সেপ্টেম্বরের ঝাঁ ঝাঁ দুপুর পেরিয়ে আলতো করে নেমে আসে নরোম বিকেল। কমলা রঙা রোদ্দুরে মাখামাখা আমগাছের পাতা। ঝুল বারান্দা আর ছাদের কার্নিশ। উত্তুরের জানালা দিয়ে আসা শীতল মৃদু বাতাসে জুড়িয়ে যাচ্ছে শরীরের তাপ। হালকা বাতাসে নারকেলপাতার কাঁপন। সিঁড়িতে চিলেকোঠার ঘরে থাকা পায়রাদের ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ। দূরে কোথাও থেকে ভেসে আসা কাঠ কাটা মেশিনের তীক্ষ্ম আওয়াজে ছিঁড়ে যাচ্ছে কবিতা পাঠের মনোযোগ। ছেড়া ছেড়া মনোযোগে বুদ্ধদেব বসুর যে আঁধার আলোর অধিক বইয়ের ‘সমুদ্রের প্রতি —জাহাজ থেকে’ কবিতাটা পড়তে পারলাম না ঠিক। তারচে বরং মানুশ দেখি। পশ্চিমের জানালায় চোখ রেখে দাঁড়িয়ে রইলাম বেশ কিছুক্ষণ। ব্যস্ত রাস্তা। সিএনজির জন্য অপেক্ষা। বাসের দৌড়। পায়েচলা বাজারমুখো মানুষ। ভিতরে শতশত গল্পের ঝাঁপি নিয়ে জীবনের পথে পথচলা।
আসরের আজান হচ্ছে কোথাও। ইদানীং বিকালে, রাতে গোসল করার নেশাটা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। সারাদুপুর ভেজা কাপড়ে বসে রইলাম বিকালে গোসল করব বলে। নামাজ পড়ে গোসল করব, না গোসল করে নামাজ পড়ব ভাবতে ভাবতেই গোসল করে ফেললাম। শতশত ছেড়া চিন্তা ভর করে আছে মাথায়। এলোমেলো ভাবনারা লিলুয়া বাতাসের মতোই আছড়ে পড়ে মনের দোরগোড়ায়। উদাসী মনের বেখেয়ালে থাকা শূন্য আঙ্গিনা ভরে যায় মহাকাশব্যাপী বিষণ্ণতায়। ভেতরে ভেতরে ঘুনপোকার মতো খেয়ে যায় আমাকে। বাহিরটা কেমন নির্বিকার। নির্জন আলসে দুপুরের মতো। আর ভেতরটা শান্ত দীঘিতে হঠাৎ উঠা জলোচ্ছ্বাসের মতোই উচ্ছল। ক্ষ্যাপাটে ভীষণ। ঘর ভেঙে যায় মুখ দেখে বোঝা যায় না মানুষগুলোর জীবন কাটে কেমন করে? আমি ভেবে পাই না। হয়তো আমার মতোই।
কী যে সব ভাবনারা এসে জড়ো হয়! ভাসাভাসা একটা দিন পার হয়ে রাত নেমে আসার প্রস্তুতি চলছে। কেমন দূরে দূরে থাকা এইসব সময়। বুকের ভেতর বইতে থাকা কথার নদীটা ১৪ তারিখের রাত্তিরে জোৎস্না-ছড়ানো চাঁদের রুপোর কুচি গায়ে মাখছে কী আনন্দে! ঢেউয়ে ঢেউয়ে তার প্রতিবিম্ব। মনের ভিতর লুকিয়ে থাকা পোস্তদানা মনটা নদীর তীরে বসে কত কথা বলে উঠে খলবলিয়ে। আমি নির্বিকার চোখে অনিমেষ তাকিয়ে থাকি ওদের দিকে।
অনিকেত প্রান্তরে উড়তে-থাকা পরিযায়ী পাখির মন নিয়ে দেখে যাই—কুঁচকে যাওয়া এলোমেলো মেরুন শাড়ির মতো বিকালের রোদ্দুর ঘরে এসেছে জানালার গ্রিল গলে। ডুবো ডুবো সূর্যের আলো আঁধারি ছায়ার প্রতিচ্ছবি এইসব রোদ্দুর। ভাতঘুম লেগে থাকা ঝিমুনি ধরা অনুভূতিরা নেশাগ্রস্তের মতো মৃদু হাওয়ায় দুলতে থাকে যেন। আমাকে কি ভীষণ ক্লান্ত দেখায় তখন?
কী নিদারুণ নিঃসঙ্গতায় পুড়তে থাকে মন! জানে এইসব নিঃসঙ্গ বিকেল, আবছা ঘরের কোণ। মেঝেতে পড়ে থাকা কফিরঙা গ্রিলের ছায়া আর যাপিত জীবনে মনের সিথানে জমে থাকা না বলা কথাদের গোলটেবিল…
চার, নয়, দুইহাজার বিশ
নভেম্বর, ২০২০
সুন্দর হয়েছে
সুন্দর