শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে ঢুকে ছাত্রদের সালাম দিলেন। ছাত্ররা সালামের উত্তর দিলো। তখনই এক কোণ থেকে একটি ছাত্র দাঁড়ালো। নাম তার মুহাম্মদ।
শিক্ষক : মুহাম্মদ! কী হয়েছে?
মুহাম্মদ : মাদরাসার দরোজায় এক বৃদ্ধকে দেখেছি। আমি খরচার টাকা থেকে তাকে কিছু দেবো। কিন্তু খালিদ আমাকে বারণ করছে। বলেÑ‘গরিবদের দিও না। কারণ এ ব্যাপারে তোমাকে জিজ্ঞেস করা হবে না।’
শিক্ষক : খালেদ বলতে ভুল করেছে। কারণ ছোটো-বড়ো, পিতাপুত্র সবাইই গরিবদের দান করবে।
* * * * * * * * * *
এরপর শিক্ষক বøাকবোর্ডে কিছু মানুষ ও একটি বাগানের ছবি আঁকলেন। তারপর ছাত্রদেরকে বললেনÑ‘এখন তোমাদের কাছে একটি বাগান ও কিছু গরিবলোকের গল্প বলবো।’ এ কথা বলে তিনি নিজের আসনে ফিরে এলেন। তারপর ধীরে ধীরে গল্প বলা আরম্ভ করলেনÑ
শোনো!
বহুকাল আগের কথা। ইয়ামেনে বাস করতেন বুড়োমতোন একটি লোক। যিনি বেশ সৎ ছিলেন। তার ইয়া বড়ো একটি বাগান ছিলো। যা হরেক রকমের ফলফলাদির গাছপালায় ভরপুর ছিলো। তিনি রোজ ভোরে নিয়ম করে বাগান দেখতে যেতেন। বাগানের পাহারাদারকে সঙ্গে করে ফলফলাদি ছিঁড়তেন। এরপর সেগুলো গরিবদের মাঝে বিলোতেন। কোনো এক সকালে তাই করলেন। এরপর পাহারাদারের কাছে বাগানের খুঁটিনাটি জানতে চাইলেনÑ
সৎলোক : বাগান এবং ফলফলাদির খবর কী?
পাহারাদার : ভালো, আলহামদুলিল্লাহ। ফল তো পেকে মাটিতে পড়ে যাবে, এমন অবস্থা।
সৎলোক : ফল কাটা যায় কখন?
পাহারাদার : আল্লাহ চাইলে আগামীকাল কাটতে পারি।
সৎলোক : খুব সকালে আমি শ্রমিকদের নিয়ে বাগানের দরোজায় উপস্থিত হবো, তারা ফলফলাদি কাটবে।
* * * * * * * * * *
সৎলোকটি বাড়ি ফিরে গেলেন এবং তার তিন ছেলেকে ডাকলেনÑ
ছেলেরা : বাগানের ফলফলাদি কবে কাটবো?
লোকটি : আল্লাহ চাইলে আগামীকাল, ইনশাআল্লাহ।
এরপর লোকটি তার বড়ো ছেলেকে বললেনÑ‘শ্রমিকদের কাছে গিয়ে বলো, আগামীকাল খুব ভোরে বাগানের দরোজার সামনে আব্বাজান তোমাদের ডেকেছেন।’
বড়ো ছেলে : ঠিকাছে, আর কিছু?
লোকটি : না।
তারপর…
লোকটি মেজো ছেলেকে ডাকলেন। বললেনÑ‘তুমি গ্রামের গরিবদের কাছে যাও। গিয়ে বলো, আগামীকাল খুব সকালে বাগানের দরোজার সামনে আব্বাজান তোমাদের উপস্থিত হতে বলেছেন।’
মেজো ছেলে : বাবা! গরিবদের আসতে কেনো বলবো?
বাবা : তাদের ভাগ নেওয়ার জন্য।
মেজো ছেলে : তাদের ভাগ? কীসের ভাগ?
বাবা : হ্যাঁ, তাদের ঐ ভাগ, যা আল্লাহ তাদের জন্য ধনীদের ওপর ফরজ করেছেন।
ছেলে : আমাদের ফলফলাদিতে তো তাদের কোনো ভাগ নেই।
বাবা : বেটা! এই ধনসম্পদ আল্লাহতায়ালার দান। আল্লাহ আমাকে ও আমার মতো অনেক ধনীকে নিরাপত্তাস্বরূপ দিয়েছেন। যেনো গরিবদেরকে তাদের হক বুঝিয়ে দিতে পারি।
* * * * * * * * * *
এরপর…
বাবা তার ছেলেদের জিজ্ঞেস করলেনÑ‘তোমরা যদি গরিব হতে, আর ধনীরা তাদের ফলফলাদি থেকে তোমাদের না দিতো, তাহলে তোমরা তা পছন্দ করতে?’
তারা চুপ রইলো।
* * * * * * * * * *
সকাল সকাল সৎলোকটি ও তার ছেলেরা বাগানে গেলো। শ্রমিক ও গরিবদেরকে বাগানের দরোজায় উপস্থিত পেলো।
সৎলোক : স্বাগতম, তোমরা সময়মতো উপস্থিত হয়েছো।
* * * * * * * * * *
শ্রমিকরা ফলফলাদি কাটা শুরু করলো। কাজ শেষে সৎলোকটি তাদেরকে পারিশ্রমিক দিলেন। গরিবদের মাঝে ফলগুলো ভাগ করে দিলেন।
এরপর বললেন : জাবের কোথায়?
বড়ো ছেলে : জাবের কে?
বাবা : আমাদের এক গরিববন্ধু। সে তার ভাগ নেয় নি।
গরিবরা বললো : সে তার বাড়িতে আছে, অসুস্থ।
বাবা : আল্লাহ তাকে সুস্থ করে দিন।
* * * * * * * * * *
এরপর সৎলোকটি জাবেরের ভাগ নিজ কাঁধে নিলেন।
ছেলেরা : বাবা! আপনি কী করেন?
বাবা : আমি অসুস্থ জাবেরের হক তার নিজ হাতে দিয়ে আসবো।
ছেলেরা : আপনার নেওয়ার দরকার নেই, আমরাই নিয়ে যাচ্ছি।
বাবা : আমিই নেবো, কারণ কেয়ামতের দিন এ ব্যাপারে আমাকেই জিজ্ঞেস করা হবে।
* * * * * * * * * *
সৎলোকটি অসুস্থ জাবেরের ভাগ নিয়ে তার ঘরের দরোজায় হাজির হলেন। সালাম দিলেন। দরোজা খুলে দেওয়া হলো। জাবেরের ভাগ তার হাতে দিলেন।
* * * * * * * * * *
এভাবে বহুদিন কেটে গেলো। একদিন এই সৎলোকটি ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। আত্মীয়স্বজন ও গরিব লোকেরা তাকে দেখতে এলো। কিন্তু তার রোগ কমলো না আর। অবশেষে কোনো এক ভোরে তিনি মারা গেলেন। তার আত্মা স্বস্তিতে আকাশে উড়ে গেলো।
* * * * * * * * * *
এক রাতে তার ছেলেরা নানা বিষয়ে কথা বলছিলোÑ
বড়ো ছেলে : বাগানের ফলফলাদি কাটার ব্যাপারে আমি বাবাকে বারণ করেছিলাম।
মেজো ছেলে : হ্যাঁ, আমরা দুয়েক দিন পরেই কাটতে পারতাম।
ছোটো ছেলে : আমরা গরিবদের ব্যাপারে কি করতে পারি? তারা কি প্রতিবারই ফলফলাদির ভাগ নেবে?
বড়ো ছেলে : আমি এটা চাই না। তাদের ব্যাপারে কি করা যায়?
ছোটো ছেলে : ফলফলাদির কিছুই তাদের দেবো না। বরং তাদের বাগান থেকে তাড়িয়ে দেবো। যদি তারা না বেরোয়, তাহলে প্রচুর মারধর করবো।
মেজো ছেলে : আমার কাছে একটা আইডিয়া আছে।
বড়ো ছেলে : কী?
মেজো ছেলে : ফল কাটার দিন আমরা গরিবদেরকে বাগানে পাঠাবো না। এ বিষয়ে তাদেরকে কিছু জানাবোই না। ঘুম থেকে সবাই জাগার আগে সকাল সকাল আমরা ফল কাটতে যাবো। কাটা শেষে টুপড়ি ভরে বাজারে সব বেচে দেবো।
ছোটো ছেলে : বাহ, দারুণ আইডিয়া তো!
বড়ো ছেলে : সঠিক বুদ্ধি, এটা করলেই ফলফলাদির সম্পদ আমাদেরই। কাউকে ফল কাটার টাকাও দেবো না। এমনকি ফলও না।
* * * * * * * * * *
এসব বলে তারা খুব হাসাহাসি করতে লাগলো। এবার মেজো ছেলে মুখ খুললো।
মেজো ছেলে : এখন থেকে আমাদের সম্পদে গরিবদের কোনো ভাগ নেই।
ছোটো ছেলে : তারা আমাদের একটি ফলও নিতে পারবে না।
বড়ো ছেলে : আমরা এমন হাড়কিপটে হবো যে, ফল তো দূরের কথা, গাছের একটি পাতাও ছুঁতে দেবো না।
* * * * * * * * * *
পরদিন।
কে কী করবে, বসে বসে ছেলেরা ভাবতে লাগলো।
বড়ো ছেলে : বাগানের ফলফলাদি আগামীকাল জমা করবো।
মেজো ছেলে : চলো, বিছানায় যাই; যাতে সকাল সকাল উঠতে পারি।
* * * * * * * * * *
সবাই নিজ নিজ রুমে গেলো। দেরি না করে একে একে ঘুমিয়ে পড়লো। এদিকে আল্লাহতায়ালা আসমান থেকে আগুন পাঠালেন; যা তাদের বাগানের গাছপালা-ফলফলাদি পুড়িয়ে ছারখার করে দিলো। কয়লার টুকরো বাদে অবশিষ্ট কিছুই রইলো না। ফজরের আগেই তিন ছেলে ঘুম থেকে জাগলো। কুঠার হাতে বাগানের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো।
পথ চলতে চলতে দুজনে কথা বলছিলোÑ
বড়ো ছেলে : তোমরা আওয়াজ বড়ো না করে চুপিসরে কথা বলো, যাতে গরিবরা কেউ না বুঝতে পারেÑ তারা বঞ্চিত।
ছোটো ছেলে : আপনি সত্য বলেছেন। আমরা ফিসফিস করে কথা বলবো।
* * * * * * * * * *
তারা অন্ধকারে পথ চলতে চলতে বাগানের দরোজায় এসে পৌঁছুলো। বড়ো ছেলে বাগানের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে ওঠলো।
বললো : এ কী!?
মেজো ছেলে : বাগান তো পুড়ে গেছে।
ছোটো ছেলে : বাগান তো পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে।
বড়ো ছেলে : এটা আল্লাহর শাস্তি, আমরা নাফরমান।
ছোটো ছেলে : আল্লাহ আমাদের জন্য বাগান হারাম করে দিয়েছেন, যেমন আমরা গরিবদের বাগানের ফলফলাদি থেকে বঞ্চিত রখেছি।
মেজো ছেলে : আমাদের ওপর আল্লাহর আজাব আসার আগে তার কাছে মাফ চাই। চলো, তার প্রশংসা আদায় করি। আমরা নিজেদের ও গরিবদের ওপর জুলুম করেছি।
এরপর…
একসঙ্গে সবাই বলে উঠলো : সুবহানাল্লাহ। হে আল্লাহ! আপনি আমাদের ক্ষমা করে দিন। আমাদের তওবা কবুল করুন। নিশ্চয়ই আপনি তওবা কবুলকারী, পরম করুণাময়।
তারপর…
তারা নিজের প্রতি দোষারোপ করতে লাগলো।
বড়ো ছেলে মেজো ছেলেকে বললো : তুই এই বুদ্ধি দিয়েছিস।
মেজো ছেলে : তোমরা দুজন তো এই বুদ্ধির সঙ্গে একমত ছিলে।
ছোটো ছেলে : তোমরা ইখলাসের সঙ্গে আল্লাহর কাছে তওবা করো। আমাদের অনুতাপ ও সত্যিকারের তওবার কারণে আল্লাহ আমাদেরকে এর চেয়ে উত্তম আরেকটি বাগান দেবেন, ইনশাআল্লাহ।
* * * * * * * * * *
তারা তওবা-ইস্তেগফার করতে লাগলো। অবশেষে আল্লাহতায়ালা তাদের তওবা কবুল করলেন। তাদেরকে ফলে ভরা এমন একটি বাগান দিলেন, যার একটি ফলের বোঝা শক্তিশালী ঘোড়াও বহন করতে পারতো না।
আল জামিআতুল ইসলামিয়া ইসলামপুর, গোপালগঞ্জ
ডিসেম্বর ২০১৮ সংখ্যায় প্রকাশিত