী, রহমত, মৌলভীবাজারের বরুণা মাদরাসা থেকে মাসিক হেফাজতে ইসলাম নিয়মিত ডাকে আসত আব্বার নামে। বাকিগুলো মাঝে মাঝে নিতেন স্থানীয় এজেন্টের কাছ থেকে। এগুলোর মধ্যে মাসিক আমার ঈমান নামে একটা পত্রিকার কথা মনে আছে। বুক সাইজের তিন-চার ফর্মার ম্যাগাজিন। বাকি আরও কী কী যেন আসত, মনে নেই। আব্বা খুঁটে খুঁটে সবক’টি পত্রিকা মাস জুড়ে পড়তেন।
এক বিকেলে আদর্শ নারী হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলাম। শেষের দিকে ছোটদের জন্য সবুজ কুঁড়ি বিভাগের কয়েকটি গল্প পড়লাম। ভালো লাগল। সেই থেকে আদর্শ নারী পড়া শুরু। এবং আমার আউট পাঠের সূচনা। কয়েক মাস পর রহমতও পড়তে শুরু করলাম। রহমতের শেষের দিকে আফগানিস্তান, ইরাকসহ বিভিন্ন নির্যাতনগ্রস্ত মুসলিম দেশের খবরাখবর ছাপা হতো। ওগুলো থেকেই রহমতের প্রতি আকর্ষণ। রহমত এবং আদর্শ নারীÑএ দু’টো পত্রিকা পড়তাম আগাগোড়া পুরোটা। বাকিগুলো নেড়েচেড়ে দেখতাম। ধীরে ধীরে পত্রিকা পাঠ আমার নেশায় পরিণত হয়ে গেল। প্রতি মাসে অধীর হয়ে অপেক্ষা করতাম পত্রিকার জন্য। পত্রিকা এলে গোগ্রাসে গিলতাম। এমনকি অনেক সময় পড়া ফাঁকি দিয়েও চুপি চুপি পড়তাম। পড়তাম আর স্বপ্ন সাজাতাম আগামীর জন্য।
এই সব গল্প খুব বেশি আগের না। দু’হাজার চার-পাঁচের। ইসলামি পত্রিকার তখন ছিল স্বর্ণসময়। আদর্শ নারীর জনপ্রিয়তার কথা এখন মনে পড়লে অবিশ্বাস্য লাগে। সাধারণ মানুষ দুর্দান্ত আগ্রহ নিয়ে পড়তেন। আব্বার যে কপিটা আসত, অন্তত বিশজন মানুষ ছিলেন এর পাঠক। লজিংবাড়ির বৌ-ঝিরা আব্বার কামরা থেকে পুরনো সংখ্যাগুলো নিয়ে পড়তেন। রহমতের পাঠক সে তুলনায় অনেক কম ছিলেন। তুলনামূলক বোদ্ধা পাঠক রহমত পাঠ করতেন। বিশেষত মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষক এবং মুসলিম বিশ্বের হাল-হাকিকত নিয়ে যাঁরা কিছুটা আগ্রহী তাঁদের জন্য রহমত ছিল নিদারুণ আগ্রহ ও প্রেরণার কাগজ। এই ক্যাটাগরির পাঠকের কাছে আবার আদর্শ নারী খুব একটা প্রিয় ছিল না। কিন্তু রহমতের সঙ্গে এক কপি আদর্শ নারী তাঁদের অধিকাংশেই খরিদ করতেন। রহমতের দাম ছিল ১২ টাকা। আর আদর্শ নারীর ১০ টাকা। দু’হাজার ছয়ের দিকে রহমতের দাম দুই টাকা বেড়ে হলো চৌদ্দ টাকা। এর কিছু দিন পর আদর্শ নারীরও দাম বেড়ে ১২ টাকা হয়ে যায়। তখন এক পাঠকের মন্তব্য আমার এখনও মনে আছে। বেচারা আদর্শ নারীর দাম বাড়ানোতে বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, ‘রহমত ২০ টাকা হলেও পড়ব, আদর্শ নারীতে এমন কী আছে যে, ১২ টাকা খরচ করে পড়তে হবে! বাদ দিলাম এ মাস থেকে আদর্শ নারী!’
আসলে আদর্শ নারী ছিল জনসাধারণের পত্রিকা, পত্রিকাকে সাজানোও হতো ওভাবে। আর রহমতের পাঠক ছিলেন সীমাবদ্ধ। একটু আগেই বলেছি, রহমত পাঠ করতেন বিশেষ চেতনায় সমৃদ্ধ কিছু বিশেষ মানুষ। কিন্তু এঁদের সংখ্যা নিতান্ত কম ছিল না। কোনো এক সংখ্যায় রহমত কর্তৃপক্ষের দাবি মতে অন্তত ২০ হাজার পাঠক ছিলেন রহমতের।
আদর্শ নারী এখন অনিয়মিত। অথচ এই ক’বছর আগেও এর যে জনপ্রিয়তা ছিল, বিস্ময় মানতে হয়। বেশ ক’বছর আগে এক সংখ্যায় তাদের এক পাঠকের জিজ্ঞাসা থেকে জেনেছিলাম পত্রিকাটির কাটতি ছিল দুই লক্ষাধিক। বর্তমানে দুই হাজারও আছে কি-না কে জানে। দারুণ সম্ভাবনাময় একটা পত্রিকা ছিল। মধ্যবিত্ত এবং নি¤œ মধ্যবিত্ত মানুষ এখান থেকে তাঁদের ধর্মীয় জিজ্ঞাসার খোরাক নিত। পাশাপাশি ছোটদের বিভাগ সবুজ কুঁড়ি থেকেও উঠে এসেছেন আজকের ইসলামি ঘরানার নামজাদা অনেক তরুণ লেখক। বছর কয়েকের ব্যবধানে পত্রিকাটির যে অধোঃগতি, এর দায়ভার কি আদর্শ নারী কর্তৃপক্ষ এড়িয়ে যেতে পারবেন?
আদর্শ নারীর এই দশার জন্য নানাবিধ কারণের মধ্যে অন্যতম একটা কারণ মনে হয় ডাক্তার জাকির নায়েকের অতিরিক্ত সমালোচনা। আদর্শ নারীর পাঠক যাঁরা তাঁদের সিংহভাগই সাধারণ মুসলিম। জাকির নায়েকের লেকচার তাঁরা নিয়মিত শোনেন। জাকির নায়েকের জন্য আলাদা একটা ভক্তি ও ভালোবাসা মজবুতভাবে গেঁথে গেছে তাঁদের ভেতর। আদর্শ নারী যখন ধারাবাহিকভাবে জাকির নায়েকের ঢালাও সমালোচনা ছাপা শুরু করল, তাঁরা জাকির নায়েকের ভক্তি ও ভালোবাসার ওপর আদর্শ নারীকে প্রাধান্য দিতে পারলেন না। এবং পারার কথাও না। জাকির নায়েকের আলোচনা খÐনের ভাষা ও কৌশলে যথেষ্ট ঘাটতি এর জন্য দায়ী। মূলত এ সিরিজ সমালোচনা ছাপার পর থেকেই শুরু হয়েছে পত্রিকাটির অধোঃগতি। পত্রিকাটি আদৌ কি এখন আর বের হয়?
রহমতের কথা মনে পড়লে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে বুক ফুঁড়ে। প্রতি মাসে কী নিদারুণ অপেক্ষা ছিল রহমতের জন্য! আদর্শ নারীর মতো রহমতের এত বিজ্ঞাপন ছিল না। দু’-চারটা প্রকাশনীর বইয়ের বিজ্ঞাপনই ছিল ভরসা। তাই প্রতি মাসে পত্রিকা ছেপে আনতে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হতো কর্তৃপক্ষকে। রহমতের পাঠক মাত্রই তা জানা ছিল। পাঠকের হাত পর্যন্ত পত্রিকা পৌঁছতে পৌঁছতে মাসের ১৫ তারিখ পার হয়ে যেত।
সবকিছু ছাপিয়ে রহমতের সম্পাদকীয়গুলো ছিল দুর্দান্ত। মনযূর আহমাদের অন্যান্য লেখা পড়লে অতটা স্বাদ পাই না, যতটা স্বাদ তিনি রহমতের সম্পাদকীয়তে ঢালতেন। এ যেন আলাদা এক উচ্চারণ, আলাদা এক শৈলী। বর্তমানকার ইসলামি পয়গামে সেই উচ্চারণের ছিঁটেফোঁটাও খুঁজে পাই না। অথচ একই কলমে একই মানুষই লিখতেন রহমতের সম্পাদকীয়। বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রে বছর দুয়েক আগে সম্পাদকীয়গুলো নিয়ে কথা হয়েছিল মনযূর আহমাদের সঙ্গে। সবগুলো সম্পাদকীয় নিয়ে পাÐুলিপি প্রস্তুত করবেন করবেন করেও তিনি নাকি আর করেননি। বই আকারে এলে পাঠক কতটা নেবে না-নেবেÑএই শঙ্কায়।
রহমত পড়তে পড়তে কিছু লেখকের নাম গেঁথে গিয়েছিল মনে। ইমতিয়াজ বিন মাহতাব, আবদুস সাত্তার আইনী, সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর অন্যতম। সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীরের ‘একদিন কবিতার মতো তোমার কাছে’ নামক একটি গদ্য এবং মুফতি আমিনীর নারীনীতি-বিরোধী আন্দোলনের সময়কার একটি কলাম ‘কাকে কয়েদখানার ভয় দেখাও’ আমাকে দারুণ প্রভাবিত করেছিল।
তারপর একদিন আর্থিক সমস্যায় যতটা না, তারচেয়ে বেশি কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় রহমত বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু রহমতের পাঠকরা আজও অপেক্ষা করেন এমন একটি পত্রিকার জন্য।
শূন্যের দশক ও চলতি দশকের সন্ধিক্ষণে মাসিক পত্রিকা করার একটা হিড়িক পড়ে গিয়েছিল। কোনো ধরনের আর্থিক ও আনুষাঙ্গিক ব্যবস্থাপনা ছাড়া শুধু স্বপ্নের ওপর ভর করে যে কেউ পত্রিকা বের করতে লেগে যেত। অনেক ক্ষেত্রে এসব পত্রিকার সম্পাদনা ও সেটআপ-গেটআপ কেবল হাসির জোগান দিত। আবার কোনো কোনো পত্রিকা গুণে-মানে ভালো হলেও আর্থিক সংকট কিংবা কর্তৃপক্ষের উদ্যমে ভাটা পড়ার কারণে দু’-এক সংখ্যা বের হবার পর আর কোনো খবর থাকত না। দু’হাজার এগারোতে একবার সিলেটের আঙ্গুরা-মুহাম্মদপুর মাদরাসার বার্ষিক মাহফিলে গিয়েছিলাম। মাহফিল উপলক্ষে বসা বইয়ের স্টলগুলোতে অভ্যাস মাফিক ঘোরাঘুরি করছিলাম। প্রায় সবক’টি স্টলেই চোখে পড়ল একটি পত্রিকা। মাসিক আদর্শ পুরুষ। আদর্শ নারীর অনুকরণ করতে গিয়ে নামের এই হাস্যকর দশা! মনে মনে হাসলাম অনেকক্ষণ। উদ্ভট নামের পত্রিকাটি একটু নাড়াচাড়া না করে মনের কৌতূহল দমাতে পারলাম না। এক কপি খরিদ করলাম। পাতা ওল্টাতেই দেখলাম সম্পাদকের ঘরে আঙ্গুরারই নামজাদা এক মুহাদ্দিসের নাম। মাওলানা ফয়জুল হাসান খাদিমানী। টুকটাক লেখালেখি করেন। আদর্শ পুরুষের আর কোনো সংখ্যা পরবর্তী সময়ে বেরিয়েছিল কি-না জানি না।
দু’হাজার দশে সিলেট থেকে আরেকটি পত্রিকা বেরিয়েছিল নোমান বিন আরমানের সম্পাদনায়। মাসিক কালকণ্ঠ। সচিত্র পত্রিকা। ইসলামি ঘরানায় তখন সচিত্র পত্রিকা করা রীতিমতো দুঃসাহসের ব্যাপার। নোমান বিন আরমান সেই দুঃসাহসটা দেখিয়েছিলেন। গুণে-মানেও বেশ ব্যতিক্রমী ছিল পত্রিকাটি। কিন্তু বেশি দিন টিকেনি। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই কালের গর্ভে হারিয়ে যায়। এর কিছুদিন পর রশীদ জামীলের সম্পাদনায় সিলেট থেকে আরেকটি পত্রিকার আবির্ভাব ঘটেছিল। কালান্তর। গায়ে গতরে এটাও বেশ অভিজাত ছিল। কিন্তু কয়েক সংখ্যা বের হবার পর হারিয়ে যায়। বর্তমান কালান্তর প্রকাশনী সেই কালান্তর পত্রিকারই বিবর্তিত রূপ।
মৌলভীবাজারের প্রখ্যাত বুজুর্গ খলিফায়ে মাদানি মাওলানা লুৎফুর রহমান বরুণী রহ.। আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলাম নামে তিনি একটি আধ্যাত্মিক সংগঠন গড়েছিলেন এই অঞ্চলের মানুষের ইসলাহ ও হেদায়েতের জন্য। মাসিক হেফাজতে ইসলাম নামে একটা পত্রিকাও চালু করেছিলেন সংগঠনটির মুখপত্র হিসেবে। তাঁর ইনতেকালের পর পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়। বেশ অনেক বছর বন্ধ থাকার পর ২০০৪ সালে নতুনভাবে আবার এর প্রকাশনা চালু করা হয়। লেখার মান, লেখক বাছাই অনেকটা আদর্শ নারীর অনুকরণে হলেও মোটামুটি ভালোই ছিল পত্রিকাটি। সিলেট অঞ্চলে ভালো একটা পাঠকপ্রিয়তাও পেয়েছিল। কোনো ধরনের বিজ্ঞাপন-নির্ভরতা ছাড়াই সংগঠনের নির্দিষ্ট একটা বাজেট থেকে পত্রিকার খরচ চালানো হতো। কিন্তু কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছার অভাবে বছর দুয়েক যেতেই পত্রিকাটি অনিয়মিত হয়ে যায়। এখন বোধহয় বছরে এক দুই সংখ্যা বের হয় দায়সারা গোছে।
সিলেটের আরেকটি পত্রিকা ছিল মাসিক তৌহিদী পরিক্রমা। সাবেক এমপি মাওলানা শাহীনূর পাশা চৌধুরী নিজে সম্পাদনা করে বের করতেন। মান খুব একটা ভালো না হলেও বের হতো নিয়মিত এবং স্থানীয়ভাবে মোটামুটি পাঠকপ্রিয়তাও ছিল। এখন বোধহয় আর বের হয় না।
উত্তরবঙ্গে একটি পত্রিকা উঠি উঠি করেও শেষ পর্যন্ত বিজ্ঞাপনের অভাবে মুখ থুবড়ে পড়েছে। পত্রিকাটার নাম কলমদানি। সালাহুদ্দীন মাসউদ সম্পাদনা করতেন। উত্তরবঙ্গের মাদরাসা-শিক্ষার্থীরা দারুণ আগ্রহ নিয়ে পড়ত। লিখতও। আর্থিক সংকটের কারণে সম্পাদকও এখন আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। বছর দুয়েক হবে বোধহয়, পত্রিকাটি আর বের হয়নি।
মাঝখানে দুই-চারবারের বিরতিসহ নবধ্বনি বের হচ্ছে এগারো বছর ধরে। ২০১৭ থেকে নবধ্বনি কাগুজে সংখ্যা করার পাশাপাশি পিডিএফ ভার্সনও প্রকাশ করছে। কাগুজে পত্রিকা বাজারে আসার আগেই পিডিএফ ভার্সন উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। ফলে প্রত্যন্ত অঞ্চল কিংবা দেশের বাইরের পাঠকরা সহজেই পেয়ে যাচ্ছেন পত্রিকাটি। স্মৃতির দাস্তান যখন মেলেছি, তো খানিকটা বলেই ফেলি নবধ্বনির সঙ্গে আমার সম্পৃক্ততার ইতিবৃত্ত। দু’হাজার নয় কি দশে এক চাচাতো ভাইয়ের কাছে প্রথম দেখি পত্রিকাটির দু’টো সংখ্যা। ছোট্ট অথচ কী স্বাপ্নালু! তার কাছ থেকে অনেকটা জোর করে নিয়ে আসি সংখ্যা দু’টো। তারপর বেশ অনেকদিন খোঁজাখুঁজি করেও নতুন কোনো সংখ্যা সংগ্রহ করতে পারিনি। মফস্বলের অজপাড়া কোনো গাঁ থেকে ঢাকার ছোট্ট একটি পত্রিকা সংগ্রহ করা একটু কঠিনই, বৈ কি!
দু’হাজার তেরোতে এসে ফেসবুকে পরিচয় তামীম ভাইয়ের সঙ্গে। প্রথমে তাঁর আইডি দেখে ভেতরে ভেতরে সে কী তোলপাড়! এতদিন ধরে যে পত্রিকা খুঁজে বেড়াচ্ছি, তার সম্পাদকের আইডি চোখের সামনে! বুঝতেই পারছেন অবস্থা! ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট কীভাবে পাঠিয়েছি নিজেই বলতে পারি না। একসেপ্ট হতে দেরি হয়নি। রাত তখন বারোটার কাঁটা পেরিয়ে গেছে। ইনবক্সে আলাপ জুড়লাম। কত কথা! কত প্যানপ্যানানি! নিজের ছোট্ট একটি পত্রিকা নিয়ে শত মাইল দূরের অজপাড়া গাঁয়ের এক তরুণের বাঁধভাঙা অমন উচ্ছ¡াস দেখে আপ্লুতই হলেন হয়তো তামীম ভাই। জড়িয়ে নিলেন অকৃত্রিম এক ভালোবাসায়। তারপর থেকে নিয়মিত আলাপ। ক’দিন পরে ছুটিতে এলেন দেশে। একরাতে অপরিচিত নম্বর থেকে কল। তামীম ভাই। কৃত্রিমতা বর্জিত শাদামাটা সম্বোধন। তখন রমজানের আগ মুহূর্ত। বললেন, রমজানের পর ঢাকা কোনো মাদরাসায় ভর্তি হতে। ঈদের পর বেশ কয়েক দিন তিনি দেশে আছেন। ভালো দেখে কোনো মাদরাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়ে যাবেন। আমি নিতান্ত ভীতু টাইপের লোক, তখন রাজি হয়েছিলাম ঠিক, কিন্তু ঈদের পর আর সাহস করতে পারলাম না।
পরের বছর রমজানে আবার তিনি দেশে এলেন। আবারও একই প্রস্তাব। ততদিনে আমার সাহস অনেকখানি বেড়ে গেছে। রাজি হয়ে ঈদের কয়েকদিন পর একা একাই উঠলাম ঢাকার বাসে। জীবনে প্রথম ঢাকা যাত্রা। দুরুদুরু বুক। তিনি ঠিকানা বলে দিলেন, বাস থেকে নেমে সোজা তাঁর বাসায়। পুরো বিকেল রিকশায় করে ঘুরলেন আমাকে নিয়ে। আমি রিকশায় বসে হাঁ করে কেবল মানুষের কর্মব্যস্ততা দেখছি। এটাই তাহলে ঢাকা শহর! কেউ কারও দিকে ফিরেও তাকায় না।
পরদিন ভোরে নিয়ে গেলেন ফরিদাবাদ। দিনমান অনেক খাঁটুনি খেটে ভর্তি করিয়ে দিলেন। তারপর আরও দুই বছর পার হয়ে গেল। ইনবক্সে টুকটাক আলাপ হতো, এই যা। হঠাৎ একদিন পেলাম আমার স্বপ্নের জায়গায় কাজ করার প্রস্তাব। নবধ্বনি। তারপর থেকেই এই সম্পৃক্তি।
মাসিক মদীনার কথা বলি। সত্যি বলতে কী, মাসিক মদীনা আজ অবধি ওভাবে পড়াই হয়নি আমার। কেন পড়িনি নিজেও ঠিক জানি না। পুরনো সংখ্যা বাসায় কয়েক গাদি আছে। আব্বা সেই ছাত্রজমানা থেকেই পত্রিকাটি পড়তেন। এখন কয়েক বছর ধরে কেন যেন কোনো পত্রিকাই পড়েন না। ইসলামি পত্রিকার সোনালি সময়ের যে সূচনা হয়েছিল, এর পূর্ণ কৃতিত্ব মাসিক মদীনার। যুগ বদলেছে, সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বদলেছে মানুষের চাহিদাও। অর্ধ শতাব্দীর বেশি কাল ধরে মাসিক মদীনা নিয়মিত বের হচ্ছে। কিন্তু পত্রিকার সেটআপ-গেটআপ-প্রচ্ছদ সবকিছুই কেমন গৎবাঁধা থেকে গেছে। আমার মনে হয় পত্রিকাটিকে এখন একটু নতুনভাবে সাজিয়ে নতুন মোড়কে পাঠকের সামনে নিয়ে আসা উচিত।
দু’ হাজার চার কি পাঁচে নতুন একটি পত্রিকার বিজ্ঞাপন দেখলাম আদর্শ নারীতে। শীঘ্রই আসছে পত্রিকাটি। মাসিক আল-কাউসার। দু’ মাস পরেই দেখি আব্বার টেবিলে এই নামে একটা পত্রিকা শোভা পাচ্ছে। তখন ঘোর কেবল আদর্শ নারী আর রহমত নিয়েই ছিল, তাই পত্রিকাটি আর খুলে দেখা হয়নি। হিফজ শেষ করে কিতাবখানায় ভর্তি হওয়ার পর থেকে নিয়মিত শুরু করি পড়া। আহলে ইলম এবং তালিবুল ইলমদের জন্য বাংলাদেশে এই একটি পত্রিকাই সবচেয়ে বেশি এবং কার্যকর পন্থায় আলো বিলিয়ে যাচ্ছে। পত্রিকাটি যেমন মুদ্রণ ও বানান প্রমাদ মুক্ত, তে¤িœ নীতি ও আপন আদর্শে অবিচল। ইসলামি পত্রিকার মধ্যে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি ও আশাবাঞ্জ্যক কাটতি এই পত্রিকার।
মাসিক নেয়ামত বাংলাদেশের সর্বপ্রাচীন এবং প্রথম ইসলামি পত্রিকা। মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী রহমতুল্লাহি আলায়হি নিজ সম্পাদনায় পত্রিকাটির সূচনা করেছিলেন। তাঁর ইনতেকালের পর বহু কাল বন্ধ ছিল এর প্রকাশনা। দু’ হাজার তেরো থেকে ঢাকার ফরিদাবাদ মাদরাসা নতুন আঙিকে আবারও বের করছে পত্রিকাটি। বিষয়বস্তু, লেখক বাছাই, বানান, ম্যাকাপ, প্রচ্ছদÑসবদিক দিয়ে মানসম্মত করে পত্রিকাটি আলো ছড়াচ্ছে কয়েক বছর ধরে।
মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসউদের মাসিক পাথেয় বের হয় নিয়মিত। কিন্তু সর্বজন শ্রদ্ধেয় কিছু ব্যক্তিত্ব নিয়ে পাথেয়-এর নোংরা দু’টো প্রতিবেদন মর্মাহত এবং ক্ষুব্ধ করেছে ইসলামি ঘরানার পত্রিকা পাঠকদের।
ইসলামিয়া কুতুবখানা বছর দিন হলো পত্রিকা করছে। মাসিক ইসলামি পয়গাম। সম্পাদক মনযূর আহমাদ। রহমতের মনযূর আহমাদ। কিন্তু রহমতের জৌলুশ আর কোনো পত্রিকা ধারণ করা কি অতো সহজ? ইসলামি পয়গামে বিষয় ভিত্তিক ভালো মানের লেখা থাকে প্রতি মাসে। লেখক বাছাইও চমৎকার। ম্যাকাপ-প্রচ্ছদ প্রথম কয়েক সংখ্যায় ভালো হয়েছিল। পরের সংখ্যাগুলোতে সেই মান আর ধরে রাখতে পারেনি। বানান বিভ্রাটও থাকে প্রচুর। রোজা ঈদে বৃহৎ কলেবরে ঈদ সংখ্যা করেছিল। হাতে নিয়ে বেশি দূর এগোতে পারিনি। ম্যাকাপ-প্রচ্ছদ চমৎকার করে রাহমানী পয়গাম। লেখাও মোটামুটি ভালো। ভালো লেখক থাকেন প্রায় প্রতি সংখ্যায়।
এ ছাড়াও চট্টগ্রাম থেকে মাসিক আত-তাওহীদ, হাটহাজারী থেকে মাসিক মঈনুল ইসলাম, ঢাকা যাত্রাবাড়ী থেকে মাসিক আল-জামেয়াসহ এখনও কিছু কিছু পত্রিকা নিয়মিত বের হচ্ছে, কিন্তু শূন্যের দশকে ইসলামি পত্রিকা জগতে যে উচ্ছ¡াস সৃষ্টি হয়েছিল, এই দশকে এসে তা একেবারে চুপসে গেছে। অনলাইনভিত্তিক লেখালেখি অনেকটাই ম্লান করে দিয়েছে পত্রিকার আবেদন। এই অনলাইন-নির্ভরতা কতটা কল্যাণকর আমাদের জন্য আর কতটা আনন্দ ও সুখময়, তা সময়ই বলে দেবে।
সেপ্টেম্বর ২০১৮