বেশ কিছুদিন ধরে আমি গ্রামে বসবাস করছি। ঢাকার চাকরি-ব্যবসা থেকে আপাতত হাত গুটিয়ে একপ্রকার নির্ঝঞ্ঝাট নির্জনবাস। ঢাকায় দু-এক সপ্তাহ পরপর দু’দিনের জন্য আসি। প্রয়োজনীয় কাজ শেষ করে আবার চটজলদি গ্রামের পথে যাত্রা। নিজেকে আবার বিচ্ছিন্ন করে ফেলি নাগরিক কোলাহল থেকে। নিজেকে আবদ্ধ করি সহজবোধ্য এক গ্রামীণ জীবনে। সহজকথায় বলতে গেলে―এ এক গুহাজীবন। এবং অনস্বীকার্যভাবেই বলছি―আমি এ গুহাজীবনকে উপভোগ করছি।
বন্ধু-স্বজন অনেকেই প্রশ্ন করেন―কেন ঢাকা ছেড়ে গ্রামে থাকছেন? কী করছেন সেখানে বসে বসে?
আমি তাদের হেসে উত্তর দেই―জীবনটাকে উপভোগ করছি। মানুষের একটামাত্র জীবন, ষাট-সত্তুর বছরের ক্ষুদ্র সফর। এ সংক্ষিপ্ত সময়টাকে কেন মিছেমিছি টাকা কামানোর পেছনে ছুটিয়ে জীবনটাকে রেসের ঘোড়া বানানো? তিনবেলা খাবারই তো শেষকথা, তাই না? ও তো একবেলা রিকশা চালালেও জুটে যায়। তিনবেলা দু’ মুঠো খাবারের জন্য কেন আমি মা-বাবার ভালোবাসা, ভাই বোনের মমতা, প্রিয়তমা স্ত্রীর প্রেমিত সান্নিধ্যকে দূরে ঠেলে দেবো? ছোট্ট এ জীবনটা তো আল্লাহর সৃষ্টির বৈভব দেখেই বিস্ময়ে কেটে যাবে, কিছু করার আর সময় কই?
তারা আমার কথা শুনে খানিকটা বিরক্তই হন। ভাবেনÑ রঙ করার আর সময় পান না!
সকাল সকাল আমি ঘরের জানালাগুলো খুলে দেই। একপাশে কাকচক্ষু জলের টলটলে পুকুর, আরেকপাশে মেহগনি বাগান ভেদ করে ঘরে এসে মাখামাখি হয়ে থাকে সকালের সোনালি রোদ্দুর। সে ঝলমলে রোদ্দুর গায়ে মেখে লিখতে বসি। লিখতে কখনো ক্লান্তি আসে না। ক্লান্তি এলে ঘরের বাইরে যাই, মানুষ দেখি, গাছপালা দেখি, সকালের সূর্য দেখি; পুকুরের জল, ধানখেতের সবুজ দেখি, গ্রাম্যবালিকাদের হাসিরোল দেখি, সর্ষেখেতের মতো ঝলমল গ্রামীণ জীবন দেখি। কী জীবন্ত আর প্রাণবন্ত জীবন সেখানে, একদম টাটকা। হাত বাড়ালেই খলবল করে উঠে।
গ্রামের মানুষগুলো বড় সরল। তাদের চাহিদাও স্বল্প, জীবন কাটানোর প্রয়োজনীয় উপকরণও তাই তাদের অল্প প্রয়োজন হয়। এ কারণেই তারা প্রাণ খুলে হাসতে পারে। গ্রামের ছেলেমেয়েদের হল্লা লেগে থাকে দিনমান। এ খেলা, ও খেলা নিয়ে সারাদিন তাদের ছোটাছুটি আছেই। একটার পর একটা অভাবনীয় খেলার উদ্ভাবনী আইডিয়া তারা আবিস্কার করে ফেলে মহূর্তেই।
এটা ভালো। শৈশব প্রতিটি মানুষের অনেক বড় সম্পদ। পড়ালেখা আর বড় বড় বই দিয়ে তাদের শৈশবকে হত্যা করাটা মহা অন্যায়। আমি আমার ভাগ্নে-ভাতিজাদের বলে দিয়েছিÑ পাঁচ-সাত ক্লাস পর্যন্ত কিসের পড়ালেখা! হেসেখেলে শৈশবটা পার করো। তোমার শৈশবকে পৃথিবীর রূপ-আনন্দ দিয়ে ভরে ফেলো। শৈশবকে তোমার দুরন্তপনা দিয়ে ক্ষত বিক্ষত করে রাখো। একসময় দেখবে এ শৈশবই তোমাকে বিশ^জয়ের অনুপ্রেরণা যোগাবে। শৈশবের শিক্ষাই একজন মানুষকে সারা জীবন তাড়িয়ে ফেরে। এ কারণে শৈশবকে রাখতে হয় মুক্ত স্বাধীন।
জীবন আল্লাহর অনেক বড় নেয়ামত আপনার প্রতি। কিন্তু কখনো কি এর জন্য আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেছেন? সারাজীবন অন্যের জন্য সময় দিলেন, মা-বাবা, স্ত্রী-সন্তান, বন্ধু-স্বজনদের জন্য ব্যয় করে দিলেন জীবনের সবটা সময়। কখনো নিজেকে সময় দিয়েছেন? নিজের জন্য কখনো বিনিয়োগ করেছেন? নিজের আত্মোন্নয়নের জন্য আত্মমগ্ন হয়ে ভেবেছেন কখনো? এবার নিজেকেও খানিকটা সময় দিন। নিজের বাহ্যিক ও অন্তর্গত বিষয়-আশয়ের পরিচর্যা করুন সুচারুভাবে।
কিছুদিনের জন্য নিজেকে পৃথিবীর ব্যস্ততা থেকে ছুটি দিন। প্রকৃতির উদার হাতে তাকে ছেড়ে দিন সম্পূর্ণ। ঘুরে বেড়ান যেখানে সেখানে। পৃথিবীটাকে এক চক্কর দেখে আসুন যদ্দুর সাধ্যে কুলোয়। বিশ^নিয়ন্তা কতো প্রযুক্তি আর প্রকৌশল দিয়ে বানিয়েছেন এ পৃথিবী, আপনার কি উচিত নয় দিনের কিছুটা সময় এই সৃষ্টি-প্রকৌশল নিয়ে চিন্তা করার? এটুকু চিন্তা অন্তত আমাদের সবার হৃদয়েই থাকা উচিত।
বাড়ির কাছেই মসজিদ, পাঁচবেলা আজান শুনে মসজিদে যাই। ইমাম সাহেব না থাকলে আজান-ইমামতিটাও করে ফেলি। শনি-মঙ্গল দু’দিন হাট বসে এলাকায়। আমি সকাল সকাল ব্যাগ বগলের তলে নিয়ে হাটে চলে যাই। হাটভরা মৌসুমী শাক-সবজি, তরি-তরকারি। রাস্তার দু’ পাশে আনাজ-তরকারির বড় বড় ঝাঁপি নিয়ে বসে আছে গেরস্থ-পাইকাররা, অকারণেই তাদের সঙ্গে দামাদামি করি। মাছবাজারে গিয়ে দেখি কী মাছ এসেছে। বিল আর নদীর চকচকে মাছগুলো চেয়ে চেয়ে দেখলেও শান্তি লাগে। পরিচিত জেলেরা দেখলেই ডাকাডাকি শুরু করে। গ্রামে থাকার এই এক সুফল, প্রচুর মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়ে যায়। দেখা হলেই আপন ভঙ্গিতে হেসে উঠেন।
মাঝে মাঝে নিজেদের কৃষিখেতেও যাই। ধান, ভুট্টা, সবজির মাচা দেখে আসি। আমাদের ওদিকে লেবু বাগান করার চল রয়েছে। বাড়ির আশপাশে প্রচুর লেবু বাগান। লেবুফুলের ঘ্রাণ বড় উতলা। মৌমাছি এসে বসে থাকে মৌসুমে।
মানুষ বড় আজিব প্রাণী। তারা সুখের জন্য সকাল থেকে সন্ধ্যা মাথার ঘাম পায়ে ফেলছে। অথচ সুখ কিনতে গিয়ে সুখ থেকেই দূরে থাকছে। কেউ বাড়িঘর ছেড়ে ঢাকা বা অন্য কোনো শহরে চাকরি করছেন। কেউ স্বজন-পরিজনহীন দীর্ঘ প্রবাসে কাটাচ্ছেন জীবন। একাকী, নিঃসঙ্গ, ভালোবাসাহীন এক জীবন। আরে ভাই, দু’বেলা ভর্তা দিয়ে ভাত খেয়ে সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে রাতে ঘুমাতে যাওয়ার মধ্যে যে শান্তি, কতো টাকা দিয়ে আপনি কিনতে পারবেন এই প্রশান্তি?
চাকরির আশায় ঢাকা শহরের পথঘাট চষে ফিরছেন। কী আছে শহরে? চাকরি? ব্যবসা? টাকা? জনপ্রিয়তা? কী হবে এসব দিয়ে? অনেকেই হয়তো বলবেনÑ সুখী জীবনের জন্য টাকার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু আমি আপনাকে বলছি―সুখ আপনার সামনে কীভাবে আসছে, সেটা সুখ নয়। সুখ হলো আপনি সেটাকে কীভাবে দেখছেন। আপনি যদি মনে করেন, ধানম-ি বা গুলশানের পঞ্চাশ হাজার টাকার ফ্ল্যাটে থাকাটাই সুখ, তাহলে আপনার জন্য সুখ ওভাবেই ধরা দেবে। আপনি যদি মনে করেন, মা-বাবার সঙ্গে বসে ভাত খাওয়াই আপনার জীবনের আরাধ্য সুখ, সুখ তখন সেভাবেই আপনার সামনে এসে দাঁড়াবে। এটা একান্তই আপনার মানসিকতার ব্যাপার। অর্থ কখনোই সুখের একমাত্র উপকরণ হতে পারে না, সামান্য সহযোগিতা করতে পারে মাত্র। অনেকাংশে অর্থ বরং অনর্থেরই মূল। সিম্পলিসিটি ইজ বেস্ট পলিসি। সামান্য আয় দিয়েও ভালোবাসার তাজমহল বানিয়ে সুখ কেনা যায়।
বিষয়টি বুঝার জন্য একটা গল্প বলা যেতে পারে।
ছুটির দিনের এক সুন্দর সকাল। নীল আকাশে ঝকমক করছে সূর্য। সে সময় আফ্রিকান এক জেলেপল্লির পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন মস্ত বড় এক কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরামর্শক (ম্যানেজমেন্ট কনসালট্যান্ট)। তীরে সবেমাত্র এক জেলে-নৌকা ভিড়েছে। আগ্রহী হয়ে সেদিকে এগিয়ে গেলেন তিনি। অল্প কিছু মাছ সূর্যের আলোতে ঝিলিক দিয়ে উঠছে।
মাছের পরিমাণ দেখে পরামর্শক জেলেকে জিজ্ঞেস করলেন―‘এই কয়েকটা মাছ ধরতে তোমার কতো সময় লেগেছে?’
জেলে উত্তর দেয়―‘খুব বেশি সময় লাগেনি।’
পরামর্শক অবাক হয়ে প্রশ্ন করেন―‘তুমি তাহলে আরও বেশি সময় লাগিয়ে বেশি বেশি করে মাছ ধরো না কেন?’
জেলে কারণ ব্যাখ্যা করে―‘আসলে এই কয়েকটা মাছই আমার এবং আমার পরিবারের জন্য যথেষ্ট। এর চেয়ে বেশি প্রয়োজন তো নেই আমার।’
‘মাছ ধরা ছাড়া বাকি সময়টা কীভাবে কাটাও তুমি?’ পরামর্শকের জিজ্ঞাসা।
‘রাত একটু গভীর হলেই ঘুমাতে যাই। সকাল সকাল উঠে অল্প কিছু মাছ ধরি। তারপর এসে বাচ্চাদের সঙ্গে খেলি, আর বিকেলে নারকেলগাছের ছায়ায় কিছুক্ষণ শুয়ে বসে থাকি, ঘুমাই। সন্ধ্যা নামলে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে বাজারে যাই, একটু পান-টান করি, ড্রাম বাজাই, গান গাই, রাত একটু গভীর হলে হল্লা করতে করতে বাড়ি ফিরি। এসব মিলিয়েই সুখী আর পরিপূর্ণ একটা জীবন কাটাই আমি।’
পরামর্শক বেশ অসন্তুষ্ট ভঙ্গিতে মাথা নাড়িয়ে বললেন―‘দেখো, হার্ভার্ড নামক একটা বিশ্বখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের এমবিএ ডিগ্রিধারী আমি। চাকরি করি একটা বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠানে। আমার মনে হচ্ছে, আমি তোমাকে বেশ সাহায্য করতে পারবো। সবকিছুর মূলে আসলে পরিশ্রম। তোমার আরও বেশি সময় নিয়ে মাছ ধরা উচিত, পারলে সারা দিন। এর ফলে যা হবে, তুমি তোমার পরিবারের প্রয়োজনের অতিরিক্ত মাছ বিক্রি করে দিতে পারবে। মাছ বিক্রির টাকা দিয়ে তুমি এখনকার চেয়ে বড় দেখে একটা নৌকা কিনবে। প্রথমে একটা নৌকা, তারপর দুইটা, তারপর তিনটা। এভাবে তুমি একদিন অনেকগুলো নৌকার মালিক হবে। মহাজন-দালালদের বাদ দিয়ে তুমি তখন নিজেই সরাসরি মাছ প্রক্রিয়াজাত কারখানার সঙ্গে দরদাম করে মাছ বিক্রি করবে। এরপর চাইলে নিজেই একটি কারখানা দিতে পারবে। তখন তুমি অনেক টাকার মালিক। সুযোগ বুঝে তুমি একদিন ছোট্ট এই গ্রামটি ছেড়ে চলে যেতে পারবে শহরে, ভাগ্য ভালো থাকলে ইংল্যান্ডে। সেখান থেকেই তখন তুমি পরিচালনা করতে পারবে তোমার ব্যবসা।’
‘কতো দিনের মামলা এটা?’ জেলের কণ্ঠে কৌতূহল।
‘এই ধরো, ১০ বছর। ২০ বছরও লাগতে পারে।’
‘এরপর কী হবে?’ জেলের কৌতূহল বাড়ছেই।
‘তারপর? আরে, এরপরই তো আসল ঘটনা ঘটবে। মজা পাবে তুমি নিশ্চিত।’ হাসিতে মুখ উদ্ভাসিত পরামর্শকের। ‘ব্যবসা যখন তোমার সত্যিই বড় হবে, তুমি তখন তোমার প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ছাড়তে শুরু করবে বাজারে, দেখতে দেখতে কোটিপতি!’
‘আচ্ছা, আচ্ছা! কোটিপতি! সত্যি! এরপর কী হবে?’ উৎসাহে টগবগ করতে করতে জানতে চায় জেলে।
‘এরপর তুমি তোমার এই বিশাল ব্যবসা থেকে অবসর নেবে একদিন, ইচ্ছে হলে চলে যাবে নীল সাগরের ধারে জীবনের বাকি দিনগুলো আনন্দে কাটানোর জন্য। সেখানে বানাবে এক বাগানবাড়ি। চাইলেই অনেক রাত করে ঘুমাতে যেতে পারবে, ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনির সঙ্গে খেলাধুলা আর গল্পগুজব করে সময় কাটাবে, তাদের নিয়ে মাছ ধরতে যাবে সাগরে, পড়ন্ত বিকেলে ঘুমিয়ে পড়বে নারকেলগাছের ছায়ায়, সন্ধ্যায় ঘুম থেকে উঠে কমিউনিটি ক্লাবে গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেবে, পান করবে, গান-বাজনা করে হল্লা করে বাড়ি ফিরবে গভীর রাতে…।’
‘ধুর, আমি তো এখন সেটাই করছি। তাহলে সুখী হওয়ার জন্য আমার এতো বছর লাগিয়ে এতো কষ্ট করার কী প্রয়োজন?’
স্পষ্টতই হতাশ কণ্ঠে উত্তর দিয়ে নিজের পথ ধরলো জেলে।