সন্ধ্যা নামতেই কাঁপন দিয়ে শরীরে জ্বর আসে তার। তখন প্রবল বেগে শুরু হয়েছে ঝড়। সঙ্গে শিরশির করে বাতাস। তার পিঠে ছেঁড়া তসবিহ-দানার মতো ঝরঝর বৃষ্টি। বাতাসের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বৃষ্টি বাড়ছে, কমছে। বাড়ির পুবপাশের বাঁশঝাড়ের বাঁশগুলো বাতাসের ধাক্কা সামলে উঠতে না পেরে এলিয়ে পড়ছে এদিক-ওদিক। উঠোনের কোণে লম্বা নারকেল গাছের মাথায় কয়েকটি কাক ভয়ের কণ্ঠে কা কা করছে। চারদিকে সন্ধ্যা আর ঝড়ের অন্ধকার মিলে যেন অমাবশ্যার রাত।
কুঁকিয়ে ওঠে আরশ মিয়া। এই জ্বর, ঝড় তার কাছে অসহ্য লাগে। পৃথিবীকে তার আবছা অন্ধকার মনে হয়। গোঙাতে গোঙাতে বলে, ‘লেপটা শইল্যে তুইল্যা দে গো।’ গলায় তার কেমন আর্তনাদ মেশানো। বাবার গলার করুণ স্বর শুনে বুকের ভেতর ভয় আঁতকে ওঠে পাশে দাঁড়ানো মেয়ে দুটি।
রাত গভীর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরশ মিয়ার গায়ে জ্বরের ডিগ্রিও বাড়তে থাকে ভয়ঙ্কর রূপে। এই অসময়ে মেয়ে দুটি কী করবে? ডাক্তার-হসপিটাল তো কতদ‚রÑসেই শহরে। এই অবেলা তাদের অন্তত একজন পুরুষ পাশে থাকা প্রয়োজন। কিন্তু এই ঝড় ভেঙ্গে মধ্যরাতে কার দরজার কড়া নাড়বে তারা? ঘরের চাল লাগানো পাশের ঘরের চাচাতো ভাই আলমকে হয়তো ডেকে তোলা যেত। কিন্তু তাও যেন আটকে যাচ্ছে কোথাও।
আলমের সঙ্গে আরশ মিয়ার ঝগড়ার বছর খানেক হলো। ঝগড়া বলতে এই সমাজে চলতে ফিরতে যা হয়। কিন্তু সে পর্যায়ে এখন আর এটা থাকেনি। গড়িয়েছে কোর্ট পর্যন্ত। কথা বন্ধ। একজনের ভালো-মন্দে অন্যজনের এড়িয়ে যাওয়া, এমনকি এক উঠোনের মাঝখানে দেওয়া হয়েছে বাঁশের বেড়া। নিশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করা ছাড়া এখন আর তাদের কোনো উপায় নেই।
বহু দুঃখ-কষ্টে জীবনযাপন করেছে অভাবী আরশ। শৈশবে বাবার মৃত্যু। মায়ের অনাহারে দিনপার। বিয়ের পর থেকে এই অভাবের সঙ্গী তার স্ত্রী, তারপর দুই কন্যা। আজও এই দুঃসময়ে তারা হারিক্যানের মিটমিট আলোতে তার পাশে বসা।
শেষরাতের দিকে ঝড় থেমে আসে। বৃষ্টিও আর নেই। এ সময় ইতি টানে আরশ মিয়ার জীবনের। বোমাক্রান্ত শহরের মতো আর্তনাদ করে ওঠে স্ত্রী ও মেয়ে দু’টি। ঘুমন্ত রাতের শেষভাগটা খসে পড়ে তাদের চিৎকারের ধ্বনিতে।
সকালে ভোরের আলোর সঙ্গে সারা গ্রামে খবরটা ছড়িয়ে পড়ে। লোকজন আরশ মিয়ার জন্য আফসোসের ভদ্রতা দেখায়। দুঃখ প্রকাশ করে বলে, ‘আহ, লোকটা দুমুঠো ভাত পেট ভরে খেয়ে মরতে পারেনি! মেয়ে দুটিও ঘরে রয়ে গেল!’
ক্রমেই মানুষের সমাগম বাড়ে মৃত আরশের বাড়িতে। মানুষ তার লাশ দেখতে আসছে। অনন্তের মতো শেষ দেখা। এই ভিড়ে আলমকেও দেখা যায়। যখন আলম দিব্যি পেট পুরে খেয়ে, ভালো দামি পোশাক পরে বাবুর মতো চলাফেরা করেছে, তার ঘর থেকে ভালো খাবারের ঘ্রাণ ফেটে বের হয়েছে, তখন চাচা আরশের ঘরের লোকজন অভাবে উপবাস। আলম ছিল চাচার জন্য থেকেও নেই। দেখাশোনা, ভালোমন্দ জিজ্ঞেসের ভদ্রতাবোধও করেনি।
ভদ্রতা করেই হোক বা সত্যি সত্যি, গ্রামবাসীর মন আরশের মৃত্যুতে শোকার্ত। ঘরের লোকজন একমাত্র পরিবার চালানোর অবলম্বন হারিয়ে অনেকটা দিশেহারা। কেউ কেউ যখন তার দাফন-কাফনের কথা তুলছে, তখনই আলম রাজনৈতিক নেতাদের মতো ঘোষণা করে, ‘আমি আমার চাচার কাফনের ট্যাকা দিমু, তোমরা আমার বাঁশঝাড় থিকা কবরের বাঁশ কাটো, কবর খনন কোরো আমার খেতের জমিনে।’
অনেকের মনের উদ্বেগ কেটে যায় আলমের ঘোষণা শুনে। যাক, অবশেষে আরশের শেষ আশ্রয়ের ব্যবস্থা হলো। নিজের প্রতি মানুষের কৃতজ্ঞতার নজর দেখে আলম আবার ঘোষণা দেয়, ‘তোমরা তাড়াতাড়ি দাফনের ব্যবস্থা করো। রাইতে মারা গেলা, এখনো কিচ্ছু অয় নাই। কই মোয়াজ্জিন সাব একটু জলদি করুইন।’
জোহরের সালাতের পর ঈদগাহ মাঠে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। ইমাম সাহেব কবরজীবন সম্পর্কে আলোচনা করেন। কবরের তিনটি সোয়ালের কথা বলেন, এইখানে ফেল হলে সবকিছুতেই ফেল। কবরই আখেরাতের প্রথম ঘাটি। স্মরণ করিয়ে দেন অজানা মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকতেও। মৃত ব্যক্তির ওয়ারিশ হিসেবে আলমকেও কথা বলার সুযোগ দেওয়া হয়। আলম উপস্থিত জনসম্মুখে দাঁড়ায়। কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলে, ‘আমার চাচারে আপনারা মাফ কইরা দিয়েন। আর কারও কোনো পাওনা থাকলে আমারে জানায়েন, আমি তা পরিশোধের ব্যবস্থা করুম।’
চিরদিনের জন্য ঈদগাহের পাশে কবরস্থ করা হয় আরশ মিয়াকে। উপরে মাটি টেনে কবরের ছাদ করা হয়। তার ওপরে বিছানো হয় কাঁটাযুক্ত বড়ই-ডাল। কবরের চারপাশ ঘিরে বাঁশের বেড়া। দাফনের কাজ শেষ করে ইমাম সাহেব লোকজনকে নিয়ে আকাশের দিকে হাত তোলেন। দুআ শেষে সবাই যে যার মতো বাড়ি ফিরে যায়।
জগতের নিয়ম মেনে পৃথিবীর বুকে রাত নামে। আলম মৃত-চাচার ঘরে ডালভাত পাঠায় তখন। গতরাত থেকে মরাবাড়িতে কেউ কিছু খায়নি। একটু হলেও তাদের খাওয়া দরকার। বলতে গেলে একরকম আরশের মৃত্যুর কথা ভুলেই ঘুমাতে যায় গ্রামবাসী। রাতের টুকটাক কাজ শেষে ঘুমায় আলমও।
রাতের শেষভাগ। আলম কাঁথা মুড়িয়ে ঘুমাচ্ছে। তখনই মৃত চাচা আরশ মিয়ার প্রকাশ ঘটে তার সামনে। অসহায়ে মতো চেহারা, ভিখিরির মতো ভঙ্গি। অভিযোগ ছুড়ে বলে, ‘আলম, বাঁইচ্যা থাকতে তুই একবারও আমার খবর নিলি না। অভাবে মরলেও জিগালি না। আর মরার পর আমার লাশ দুনিয়া থিকা সরানির লাগি এত তাড়াহুড়া করলি?’
শুয়া থেকে দপ করে উঠে বসে আলম। বিশ্বাস করতে পারে না, সে যে এতক্ষণ ঘুমে ছিলো। তার কাছে মনে হয়, আরশ মিয়া তাকে বাস্তবেই বলেছে। এমনকি তার চাচা এখনো এইখানে আছে। হয়তো এই রুমেরই কোথাও। এই তো তার গন্ধ আসছে। আলমের শরীর থেকে টপটপ করে ঘাম ঝরে। মনে হচ্ছে এইমাত্র সে গোসল সেরে এসেছে।
নভেম্বর ২০১৮