কয়েকটা বিচ্ছিন্ন গল্প বলি, সত্যি গল্প।
একটা ছেলে ভীষণ খামখেয়ালি, দেশসেরা বুয়েটে চান্স পেয়ে বসে আছে সে। অথচ খেয়াল নেই সেখানে ভর্তি কবে। ক’দিন পর তার মনে হলো, আজ মনে হয় ভর্তির দিন। এক বন্ধুকে ফোনে ডেকে নিয়ে গেল বুয়েটে। গিয়ে শুনে, ভর্তি শেষ এবং ভর্তি হওয়া সর্বশেষ মেধাক্রম ৮৭, আর তার নিজেরটা ৬০। এমন একটা অবস্থায় যে কারো সাথে দেখা হলেই কপালে জুটবে ভীষণ বকাঝকা, সাহায্য পাওয়া নিয়ে জমবে বিস্তর সন্দেহ। সেই ছেলে দেখা করলো ভর্তি কমিটির প্রধানের সাথে, তিনি তাকে কোনো বকা তো দিলেনই না, উল্টো আশ্বাস দিলেন। ছেলেটি নাম, রোল লিখে দিয়ে গেল, ক’দিন অপেক্ষা করল, কেউ একজন ভর্তি বাতিল করল, ফাঁকা আসনটায় সে ভর্তি হয়ে গেল। অপেক্ষার কয়েকটা দিন সে রোজ একবার করে বুয়েটে যেত, খোঁজ-খবর নিত। ভর্তি কমিটির সেই প্রধান তাকে অভয় দিলেন, আপনার রোজ রোজ আসা লাগবে না, কিছু হলে আমিই আপনাকে জানাব। তিনি জানিয়েছিলেনও। ছেলেটি ভর্তি হতে পেরেছিল শেষ পর্যন্ত।
আরেকটা গল্প।
উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষে একটি ছেলে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ আর বুয়েট, দু’জায়গায়ই ভর্তির সুযোগ পেল। মেডিক্যাল কলেজে সাধারণত আগে আগে ক্লাস শুরু হয়। তো ছেলেটি গেলো সেখানে ক্লাস করতে। তার পায়ে স্পঞ্জের স্যান্ডেল। প্রথমদিন ক্লাসে ম্যাডাম তাকে বললেন স্পঞ্জের স্যান্ডেল পরে ক্লসে আসা যাবে না। এদিকে ছেলেটি স্পঞ্জের স্যান্ডেলই পায়ে দেয় সবসময়, তার যে আর্থিক সঙ্গতি নেই, তা নয়। সে সাদাসিধে জীবনযাপন করে। স্পঞ্জকে সে ছাড়তে পারল না, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজই ছেড়ে দিল, বুয়েটে এসে ভর্তি হলো এরপর।
ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের অধীনে কয়েকটা বিদ্যুৎ প্রকল্প চলছিল একবার। পরামর্শের জন্য এর একজন কর্মকর্তা যোগাযোগ করলেন দেশসেরা এক ইঞ্জিনিয়ার অধ্যাপকের সাথে। তিনি রাজি হলেন সহায়তা করতে, তবে শর্ত দিলেন বিনিময়ে কোনো টাকা নেবেন না। ইডকলের কর্মকর্তা অবাক তো হলেনই, সাথে জোর দিলেন, কাজটা প্রতিষ্ঠানের, ব্যক্তিগত নয়। টাকা কেন নেবেন না? সেই ইঞ্জিনিয়ার উত্তর দিলেন, অধ্যাপনা করে আমি যে টাকা পাই, তা-ই খরচ হয় হয় না। আরো টাকা নিয়ে আমি কী করব?
সেই অধ্যাপকের কক্ষে একটা খোলা ড্রয়ারে টাকা থাকতো সবসময়। যার যখন দরকার, তার জন্য অবারিত দ্বার। তাঁকে দেখলে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার রিকশাওয়ালাদের মধ্যে হুড়োহুড়ি লেগে যেতো কে তাঁকে রিকশায় উঠাবে। কারণ তিনি গুণে গুণে ভাড়া দিতেন না। পকেটে হাত দিয়ে যা পেতেন, সবটুকু দিয়ে দিতেন।
একটা ফ্রিজ ছিল তাঁর রুমে। সেই ফ্রিজ ভর্তি নানাধরনের খাবারদাবারে। তাঁর রুমে গিয়ে না খেয়ে কেউ ফিরতে পারত না। কোনো ছাত্র হয়তো থাকার জায়গা পাচ্ছে না, তিনি নিজের বাসার দরজা খুলে দিতেন অনায়াসে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাগারের কোনো যন্ত্রপাতি হয়তো নষ্ট, তিনি হাতুড়ি নিয়ে নিজেই কাজে নেমে যেতেন, একজন অধ্যাপক হয়েও। নিজের পকেটের টাকা খরচ করে জিনিসপত্র কিনতেন পরীক্ষাগারের জন্য, কারণ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে টাকা অনুমোদন করানোর দৌড়াদৌড়ি তাঁকে দিয়ে হবে না।
তড়িৎ প্রকৌশল বিভাগের শিক্ষক ছিলেন তিনি। বিদেশে পড়তে যাওয়ার জন্য ছাত্র-ছাত্রীদের প্রশংসাপত্র লাগে। নিজের বিভাগের ছাত্র-ছাত্রীদের তিনি কোনোরকম হয়রানি ছাড়াই পরম আন্তরিকতায় এই পত্র লিখে দিতেন। অন্য শিক্ষকেরা হয়তো বলতেন, তুমি নিজেই লিখে নিয়ে আসো, আমি দেখে সাইন করে দেব। আর এই অধ্যাপক বলতেন, নাম, রোল লিখে দিয়ে যান, অমুক দিন এসে নিয়ে যাবেন। লো সিজিপিএ পাওয়া ছাত্রের প্রশংসাপত্রও তিনি লিখে দিতেন প্রশংসা করেই, বুয়েটে চান্স পাওয়াই যে একটা বিশাল ব্যাপার, সে কথা মুখ্য করে। যাতে করে বিদেশে সে গুরুত্ব পায়।
আরেকটা গল্প।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা থেকে অবসর নেওয়ার নির্ধারিত সময়ের এক বছর আগেই অবসর নিতে চাইছেন একজন অধ্যাপক। কারণ? কারণ তাঁর স্কুলে বয়স একবছর কমিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। সত্যিকারে তাঁর অবসর নেওয়ার বয়স একছর আগেই, তাই।
ভর্তি কমিটির প্রধান, স্পঞ্জ ছাড়তে না পারা সেই ছাত্রটি আর এই অধ্যাপক, তিনজন আসলে একজন মানুষই, মোহাম্মদ আলী চৌধুরী, সংক্ষেপে যাঁকে বলা হয় ম্যাক স্যার।
১৯৫৬ সালের জানুয়ারি মাসের ২ তারিখ জন্ম তাঁর। চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল ও ঢাকা কলেজ থেকে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন, প্রথম শ্রেণীতে। বুয়েটের তড়িৎ কৌশল বিভাগ থেকে অনার্স, মাস্টার্স করেন। ১৯৮০ সালে বুয়েটেই যোগ দেন প্রভাষক হিসেবে, এরপর অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর, অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর হন ১৯৯৩-এ আর অধ্যাপক হন ১৯৯৬-এ। মাঝে ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৯ সালের মধ্যে কানাডায় উচশিক্ষা গ্রহণ করে পিএইচডি শেষ করেন। অ্যাকাডেমিক সাফল্যে তিনি অতুলনীয়, যার ছাপ পড়তো তাঁর নেওয়া ক্লাসগুলোয়। মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাঁর লেকচার শুনতো শিক্ষার্থীরা। কখনোই উপস্থিতি নেওয়া লাগতো না তাঁর, কারণ ক্লাসে থাকতো উপচে পড়া ভীড়। এমনকি অন্য বিভাগের শিক্ষার্থীরাও নিয়মিত তাঁর ক্লাস করতে চলে আসতো।
এ বছরের জানুয়ারির ২৯ তারিখ তিনি চলে গেছেন, অন্য পারে। ২০০৭ থেকে কোলন ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলেন তিনি।
বুয়েট ইসিই ভবনের ১২২ নাম্বার রুমে থাকতেন চিরকুমার এই মানুষটি। সাদাসিধে পোশাক, সাধারণ চলাফেরার অসাধারণ এই অধ্যাপককে নিয়ে তাঁর দীর্ঘদিনের সহকর্মী, বুয়েটের সিএসই বিভাগের অধ্যাপক কায়কোবাদ স্যার লিখেছেন, ‘তাঁর রোজনামচা অসাধারণ। ফজরের নামাজ পড়েই অফিসে চলে আসেন। দেশি কিংবা অতিথি পাখির খাবার ব্যবস্থা করা, চারা গাছে পানি দেওয়া, লেখালেখি, কম্পিউটারে কাজ, ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর নানা বই ডাউনলোড করে লাইব্রেরিতে দেওয়া, ক্লাসে যাবার আগে পুরো বক্তৃতা স্বহস্তে লেখা, সমস্যা সমাধান করা। এর মাঝে বাজার ভ্রমণ করা এবং দিন শেষে রাত ৯/১০টার দিকে বাসায় ফেরা। সারাদিন, সপ্তাহে সাত দিন, বছরে ৫২ সপ্তাহ। এর মধ্যে ছেদ ঘটেছে কেবল নিকটতম পারিবারিক সদস্যদের ইহলোক ত্যাগের কারণে। এই রোজনামচা চলছে বিগত ২৭/২৮ বছর ধরে, এক বছর দুই বছর ধরে নয়। আমিও যদি কখনও সকালে অফিসে আসি, ফলের রস থেকে চানাচুর ও অন্যান্য লোভনীয় খাবার স্বহস্তে পরিবেশন করেন। আমার অফিসে শ’দুয়েকের বেশি এককালীন ব্যবহার্য যে গøাস সবই তার দেওয়া, ফলের রসসহ। আমার অফিসে এসে যদি দেখতে পান আরও চার/পাঁচজন ছাত্র বসে আছে তবে সবার জন্যই কিছু খাবার ব্যবস্থা করেন। এটা হলো শিক্ষার জন্য প্রণোদনা- শেখার জন্য, শেখানোর জন্যও। তবে কোনোক্রমেই তাঁকে আপ্যায়ন করা সম্ভব নয়। প্রতি ধর্মীয় উৎসবে সুবিধাবঞ্চিত দারিদ্র্য নিপীড়িত লোকদের রিকশা কিনে দিতেন যাতে তারা স্বাবলম্বী হয়। অনেকেই এই সুযোগের অপব্যবহার করেছে। তাই এখন অর্ধশতক রিকশাওয়ালাকে ধর্মীয় উৎসবে এককালীন অর্থ প্রদান করেন। আমার যেকোনো আগন্তুক তাঁর সম্মানিত অতিথি এবং সকল অতিথিকেই মাত্রারিক্ত আপ্যায়নে রীতিমতো তাঁর কাজ সম্পর্কে সন্দেহে ফেলে দেন। তবে এই আতিথেয়তা, বিনয় তাঁর চরিত্রের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটা তাঁকে কখনো চিন্তা-ভাবনা করে করতে হয় না। নানা স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগেছেন, অনেক ছাত্র ও শুভাকাক্সক্ষী থাকা সত্তে¡ও কারো মুখাপেক্ষী কখনও হননি। কোনো বিষয়েই তেমন কোনো অভিযোগ নেই কারো প্রতি। দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত, কঠিন অপারেশন, কেমোথেরাপি দিতে বুয়েট থেকে এপোলো হাসপাতালে যেতেও প্রাতিষ্ঠানিক অ্যাম্বুলেন্স ব্যবহারে অনীহা ছিল। কারণ, অধিকতর প্রয়োজনে অন্য কেউ ব্যবহার করতে পারবে। নিজের অসুবিধা নিয়ে ভাবনা নেই, অন্য সবার অসুবিধা নিয়ে চিন্তিত। অসংখ্য যুবক-যুবতীর জীবন কাছে এনেছেন, নিজেকে আজীবন অকৃতদার, সকল প্রলোভনের ঊর্ধ্বে, পার্থিব ভোগমুক্ত রেখেই।’
¯্রােতের বিপরীতে চলা বুঝি একেই বলে। বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে এরকম শিক্ষক, সাদা মনের মানুষ আরো আছেন কি না জানি না, হয়তো আছেন, অথবা নেই। এরকম আদর্শ, জীবন্ত কিংবদন্তী সকল শিক্ষকের প্রতি লাল সালাম।
মোহাম্মদ আলী চৌধুরী স্যারের জন্য পরম করুণাময়ের কাছে প্রার্থনা।
নবধ্বনি, মার্চ ২০১৮