এক
চোখে দেখা যায় না এমন ক্ষুদ্র এক অণুজীব থেকে হওয়া মহামারিতে থমকে গিয়েছে পুরো পৃথিবী। এমনটা নিশ্চয়ই কখনো হয় নি- গত শতক কিংবা তার আগের শতকের মহামারিতেও পৃথিবীর এমন রূপ কল্পনা করতে পারে নি কেউ। বরং কল্পনার চেয়েও অনেক এগিয়ে যাওয়া আধুনিক বিশ্বের কল্পনাকেও ছাড়িয়ে গেছে এ ভাইরাস।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে ঘটে যাওয়া দুটি ভয়াবহ বিশ্বযুদ্ধ বদলে দিয়েছিল পৃথিবীকে। তবে সেই যুদ্ধের ভয়াবহতা এভাবে ছড়িয়ে যায় নি সবখানে। যুদ্ধে লিপ্ত দেশ এবং তাদের ওপর নির্ভরশীল রাষ্ট্রগুলো আক্রান্ত হয়েছিল শুধু। কিন্তু এই করোনা ভাইরাসের কাছে মনে হয় দুটি বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতাও পরাজিত।
পৃথিবীর পরাশক্তিগুলোর মাথা নিচু করে দিয়েছে এই করোনাভাইরাস। নিজেদেরকে নিরাপদ ভাবা মহাদেশগুলো কিংবা উন্নত প্রযুক্তির চিকিৎসা ব্যবস্থা আছে এমন দেশগুলো হয়ত এই প্রথমবারের মত অসহায়ত্ব কাকে বলে জানতে পেরেছে। যে ইউরোপিয়ান পাসপোর্টের কথা শুনলে চকচক করে ওঠত সবার চোখ, যার মাধ্যমে ভিসা ছাড়াই ঘুরে বেড়ানো যেত পৃথিবী, সেই পাসপোর্টধারী মানুষদেরই বেশি বিপদে পড়তে হয়েছে আগে।
বিজ্ঞানকে অসহায় হতে দেখেছে পৃথিবীর মানুষ এই প্রথমবারের মত। অবিশ্বাসী-যারা বিজ্ঞানকেই সর্বশক্তিমান বলে মনে করে, তারা গা ঢাকা দিয়েছে এই সময়।
গত দেড়মাস ধরে একসঙ্গে থেমে গেছে পুরো পৃথিবী। কাজকর্ম ফেলে ঘরবন্দী হয়েছে মানুষ প্রাণ ভয়ে। কমে গেছে মানুষের সৃষ্ট ভ‚কম্পনের মাত্রা। বন্যপ্রাণীরা নির্ভয়ে ঘোরাফেরা শুরু করেছে লোকালয়ে। জনশূন্যে সমুদ্রতীরে ওঠে এসেছে কচ্ছপ-কাঁকড়ার দল। ধূলোমুক্ত হয়ে আবার স্বচ্ছরূপে দেখা দিয়েছে নীল আকাশ।
আমরা জানি না, মহান স্রষ্টা কেন তার এই সৈন্যদল পাঠালেন পৃথিবীতে? কোন প্রজ্ঞা লুকিয়ে আছে তা তিনিই ভালো জানেন। যে যাই বলুক, সবকিছু থেকে অনেক উর্ধ্বে তিনি, সুমহান আমাদের প্রতিপালক। তাঁর মহিমা গায় নভোমণ্ডল, এই পৃথিবী এবং যা কিছু আছে তাতে।
এই সময় পৃথিবীর সবাই চিন্তিত। কেন এই ভাইরাসের আক্রমণ, কেন পরাজিত হওয়া মানুষের, কেন অসাড় হয়ে যাওয়া জ্ঞান-বিজ্ঞানের? নানাজন নানাভাবে ব্যাখ্যা করে। সেসব ব্যাখ্যায় যুক্তির প্রাধান্য থাকলেও বাস্তবতার বড় অভাব।
একজন বিশ্বাসী মানুষের কাছে এর ব্যাখ্যা কী সেটাই সবচে গুরুত্বপূর্ণ। যিনি বিশ্বাস করেন, সবার চেয়ে শক্তিমান একজন স্রষ্টা আছেন, এই পৃথিবীর একটা শেষ আছে এবং আছে আমাদের সব ভালো-মন্দ কাজের মূল্যায়ন, তার কাছে এই দুর্যোগ স্রষ্টা প্রদত্ত একটি পরীক্ষা মাত্র।
এতে ভয় পাবার কিছু নেই, নেই বিচলিত হওয়ার কোনো কারণ। যদি অসুস্থ হই, যদি ভাগ্যে মৃত্যু থাকে তাহলে সে তার সময়মতই আসবে। আর সুসংবাদ তো দেয়াই আছে আগে থেকে।
যারা বিশ্বাস করেছে এবং তাদের বিশ্বাসের সাথে মিশ্রিত করে নি শিরক, তাদের জন্য আছে নিরাপত্তা। আর সত্যি বলতে বিশ্বাসী মানুষের তো কখনো মৃত্যু হয় না। তার স্থানান্তর ঘটে। মৃত্যু তার জন্য নশ্বর জীবন থেকে অনন্ত জীবনের পথে যাত্রা। আর সেই যাত্রাও অনেক সম্মানের। মহামারীতে মৃত্যু হলে তার জন্য আছে শাহাদাতের সুসংবাদ।
তাই বলে অবশ্য বুক পেতে মৃত্যুর অপেক্ষা নয়। মহামারীতে কীভাবে বাঁচতে হয় সে কথা শিখিয়ে দিয়েছেন রাসূল সাঃ। ঘরে থাকা, সর্বোচ্চ সাবধান থেকে তারপর আল্লাহর ওপর ভরসা করা এটাই প্রকৃত আদর্শ। বেদুইনের মতো উট না বেঁধে তাওয়াক্কুল করা কখনো ঈমানের পরিচয় নয়।
দুই
পৃথিবীতে মানুষের অনেক দৈন্যতা আছে। করোনার এই সংকটে সেসব দৈন্যতা আরও ভালো করে ফুটে ওঠেছে। রাজনৈতিক দৈন্যতা, সামাজিক দৈন্যতা, চিন্তাগত দৈন্যতা কিংবা ধর্মীয় দৈন্যতা। সব দৈন্যতা বাদ দিয়ে ধর্মীয় দৈন্যতার কথা বলি। মহামারির এই সময়ে মৃত্যুর মিছিল দেখে এখন আর অন্য দৈন্যতা নিয়ে দুঃখ করতে ইচ্ছে হয় না।
সবুজে ঘেরা আমাদের ছোট্ট এই দেশটা আলেম-ওলামাদের উর্বরভূমি বলেই আমরা জানি। সত্যিও তাই। এদেশের হেন কোনো গ্রাম নেই যেখানে মসজিদ-মাদরাসা পাওয়া যাবে না। এইসময়ে এসে মনে প্রশ্ন জাগল, আমাদের ধর্মীয় পড়াশোনা কতটা বাস্তব এবং জীবনমুখী?
মাদরাসার পাঠ্যসূচীতে মুসলিম উম্মাহর সর্বকালের গ্রন্থগুলো থাকলেও পড়ানোর পদ্ধতি এখনো প্রশ্ন তোলার মত। মতভেদপূর্ণ কিছু মাসয়ালা-মাসাইল শেখাই কখনো কখনো একজন শিক্ষার্থীর উৎকর্ষতা বিচারের মানদণ্ড বলে বিবেচিত হয়ে থাকে। তার একটা ফলাফল আমরা দেখেছি এই সময়ে। মসজিদ বন্ধ হওয়া নিয়ে নানা ওয়াজ মাহফিলে আমরা যেসব বক্তব্য পেয়েছি তা শুনে কেউ যখন বলে মাদরাসায় কিছু শেখানো হয় না তাহলে তার এ কথার উত্তর দেয়া কঠিন হয়ে যায়।
মাহফিল রক্ষার জন্য অনেকে অনেক চেতনাপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন। প্রযুক্তির এই যুগে যেখানে একটু কাশি দিলেও তা সচিত্র সবার কাছে ছড়িয়ে পড়ে সেখানে ভেবে চিন্তে কথা বলা প্রয়োজন ছিল। যাদেরকে দেশের অন্যতম জ্ঞানী মনে করা হয়, হাজার হাজার টাকা খরচ করে ঘন্টাখানেকের জন্য যাদের বক্তব্য শোনা হয় তারা কীভাবে এমন যুক্তি বিবর্জিত কথা বলেন তা ভাবলেও অবাক লাগে। সবচে আশ্চর্যের বিষয়, এসব মাহফিলে বসে থাকা শ্রোতারাও খুব উৎসাহ নিয়ে এমন বক্তব্য শুনেন এবং সব শক্তি ব্যয় করে তাকবীর ধ্বনি দেন।
প্রথমে বলা হয়েছিল, চীনের মুসলিম নিধনের শাস্তি এই করোনা। তারপর বলা হলো, ইউরোপের খ্রিস্টানদের ওপর গযব। কোনো মুসলমানকে করোনা আক্রান্ত করতে পারে না। অথচ ততদিনে করোনা আমাদের ঘরে ঢুকে গেছে।
বলতে দুঃখ হয়, এসব বক্তব্য ইসলামের লাভ বৈকি ক্ষতি বয়ে আনে। সমাজের কাছে ইসলাম একটা যুক্তিহীন ধর্ম বলে প্রমাণিত হয়। খুব ভালো করে বোঝা উচিত, টুপি পাঞ্জাবি নিয়ে সবার সাথে তাল মিলিয়ে যা করছি তাই ইসলাম না। ইসলাম আল্লাহর দেয়া এক শ্বাশ্বত বিধান, কুরআন-হাদিস তার একমাত্র মানদণ্ড।
তিন
ঘরবন্দী হয়ে আছে পুরো পৃথিবীর মানুষ। এই সময়টা কারও কারও কাছে বেকার। তীব্র সংকটপূর্ণ সময় তো অবশ্যই। তবু চাইলে এর থেকে আমরা ভাল কিছু নিতে পারি। বলা যায়, তারা আহার দান করে তার প্রতি আসক্তি থাকা সত্তে¡ও সূরা দাহরের এই আয়াতের আদর্শে সজ্জিত হওয়ার মোক্ষম সময় এখন। দুনিয়াতে এমনভাবে থাকো যেন তুমি একজন পথিক বা মুসাফির এই হাদিসের ওপর অনুশীলন করার এবং নিজের অবসরকে ভালো কাজে ব্যয় করে, সময় ও সুস্থতাকে গনীমত মনে করার সুবর্ণ সুযোগই তো এখন।
সময়কে ভাল কাটাতে হলে খুব বড়সড় কিছু করতে হবে তা নয় কখনোই। ঘরের কাজকর্ম করেও আপনি ভাল সময় কাটাতে পারেন। আমাদের মা-বোনরা তাদের সারা জীবন এমনকি প্রজন্মের পর প্রজন্ম কোয়ারান্টাইনে থাকেন। তাদের জীবনটা অনুভব করার সময় এখন। একটু কোথাও নিয়ে যেতে বললে যে আপনি একসময় হয়ত খেঁকিয়ে ওঠতেন এখন একটু ভেবে দেখুন। তাদের কাজ-কর্মের বোঝা কমিয়ে তাদের পাশে থেকেও অনেক বড় অর্জন আপনি করতে পারেন এই সময়ে।
এই সময়ে কে কী করছেন তার একটা হিসাব আমরা ঘরে বসে পাই সোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে। কেউ অনলাইনে কোর্স করে, বই পড়ে বা কোনো কিছু শিখে সময় কাটাচ্ছেন। অনেকে অভাবীদের কাছে খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দেবার মত মহৎ কাজে ব্রত হয়েছেন দুঃসাহস নিয়ে। আর কেউ কেউ সময় কাটাচ্ছেন ফেসবুক স্ক্রল করে, টিকটকের ভিডিও দেখে আর পাখা বন্ধ করলে কতবার ঘোরে তা হিসাব করে।
সবশেষে একটা গল্প বলি। জনপ্রিয় একটি টিভি অনুষ্ঠানের উপস্থাপকের কাছ থেকে শোনা। এক বৃদ্ধাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, মা! আপনি কি করোনা ভয় পান ? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, বাবা! করোনা কি ইসরাঈলের ছোঁড়া রকেটগুলোর চেয়েও বেশি ভয়ংকর? অথবা রুশ বাহিনী, দামেশকের বোমা কিংবা মার্কিন যোদ্ধাদের চেয়ে? নাকি করোনা অনেক বেশি কঠোর? যেমন কঠোর আবুধাবি এবং রিয়াদ ইয়েমেন ও লিবিয়ার সাথে। অথবা মিসরের সেনাবাহিনী জনগণের সাথে? করোনা কি ইরানের মত লোভী? তুরস্কের মত উচ্চাভিলাষী বা অথবা কাতারের মত দুর্যোগ সৃষ্টিকারী? করোনা কি বেশি নিষ্ঠুর যেমন নিষ্ঠুর চীন উইঘুর মুসলিমদের প্রতি? অথবা মায়ানমার রোহিঙ্গাদের প্রতি কিংবা ভারত কাশ্মীরের প্রতি?সোভিয়েত ইউনিয়ন বা আমেরিকার মত নিষ্ঠুর? অথবা করোনা কি এত নিষ্ঠুর যেমন ছিল সার্বিয়া বসনিয়ার মুসলিমদের প্রতি? কিংবা রাশিয়া যেমন নিষ্ঠুর ছিল চেচনিয়ার প্রতি। করোনা কি অনেক বেশি ভয়ংকর ধর্মের নামে মানুষ হত্যার চেয়ে?
তারপর বিড়বিড় করে বললেন, আমরা এতদিন ছিলাম নির্যাতিত বিশ্বে। আজ পুরো পৃথিবী আমাদের মত। আজ সবাই সমান।
বানানো গল্প তাতে সন্দেহ নেই। তবে খুব বেশি বাস্তব। বিশ্বের পরাশক্তিগুলো এতদিন অন্যকে মারার জন্য অস্ত্র বানিয়ে এসেছে। আমরাও আধুনিক অস্ত্রের মজুতকে শক্তির মাপকাঠি বলে জেনেছি। কিন্তু এখন টের পাওয়া গেল, অন্যকে মারার সব সরঞ্জাম থাকলেও নিজেদের বাঁচার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণের বড় অভাব সবার কাছে। করোনা এইটুকু উপলব্ধি তৈরি করে বিদায় নিক পৃথিবী থেকে এটাই কামনা।