মাগরিব পড়েই দোদুল্যমান ভাব নিয়ে তাকালাম পশ্চিমাকাশের দিকে। ঈদের চাঁদ দেখার জন্য। এমন সময় মসজিদের পশ্চিম কোণ থেকে ছেলেরা হৈ-হুল্লোড় দিয়ে উঠল ‘চাঁদ দেখা গেছে, চাঁদ দেখা গেছে’ বলে। ঈদের সংবাদ! তার মানে কালই ঈদ হবে। আকাশের দিকে আমার আর তাকানোর দরকার নেই। সাত-পাঁচ না ভেবে হাঁটা ধরলাম বাড়ির পথে। এমন সময় মসজিদের মিনার থেকেও ভেসে এলো চাঁদ দেখার সংবাদ। গ্রাম দেশে এই নিয়মটা অনেক আগ থেকে চলে আসছে।
শৈশব-কৈশোরের দিনগুলোতে ঈদ এলে ঈদের আগের দিন সন্ধ্যার পর মসজিদের মিনার থেকে ঈদের বার্তা না এলে পরদিনের ঈদটাকে মেনে নিতে প্রায়ই দ্বিধা-দ্ব›েদ্ব পড়তাম। কারণ, তখন শুধু চাঁদ দেখে অতোটা বুঝতাম না যে কোনটা ঈদের চাঁদ আর কোনটা প্রতিদিকার চাঁদ। আমাদের বাড়ির পশ্চিমে পুকুর। পুকুরপাড়ে গিয়ে বড় চাচার ‘দূরবীন’ দিয়ে সমবয়েসি চাচাতো ভাইবোন সবাই পালা করে ঈদের চাঁদ দেখতাম। বড় চাচা ওই একদিনই কেবল তার দূরবীনটা বের করতেন। প্রবাস থেকে এনেছিলেন। খুব যতনে রাখতেন। আমরা ছোটরা চাঁদ দেখার ছুঁতোয় ওই একদিনই কেবল সেটা হাতে নিতে পারতাম।
সবাই চোখে চোখে এক দু’বার দূরবীন লাগিয়ে ঈদের চাঁদ দেখত। তারপর দেখে দেখে বলত, ‘ঈদের চাঁদ দেখেছি।’ বড়াপ্পি, ছোটাপ্পি, বড়দা, ছোট চাচাÑসবাই দেখেছে, আমি কীভাবে বলি, আমি যে চাঁদ দূরবীন দিয়েও দেখিনি! তাই না দেখলেও শরমে অদেখার রহস্যটা গোপন রাখতাম। সবার আনন্দের সঙ্গে আমিও আনন্দে নেচে উঠতাম। তারপর চাঁদ দেখা শেষ হলে ঘরে ফিরতাম। রাত জেগে অপেক্ষা করতাম পরদিনের ঈদের। সেই সঙ্গে দূরবীন নিয়ে চলত নানা গবেষণা।
রাতজাগার যতই কোশেশ করি, পারতাম না, একসময় আপনাতেই ঢলে পড়তাম ঘুমের কোলে। তবে ঘুমোনোর আগে আম্মাকে বলতাম শেষ রাতে যেন জাগিয়ে দেন। ঈদের গোসল করতে হবে বাড়ির সব ছেলেমেয়ের আগে। এ নিয়ে ছিল মারাত্মক প্রতিযোগিতা। কে কার আগে ঈদের গোসল করতে পারে! বাড়িতে ছোট ছেলেমেয়েদের মধ্যে আমরা ছিলাম দুই গ্রæপ। আমাদের বড় বাড়ি। উত্তর অংশ এক গ্রæপ, দক্ষিণ অংশ এক গ্রæপ। আমরা ছিলাম দক্ষিণ গ্রæপ। প্রতিযোগিতা থাকত প্রধানত এই দুই গ্রæপে। কোন গ্রæপ কার আগে জেগে গোসল করতে পারে!
ফজরের আগে আগে গোসলকার্য সমাধা করে এক গ্রæপ আরেক গ্রপের সঙ্গে বিতর্কে অবতীর্ণ হতাম। দুই গ্রæপই প্রায় একই সময়ে গোসল করতাম, তারপরও কারা আগে করেছে তা নির্ণয় করার জন্য বাঁধত তর্ক। দু’-একজনের মধ্যে কখনো হাতাহাতিও লেগে যেত। হায়, কোথায় গেল সেই সোনালি দিনগুলো! সেই সোনালি শৈশব!
এখনকার যারা শিশু-কিশোর আমাদের বাড়িতে, তাদের মধ্যে সেই প্রবণতা আর চোখে পড়ে না। ঈদের দিন গোসল করতে পুকুরপাড়ে গিয়েছি একা। সমবয়েসি কেউ নেই। চাচাতো ভাইবোন যারা ছিল, তারা এখন শহরের বাসিন্দা। ঈদে-চাঁদেও আর গ্রামে আসা হয় না তাদের। একা একাই গোসল করেছি। নিরানন্দ ঈদ। নিরানন্দ গোসল। বুকের ভেতর ফুঁড়ে তপ্ত একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। দীর্ঘশ্বাসে স্মৃতিপোড়া গন্ধ।
সেপ্টেম্বর ২০১৮