শীতের সকাল। বাতাসে হিম হিম ঠান্ডা ভাব। চারদিকে কুয়াশা ঘেরা। ঘাসের ডগায় শিশিরবিন্দু। গাছের ঝরা পাতার মর্মর ধ্বনি। কনকনে শীতে জবুথবু একটি গ্রামের ভোর আমি খুব কাছ থেকেই দেখেছি। শৈশবে গ্রামে শীতের এক আলাদা অনুভূতি অনুভব করেছি। দেখেছি কুয়াশায় আচ্ছন্ন ভোরে বাড়ির পশ্চিম পাশের বিশাল পুষ্পিত সরিষাক্ষেত, সবুজ রং ধরা গমক্ষেত, টমেটো, কাঁচা মরিচের ক্ষেতসহ আরো কত কি। কুয়াশাচ্ছন্ন আকাশ ভেদ করে পূর্বদিকে সূর্যের আলো উঁকি দিয়ে ফুটে ওঠা মিষ্টি রোদে স্নান করার সেই অনুভূতি আমি আজও ভুলিনি।
ভোরের কাঁচা রোদ-হিমেল হাওয়া প্রাণে তুলে শিহরণ।শীতে প্রকৃতি নিজেকে মেলে ধরে নতুন রূপে। কুয়াশার আচ্ছন্নতা ঘিরে রাখে চারিধার—দিনের সূর্য ঢেলে দেয় মায়াবী রোদ। রাতের রুপালি তারা খচিত চাঁদের শুভ্রতা ছড়িয়ে পড়ে পুরো আকাশ জুড়ে। ধ্রুবতারা দের ছুটোছুটি বিস্ময়ভুত করে মন না চাইলেও। শিশির ভেজা এই সময়ে প্রকৃতিতে সৌরভ ছড়ায় শীতের ফুল। শীতকালীন ফুলে রঙ্গিন হয়ে উঠে গ্রাম। অতিথি পাখির আনাগোনায় মুখরিত হয়ে ওঠে নদ-নদী, খাল-বিল, হাওর, ঝিল, জলাশয় ও বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল। নিস্তব্ধ পরিবেশে পাখির গুঞ্জনে অদ্ভুত এক মোহ লেগে যায় তনুমনে।
আকাশে ছন্নছাড়া নীল-শুভ্র মেঘ।পাখিদের কিচির-মিচিরে মুখর থাকে গ্রাম। হেমন্তে মাঠের সোনালি ধান গোলায় ভরার পর আনন্দে মেতে থাকা মানুষের শরীরে লাগে শীতের কাঁপন। বাতাসে শুকনো পাতার মর্মর ধ্বনির সাথে গাছের পাতাগুলো বিবর্ণ রূপ ধারণ করে। একটা সময়ে গাছের পাতা ঝরে পড়ে। পত্রপল্লবহীন জীর্নশীর্ন বৃক্ষগুলো নিশীথে একাকী চলার পথে সমুখে পড়লে বুকে কাঁপন ধরে যায়। পরিবেশটাকে তখন ভীষণ ভুতুড়ে ভুতুড়ে লাগে।
এ-সময় খেজুরের রস, পাটালি গুড়, কোঁচাভর্তি মুড়ি-মুড়কি, পিঠা-পায়েস, খড়-পাতার আগুন তাপানো, গমের খেতে পাখি-তাড়ানো, লেপ-কম্বলের উত্তাপ, কুয়াশা ঢাকা ভোরে ও সন্ধ্যায় আনন্দের শীত গ্রামের জনজীবনকে রাঙিয়ে তোলে। শীতের মিঠে রোদ, কুয়াশার চাদর, মাটির চুলায় রান্না, চুলার পাশে বসে বসে হাতের তালু গরম করে নেওয়া, চায়ের কাপের সাদাটে ধোঁয়া, হলুদের ডালি বিছানো সরিষা মাঠ, হাট-বাজারে ক্যানভাসের মজমা-এসব গল্প কেবল এই শীতকে ঘিরেই।
গ্রামের চা-দোকানে ভোর হতে জমতে থাকে আড্ডা। সবাই যে-যার মতো শীতের চাদর-সোয়েটার গায়ে দিয়ে গল্পে-আড্ডায় মেতে ওঠেন নিজেদের মতো করে। শুকিয়ে যায় নদী-নালা খাল-বিলের পানি। কোথাও হাঁটুজল, কোথাও খটখটে চর জাগে। গ্রামের কিশোর-কিশোরীরা মেতে ওঠে অল্প পানিতে মাছ ধরার উৎসবে। সেইসঙ্গে খাবারের খোঁজে খাল-বিল আর মাঠে-ঘাটে নামে সাদা বকের ঝাঁক। সাদা ফুলের মত বসে থাকা বকের শুভ্রতায় এক অপরূপা দৃশ্য তৈরি হয়।
সকালে ছেলেমেয়েরা দলবেঁধে মক্তবে যায়। গাছ থেকে খেজুর-রস নামায়, গাছি-রসের গন্ধে চারিদিকে মৌ মৌ করে। দূর্বাঘাসের মাথায় বিন্দু বিন্দু শিশির ফোটে। শৈশবে হিফজ বিভাগে থাকতে প্রতিদিন ভোরে দূর্বাঘাসের উপর দিয়ে শিশিরবিন্দু মারিয়ে হেঁটে যেতাম মাঠের এ-মাথা থেকে ও-মাথা। হিফজ বিভাগের সামনের মাঠটা সবসময় ঘাসে ভরপুর থাকত। শীত গ্রীষ্ম সবসময়ই শিশির জমত ঘাসের উপর। শিশির বিন্দু আমার কাছে মনে হতো মহৌষধ। কখনো উঠিয়ে হাতে লাগাতাম। কখনো মুখে। কখনো আবার শিশিতে ভরে রেখে দিতাম পকেট।
গ্রামে কাটানো অল্প অল্প সময়গুলো খুব মিস করি। ভাগ্যের প্রয়োজনে গ্রামের মেঠোপথ ছেড়ে চলে আসতে হয় পিচঢালা রাজপথের শহর ঢাকায়। শীতের মৌসুম যায়। গাঁয়ের শীতল ভেজা অপরূপ দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য আমার হয় না। দেখা হয় না ঘাসের ডগায় গাছের পাতায় শিশিরের জমে থাকা। আর বাঁশঝাড়ের কঞ্চি দিয়ে বেয়ে পানি ঝরে পড়ার আশ্চর্য সুন্দর দৃশ্যগুলো। এ সবই আজ হয়ে গেছে কেবল স্বপ্ন। স্মৃতির বাঁকে বাঁকে ছড়িয়ে থাকা বহু স্মৃতি কল্পনায় ধরা দিচ্ছে এখন। চনমনে শৈশবের কাছে ফিরে যাবার অসম্ভব আকুতি নিয়ে এই তো আমাদের বেঁচে থাকা।
শিক্ষার্থী, জামিয়া রাব্বানিয়া আরাবিয়া, নারায়ণগঞ্জ
জানুয়ারি ২০২২