আমাদের ওয়াজ মাহফিলগুলোতে মাইক ব্যবহারে সচেতন হওয়া দরকার। এবং খুবই দরকার। বিশেষত শহর-বন্দরে যে মাহফিলগুলো হয়, মাইকের আওয়াজের কারণে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপনে প্রচণ্ড ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়। এটা শব্দদূষণ। এবং মোটামুটি মারাত্মক পর্যায়ের অপরাধ।
কথাগুলো খুব খোলামেলা বলে ফেললাম। পড়ে হয়তো ইতোমধ্যেই রাগে ফুঁসে উঠেছেন, প্রিয় পাঠক। আমাকে মাফ করবেন। রাগটা একটু পরে করুন। কথাগুলো শেষ করে নিই।
শুক্রবার। জুমার নামাজ শেষ করে মাদরাসায় ফিরছিলাম। মাদরাসা যে গলিতে, গলির মুখে এসে দেখলাম মানুষজনের ছোট-খাটো একটা জটলা। ছাপ দাঁড়িওয়ালা বৃদ্ধ-মতো এক লোক চোখে-মুখে বিরক্তির চিহ্ন এঁকে কথা বলছেন। পাশেই ইলেক্ট্রিসিটির খুঁটিতে একটা মই লাগানো। মইয়ের অনুসরণ করে উপরের দিকে তাকালাম। খুঁটিতে মাইক বাঁধছে এক লোক। বুঝতে বাকি রইল না, বর্ণমালা স্কুল রোডে আজ ওয়াজ মাহফিল। মাইকবাঁধা লোকটি অর্ধেক কাজ শেষ করে মইয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়িওয়ালা বৃদ্ধ-মতো লোক ওখানে মাইক বাঁধতে আপত্তি জানাচ্ছেন। বাঁধলেও যেন তাঁর বাসার দিকে মুখ করে বাঁধা না হয়।
ভদ্রলোক নামাজি মানুষ। মাদরাসায় থাকলে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে তাঁর সঙ্গে দেখা হয় মসজিদে। মসজিদে তাবলিগের নিত্যকার তালিম, সাপ্তাহিক গাশত, চরমোনইয়ের হালকায়ে জিকিরÑসবকিছুতে নিয়মিত শরিক থাকেন তিনি। ওয়াজের মাইক তো কত ভালো জিনিস। তাঁর বাসার দিকে মুখ দিয়ে মাইক বাঁধা হচ্ছে। এটা তো তাঁর জন্য খোশনসিব। বাসায় বসে বসে বিবি সাহেবাকে নিয়ে ওয়াজ শুনবেন। দীনি কথাবার্তা। তারপরও ভদ্রলোক আপত্তি জানাচ্ছেন। এবং সেই জানানোটা বেশ বিরক্তির সাথে। কাহিনি কী?
কাহিনি বেশ জটিল। আবার একদম সহজ। গলির মুখের ইলেক্ট্রিসিটির খুঁটিটা শীত সিজন এলে ওয়াজ মাহফিলের জন্য বরাদ্দ হয়ে যায়। আশপাশে যত ওয়াজ মাহফিল হয়, সবগুলোর একটা না একটা মাইক অত্যন্ত যতœ সহকারে এখানে বাঁধা হয়। এবং মাইকের মুখ থাকে দাঁড়িওয়ালা ভদ্রলোকের বাসা বরাবর।
এবার আসুন এই এলাকায় প্রতিবছর কতটা মাহফিল হয়, একটু হিশেব কষি। হিশেব বোধহয় ঠিকমতো করা সম্ভব না। কারণ, মাহফিলের হিসেব করতে হলে আগে গুনতে হবে এই এলাকায় মোট মাদরাসা কতটা আছে। অধিকাংশ মাহফিলই এখানে মাদরাসার উদ্যোগে হয়। গণিতে আমি ভালো ছাত্র ছিলাম না কোনো কালেই। তাই এখানকার মাদরাসার মোট সংখ্যা বের করা আমার জন্য জটিল কাজ। আপাতত জটিল কিছু নিয়ে মাথা ঘামানোর ইচ্ছে নেই। অতএব মাদরাসার হিসেব বাদ। অঠিকভাবেই দেখি, মাহফিল কতটা হয় একটা আন্দাজ দাঁড় করাতে পারি কি না। বর্ণমালা স্কুল রোড নামে একটা রোড আছে এই এলাকায়। এলাকার সবচেয়ে বেশি মাহফিল এখানেই হয়। ২দিন ব্যাপী থেকে শুরু করে ৫দিন ব্যাপী পর্যন্ত একেকটা মাহফিল। একদিনের কোনো কারবার নেই। সেই সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয় মাহফিল অনুষ্ঠান, চলে মার্চ অবধি। প্রতি সপ্তাহে একটা না একটা থাকেই। এ সপ্তাহে অমুক বিশ্বমানের মাদরাসার তিনদিনব্যাপী ওয়াজ তো আগামী সপ্তাহে তমুক আন্তর্জাতিক মাদরাসার ৫দিন ব্যাপী দস্তারবন্দি মহাসম্মেলন। বিকেল থেকে শুরু হয় বয়ান, পুরো এলাকা অসংখ্য মাইকের গমগম আওয়াজে মুখরিত করে শেষ হয় মধ্যরাতে। প্রতি সপ্তাহেই এমন হয়। ভদ্রলোক কত ওয়াজ শুনবেন আর!
দু-একদিন পর পর মাহফিলের মাইকের আওয়াজে এলাকার মানুষের চোখে-মুখে বিরক্তির একটা চিহ্ন লেপ্টে থাকে মাহফিল চলাকালীন পুরোটা সময় জুড়ে। কিন্তু মুখে কেউ কিছু বলে না। কষ্ট হয় ঠিকই। ধর্মপ্রাণ মানুষ। ধর্মের কথা আলোচনা হচ্ছে। মাইকের ব্যবহার একটু কম করার কথা বলাটা যদি অধর্ম হয়ে যায়–এই ভয়টাই হয়তো তাদের চুপ রাখে।
কিন্তু মাহফিলের জন্য মাইকের এমন যথেচ্ছা ব্যবহার কি আসলেই ধর্ম? নাকি অধর্ম? কোনো মুসলমানকে কষ্ট দেওয়া হারাম–হাদিসের এই কথাটা কি এখানে প্রয়োগ হয় না?
মাহফিল হোক, বেশি করে হোক, আজ এ ব্যাপারে কোনো কথা নয়। যেটা বলতে চাই, শহর-বন্দরÑঅর্থৎÑঘন বসতিপূর্ণ এলাকার মাহফিলগুলোতে মাহফিল-এলাকার বাইরে ক’জন মানুষ বয়ান শুনে? গুণে গুণে ১০জন মানুষও তো বোধহয় এমন পাওয়া যাবে না। তবে কেন অযথা এত এত মাইক লাগানো?
ভেবে অবাক হই, বড়দের কেউই এ ব্যাপারে খুব একটা কিছু বলেন না। অথচ এই শব্দদূষণের কারণে সাধারণ মানুষের যে একটা ভক্তি টান এবং আবেগ ছিল ওয়াজ মাহফিল নিয়ে, তাতে ক্রমশ ভাটা পড়ছে। ভাটা পড়ার অবশ্যি এ ছাড়া আরো বহুবিধ কারণ আছে, তবে এটা আমি মনে করি মোটা দাগের একটা কারণ।
শব্দদূষণ যে কী বিরক্তিকর এবং অসহ্যকর জিনিস, আমি নিজেও এর ভূক্তভোগী। পরদিন পরীক্ষা। মাগরিবের পর বসেছি মুতালায়ায়। বর্ণমালা স্কুল রোডে কোন এক আন্তর্জাতিক (ভাড়াটে) মাদরাসার ৫দিন ব্যাপী মাহফিল চলছে। থেকে থেকে বক্তা মহোদয়ের হাঁক-চিৎকারে মুতালায়া করব তো দূর কি বাত, মাথায় রীতিমতো যন্ত্রণা শুরু হয়ে গেল। পরীক্ষা ছিল ৫দিন, মাহফিলও ছিল ৫দিন। যাহ! ছাত্রনং অধ্যয়নং তপ!
শহর-বন্দরের মাহফিলগুলোতে বক্তার আলোচনা প্যান্ডেল এবং তাঁর আশপাশের মানুষেরাই শুনে। বাইরের কেউ শুনে না। ডজন ডজন মাইক টানানো শব্দদূষণ ছাড়া কিছুই না। অযথা এই মাইকের ব্যবহার বন্ধ করে কেবল স্পিকার-বক্সের ব্যবহার চালু হোক। এতে শব্দদূষণও যেমন বন্ধ হবে, মাহফিলের ভারসাম্যতাও রক্ষা পাবে।
প্রক্রিয়াটা চালু করতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা দরকার সম্মানিত ওয়ায়েজগণের। তাঁরা যদি এই প্রক্রিয়াটা আয়োজকদের বুঝাতে পারেন, তবে আমাদের হেদায়েতের এই নতুন দিগন্ত নতুন করে আবার নতুন মহিমায় প্রসারিত হবে। আল্লাহ আমাদের তওফিক দান করুন।
‘হেলিকপ্টার হুজুর’ নিয়ে একটু কথা বলতে মন চাইছে। আজকাল ওয়াজের পোস্টারেও হেলিকপ্টারের ছবি থাকে। নিচে বিশেষ দ্রষ্টব্য হিসেবে লেখা থাকে : হুজুর হেলিকপ্টার চড়িয়া আগমন করিবেন। তাগড়া জোয়ান বক্তা। এখনও অনায়াসে মাইল শয়েক হেঁটে যাবার তাকত রাখেন। তারপরও তাঁর হেলিকপ্টার চাই। ওজর কিংবা জরুরত থাকতে পারে। সেটা ভিন্ন কথা। আমাদের মুরব্বি উলামায়ে কেরাম যাঁরা, অনেকেই সফরের তাকত রাখেন না, তাঁদের ক্ষেত্রে হেলিকপ্টারে যাতায়াত জরুরতের কারণে। কিন্তু জোয়ান বক্তা, প্রতিদিন মাহফিল সাকুল্যে একটা বা দুটো করেন, তাঁর হেলিকপ্টার চড়া তো বিলাসিতা বৈ কিছু না। এটা সাধারণ মানুষের মনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। মাহফিলের প্রতি একটা বিতৃষ্ণা তৈরি করে। তামাম আলেমকুলের প্রতিও অনেকের ধারণা বদলে যায়। মনে করে এরা আরামপ্রিয়, বিলাসী।
ওয়াজ মাহফিল এই কয় বছরে হু হু করে বেড়েছে। ১০/১২ বছর আগেও এতোটা ছিল না। এটা কি ইতিবাচক না নেতিবাচক আমি সেই প্রশ্নে যাব না। ইতিবাচক-নেতিবাচক উভয়টাই আছে। আজ বসেছি কেবল নেতিবাচক দিকগুলো নিয়ে হালকা আলাপ-সালাপ করতে। বস্তুত এ নিয়ে আমার দীর্ঘদিনের ক্ষোভ, বিরক্তি এবং হতাশা আছে।
যোগ্য আলোচক বা বক্তা আছেন স্বীকার করেই বলছি, মাহফিলে যারা কথা বলছেন, কথা শুনলেই বোঝা যায় তাঁদের চিন্তা এবং জ্ঞানের দৌড় কতদূর। সুর এবং কথা বলার যোগ্যতা থাকলেই আজকাল ওয়াজের ময়দানে নেমে যাচ্ছেন অনেকে। না আছে পড়াশোনা, না চিন্তা। একটা মাহফিলে কথা বলছেন, কী বলছেন না বলছেন কোনো আগা-মাথা নেই।
একজন শিক্ষিত এবং জ্ঞানবান মানুষ যখন এইসব বেহুদা আলাপ ওয়াজের মাইক থেকে শুনতে পায়, তখন সেই বক্তাকে তো কাণ্ডজ্ঞানহীন ঠাওরায়ই, সাথে সাথে পুরো আলেমশ্রেণিকে এরূপ মনে করেÑআরে হুজুররা তো এমনিই। কিচ্ছু জানে না।
ওয়াজ মাহফিল ধর্মীয় প্রচারণার অন্যতম একটা ক্ষেত্র। মানুষের হেদায়েতের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। কিন্তু এই রকম কিছু অদূরদর্শিতা, অপরিপক্ষতা এবং পরিকল্পনার অভাব জনমনে মাহফিলকে দিনদিন প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে। আমি জানি না এই সবের সমাধান কবে হবে। কিংবা আদৌ হবে কি না। আমার কেবল কিছু কথা বলার ছিল, বললাম। সবাই ভালো থাকুন। সুস্থ থাকুন। আল্লাহ হাফেজ।
এপ্রিল ২০১৮