দীর্ঘদিন চলার পর যাত্রা বিরতি। কাফেলা থেমেছে হালবে।
এর আগে এত বড় কোনো কাফেলার সাথে সফর করিনি। প্রায় একশোর মতো বাণিজ্যিক ক্যারাভ্যান। তিন-চারশো পণ্যবোঝাই উট৷ ততধিক গাধা খচ্চরের পিঠেও মাল-সামানা চাপানো৷ বণিকদের পাশাপাশি সাধারণ যাত্রীও রয়েছে অনেক৷ নারী-পুরুষ, যুবক-বৃদ্ধ—সবাই৷ কেউ কেউ সপরিবারেও যাচ্ছে। কয়েকজন খ্রিষ্টানকেও দেখেছি। তারা বাইজাইন্টান সীমানা পার হয়ে কৃষ্ণসাগর দিয়ে জর্জিয়া যাবে৷ যাত্রা শুরু করার আগে একজন সৈনিকের সাথে সফরের নিরাপত্তা বিষয়ক কথা বলছিলাম। এরা সাধারণত সুলতানের নিয়মিত সৈন্যদের থেকেই হয়৷ যদিও এর জন্য সফরকারীদের আলাদা করে পয়সা গুনতে হয়। সাথে ভাড়াটিয়া সৈনিকও থাকে, তবে এটা কম। মাঝবয়েসী সৈনিকটি আমাকে জানাল—এ-বছর সুলতান সফরের নিরাপত্তার জন্য তিনশো সৈনিকের একটি ইউনিট নিয়োগ দিয়েছেন৷ প্রথমে আশ্চর্য হয়েছিলাম—আমরা কি যুদ্ধে যাচ্ছি নাকি!? হা হা! পরে ভেবে দেখলাম, এত বড় কাফেলার নিরাপত্তার জন্য এই সংখ্যাটা মোটেও অতিরঞ্জিত নয়। পথে কখন কী বিপদ এসে পড়ে, বলা তো যায় না৷
যাত্রা শুরু হলো। শনিবার দিন এক মহাসমারোহে দামেস্ক থেকে কাফেলা চলতে শুরু করল। দিনটা ছিল ঈদের দিনের মতো। শহরজুড়ে সাজসাজ রব। শীত-পণ্য নিয়ে বসে থাকা বণিকদের মুখে মুখে হাসি৷ রাস্তার বরফ গলে গিয়েছে। ঝোপঝাড় গাছগাছালি বিস্তৃত মাঠ ফের সবুজ হয়ে উঠছে৷ প্রকৃতিতে বসন্তের হাওয়া বইছে। এখন ঘুমিয়ে পড়া সবকটি শহর আবার জেগে উঠবে। এক দেশের বণিক পণ্য নিয়ে আরেক দেশে ছুটবে!
পুরো শীত দামেস্কে কাটিয়েছি মুসাফিরের মতো৷ কিছুদিন জাইওয়াতে (দরবেশ লজ), কিছুদিন সরাইখানায়। আবার কিছুদিন মাদরাসায় শিক্ষকতা করার সুবাদে সরকারি প্রাসাদেও থাকতে হয়েছে৷ এখন এই অস্থায়ী ঠিকানা ত্যাগের সময় কোথাও যেন কিছু একটা নড়ে উঠল। আমি অনুভব করলাম—মনটা হঠাৎই খারাপ হয়ে গেছে। অথচ সেটা হওয়ার কথা নয়। মানুষের হৃদয় কখনো ঘরবাড়ির জন্য তড়পায় না, তড়পায় সেই ঘরবাড়ির মানুষদের জন্য। আমার মতো ঘরছাড়া মানুষের তেমন কেউ আছে এই শহরে? এই প্রশ্নের উত্তর মাথায় নিয়ে সবার সাথে শেষ সাক্ষাৎ করলাম। মানুষজনের সাথে চিন-পেহচান যা হয়েছিল সবই চলাফেরার সুবাদে৷ সরাইখানার মালিক আবার দামেস্কে আসলে তার এখানে ওঠার বিনীত আবেদন জানায়। মাদরাসার প্রধান উস্তাদ সেই পুরোনো টোপটা আবার দেয়। স্থায়ীভাবে দামেস্কে থেকে যাওয়ার আবদার করে। সরকারি চাকরি, উচ্চপদস্থ পরিবারে সাথে আত্মীয়তার প্রলোভন দেখায়। আমি নীরবে হাসি। ক্যারাভনে ওঠার আগে—আমি যেই জাইওয়াতে শুরুর কিছুদিন ছিলাম, সেখানের প্রধান দরবেশ আমার হাত ধরে বলেন—‘আমি জানি সালেক, সত্যিকারের মুসাফির কখনো তার পদচিহ্নে পা রাখে না৷ যেই সত্যের সন্ধানে তুমি পথ চলছ, এর উপর অটল থেকো। অতীতের সুখ নিয়ে কখনো গর্ববোধ কোরো না, তেমনি পেছনের দুঃখের দিকেও কখনো ফিরে তাকিয়ো না৷ সত্যকে পেয়ে কখনো পায়ে ঠেলতে নেই, তাকে সাদরে বরণ করে নিতে হয়৷
***
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম৷ বনে-বাদাড়ে ঘুমানোর অতীত-অভ্যেস বহুত আছে, কিন্তু আজ শরীর-মন দুটোই ক্লান্ত। একটানা এতদূর পথ কখনও চলিনি। কাফেলার সরদার বারবার বলে গেছেন, ঘনঘন বিশ্রাম চলবে না৷ এতবড় কাফেলা কোথাও থামলে সবকিছু গোছগাছ করতে করতে অনেক সময় লাগে৷ আমাদের দ্রুত চলা উচিত। সিদ্ধান্ত হলো—দিনে একবারে সন্ধ্যার আগে আগে সুবিধা মতোন জায়গায়, নদী বা পাহাড়ি ঝর্ণা দেখে কাফেলা থামবে। সেখানে রাত্রিযাপন শেষ করে একদম ভোরে আবার পথচলা শুরু হবে৷
কেউ একজন ফিসফিস করে আমার নাম ধরে ডাকছে। ঘুম ভেঙে গেল। বিরক্তিকর ব্যাপার! রাত গভীর হয়েছে অনেক। আকাশি গাছের পাতায় ছরছর শব্দে বাতাস ভেসে বেড়াচ্ছে। চোখের পাতা কোনোরকমে খুলে দেখার চেষ্টা করলাম একবার। বাইরে মশাল জ্বলছে। সেই আলোতে আগন্তুকের চেহারা চেনা গেল না। কাপড়ের অস্থায়ী তাঁবু। উত্তর দিকে দরজার মতো করে আলাদা কাপড় ঝুলানো। সে কাপড় এক হাতে উঁচিয়ে আগন্তুক মাথা ঢুকিয়ে ফিসফিস করে ডাকছে। হাত বাড়িয়ে বালিশের নিচে খঞ্জরের উপস্থিতি পরখ করে নিলাম। আগন্তুক এখন আর কথা বলছে না। দরজার মুখে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে কোমরে খঞ্জরটা লুকিয়ে নিলাম আগে, তারপর শরীরে চাদর চাপিয়ে দরজার দিকে পা বাড়াতেই আগন্তুক আস্তে করে সরে গেল। এতক্ষণে আমার ঘুম পুরোপুরি কেটে গেছে৷ কৌতূহলের পরিবর্তে ভেতরে বিরক্তি পয়দা হলো। রাত-বিরাতে তাঁবুতে চুরি-ছিনতাই নিত্যদিনের ঘটনা। কিন্তু এভাবে নাম ধরে, ডেকে কেউ চুরি করতে আসে!
আকাশে গোল হয়ে চাঁদ উঠেছে৷ জোছনার আলোয় বিশ্বচরাচর ভেসে যাচ্ছে। নদীর তীর ঘেঁষে তাঁবু ফেলা হয়েছিল, অদূরেই নদী। নদীর কলকল ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। সারি সারি তাঁবুর সামনে মশাল জ্বলছে। এ মশাল জ্বলবে সারারাত। তাঁবুর এলাকা পেরিয়ে, মাঠ পেরিয়ে নদীর কাছে এসে থামলাম৷ কোথাও কেউ নেই৷ তীর ঘেঁষে প্রশস্ত রাস্তাটা চলে গেছে সোজা পশ্চিমে। আমি হাঁটতে থাকলাম৷ পাখিদের ডানা ঝাপটানো থেমে গেছে৷ বাতাস বইছে ধীর স্বরে, কিন্তু শব্দহীন। উইলো গাছের পাতা ভেদ করে জোছনার আলো রাস্তায় ছড়িয়ে ছড়িয়ে আছে৷ কিছুক্ষণ আগের ঘটনাকে স্বপ্ন বলে মনে হলো। এই নিস্তব্ধ রাতের আত্মচিৎকার, যেন-বা কোনো মর্সিয়া, কিংবা এক ঘোরলাগা বাঁশির সুর আমাকে বিছানা থেকে টেনে এনেছে এই অচেনা পথে!
রাস্তাঘাট তখনো আমার চেনা ছিল না তেমন৷ এক বিকেলে জাইওয়া ছেড়ে দিলাম। দরবেশজি দুআ-খায়ের করে টাঙায় তোলে দিলেন। আমি তাঁর হস্তচুম্বন করে বিদায় নিলাম৷ ঘোড়ার গাড়ি আমাকে শহরের শেষে একটি বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে গেল। ভাড়া নিল না চালক৷ যেতে যেতে বলল, শাইখ ফুসতাতের এই টাঙা ভাড়ায় খাটে না কখনো। উঁচু পাঁচিলে-ঘেরা রাজকীয় তোরণের ওপাশে প্রাসাদোপম বাড়ি৷ বিকেলের মরা আলো পাঁচিলের গায়ে এসে পড়ছে৷ আমি তাকিয়ে রইলাম৷ দুইদিনের জন্যও মানুষের কত আয়োজন!
শাইখ ফুসতাতের ব্যক্তিগত কুতুবখানা মানমন্দিরের মতো, বড়সড় ধরনের। ছাদ আকাশ ছুঁয়েছে যেন। কিতাবপত্রের আলমারি দেয়াল জুড়ে দাঁড় করিয়ে রাখা। সে-সব ভর্তি শতশত বইপত্র। এক আলো-আঁধারির পরিবেশে পৃথিবীর আশ্চর্য দুইজন মানুষ; পিতা ও কন্যার মুখোমুখি আমি। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন শাইখ ফুসতাত—যিনি একটি চিরকুটের কল্যাণে আমার চাচা হয়ে গেছেন—‘পথে পথে আর কত ঘুরবে, বেটা? মানুষের জীবন কি এভাবে মাথা কুটে মরার জন্য? পরিবার-পরিজন ছেড়ে এতদূর এসেছ, কখনো কি মনে হয়নি এবার ঘরে ফেরা উচিত? নিজেকে এবার স্থির করো আহমদ। তোমার পিতার মৃত্যুর পর হিন্দুস্থানে আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি। মাঝখানে কেটে গেল কত বছর। চোখের পলকেই যেন জীবনটা ফুরিয়ে গেল।’
চুপ রইলাম৷ তিনি ভেজা গলায় আবার বললেন—‘তুমি দামেস্কে থেকে যাবে৷ আর কোথাও যাওয়ার দরকার নেই৷ যেভাবে ইচ্ছা, যেখানে থাকতে চাও, থাকবে। সব ব্যবস্থা করে দেবো আমি। কারো উপর জোরাজুরি করি না কখনো।’
নীরব-ই রইলাম৷ ভালোবাসাকে উপেক্ষা করার শক্তি মানুষের থাকে না। কিন্তু আমার থাকতে হবে। দামেস্কে ঘর-সংসার করার নিয়তে যাত্রাবিরতি করিনি, পথ চলতে চলতে থেমেছিলাম শুধু। তারপর শীত এল৷ বরফে ঢেকে গেল পথ। আমি আটকে গেলাম।
দামেস্কে পৌঁছাতে পৌঁছাতে আমি ফতুর হয়ে গিয়েছিলাম৷ একবারে পকেটশূন্য যাকে বলে৷ আশ্রয় নেওয়ার নামে একটি জাইওয়াতে উঠেছি। দুইবেলা খাবার মিলে কি মিলে না, ভাগ-বাটোয়ারা করে খেয়ে নিই। দিন-মান ঘুরে বেড়াই৷ একঘরে হয়ে থাকতে আর ভাল্লাগে কত৷ সারাদিন কতো মানুষের আনাগোনা জাইওয়াতে৷ বিশেষত সন্ধ্যার পর থেকে৷ নানা বয়সের, নানা পেশার৷ এরমধ্যে আবার বণিকরা বেশি। দলবেঁধে, একা। আসে, কথা বলে৷ কেউ কেউ দু-একবেলা থেকেও যায়। সে-সময়টাতে তাদের চেহারা ও চলাফেরায় আশ্চর্য এক সুখানুভূতি লক্ষ করেছি। দীর্ঘ সময় নিয়ে তারা দরবেশজির সাথে কথা বলে। প্রথম প্রথম ভেবেছিলাম—জরুরি কোনো বিষয়ে বাতচিত হবে৷ পরে একদিন এশার পর, খেয়ে-দেয়ে জলসায় বসলাম। দেখি—এক বণিক কিসসার পর কিসসা শুনিয়ে যাচ্ছে। তার ব্যবসার লাভ-লোকসানের কথা বলছে৷ কখন, কোথায় পণ্য নিয়ে গিয়েছে, কী কী ঘটনা ঘটছে বা শুনেছে, ফুল-লতাসহ বর্ণনা করছে৷ এক মুগ্ধময় রাতে কিসসা শুনতে শুনতে কখন যে ফজরের আজান হয়েছিল, টেরও পাইনি।
দীর্ঘ সময় নৈঃশব্দে কেটে গেল৷ কুতুবুখানায় নীরবতা বিরাজ করছে৷ হঠাৎ কোথায় যেন নুপুর বেজে উঠল৷ এই প্রথম আমি তার গলার আওয়াজ শুনলাম৷ নেকাবের আড়ালে থেকেও স্বর যেন মেরামের বেণুবন থেকে উন্মুলিত কোনো বাঁশির সুর। সে বলল—‘এই পথে পথে ঘুরে আপনার লাভ কী?’
প্রশ্নে কোনো জিজ্ঞাসা ছিল না। তবু আমি হাসলাম। একটু জোরেই হয়ে গেল কিনা। ঘরজুড়ে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল৷ নিজেকেই শুধালাম—‘আসলেই তো! এভাবে ঘুরে-ফিরে কি লাভ রে তোর?’ উত্তর এল—‘লাভ-লোকসানের হিসাব তো করিনি কোনোদিন। বারবার ভেবেছি, অনেককে বুঝানোর কোশেশও করি, পথ যদি আমাকে ফিরিয়ে না দেয়, নিজ থেকে ঘরবন্দী হতে যাব কেন৷ এ পথ তো আমার কাছে কবিতার মতো সুন্দর, এ নদী কথা কয় নারীর মতোন। আর এ জীবন—মানতিকুত তাইয়্যারের হুদহুদের মতো নয় কি!’
কিন্তু এ নারী নদীর কলকল শব্দে বইতে পারেনি কোনোদিন।
চমকে উঠে আমাকে পেছনে ফিরতে দেখে সে অস্ফুটস্বরে হাসল৷ যেন অস্বাভাবিক কিছুই ঘটেনি। বলল—‘আপনাকে একবার তাবরিজির কথা বলেছিলাম, মনে নেই?’ আমি কি ঘুমিয়ে পড়ছিলাম আবার৷ দূ্রত্ব কমিয়ে সে আরো কাছে এগিয়ে এল। বাতাস তার চুল এলোমেলো করে চেহারা ঢেকে দিচ্ছে। আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে দ্বিতীয়বার সে-ই কথা বলল—‘বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। একা আসিনি এখানে৷’পেছনে ইশারা করে দেখাল। মুস্তারি দাঁড়িয়ে আছে৷ ‘ওই-ই আপনাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে এনেছে৷’
সত্যিই আমি অপ্রকৃতস্থ হয়ে পড়েছিলাম৷ সে আগে আগে হাঁটছে৷ মনে হলো নদী তার পথ ভুলে দামেস্কের অচেনা কোনো পথে বয়ে চলছে কলকল৷ কিছুক্ষণ হাঁটার পর পথ ফুরিয়ে গেল। ভঙ্গুর একটি বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছি৷ চাঁদের আলোয় ছাদের চূড়া চকচক করছে৷ মেহরান বলল—‘আপনি বোধহয় জানেন না, এই বাড়িতে একসময় মওলানা থাকতেন৷ আমি চুপ করে রইলাম৷’
‘জালালুদ্দিন রুমির যুবক বয়সে যখন তাঁর পিতা দামেস্কে পাঠিয়েছিলো তাঁকে পড়াশোনার জন্য, তখন শহর ছাড়িয়ে, জনমানুষের কোলাহলমুক্ত এই বাড়িটিই ছিল তাঁর আবাসস্থল। এই পথ, শিশু গাছের এই গহীন বন, পাহাড়ের চূড়া থেকে নেমে আসা ঝরনার কোল—এসব হয়ে উঠেছিলো মওলানার ধ্যানগৃহ।
‘আরো আশ্চর্য কি জানেন, তাবরিজিকে যখন হিংসুকরা কোনিয়া থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল, তখন এই বাড়িতেই উঠেছিলেন সুফি শামস্৷’
আমি কি করব বুঝতে পারছিলাম না। খুব করে চাইছিলাম স্বপ্নটা যেন ভেঙে যায়। কিন্তু সে আবার হাঁটা শুরু করল। আমি অধৈর্য হয়ে উঠছিলাম। কয়েক পা এগুতেই সাহস করে তার বাম হাতটা খপ করে ধরে ফেললাম। এ-কাজটা করতে গিয়ে আমার বুক একটুও কাঁপেনি। বললাম—‘এই রাত্রে মওলানার দাস্তান শুনাতে তুমি আমাকে ডাকিয়ে আনলে মেহরান!’
সে স্থির রইল৷ আলতো হেসে বলল—‘আহা, আরেকটু পথ হাঁটুন না৷ এত অধৈর্য হলে হয়! পবিত্র কুরআন কি আপনাকে ধৈর্য ধরতে বলেনি?’
হাত না ছাড়িয়েই সে হাঁটতে লাগল৷ কিছুক্ষণ পর একটি পাহাড়ি ঝর্ণার সামনে এসে থামলাম আমরা৷ চাঁদের আলো কি কিছুটা কমে গিয়েছিল তখন? তবু আমি সব স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। পাহাড়ের গা বেয়ে কলকল শব্দে পানি ছুটে আসছে নিচের দিকে। জমিনের ছোঁয়া পেতেই চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে চাঁদের আলোয় ঝলমল করা রুপালি পানি৷ বুঁদবুঁদ তৈরি হচ্ছে, আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। এক অপূর্ব নৈসর্গিক দৃশ্য আমার সামনে উন্মোচিত হয়ে রইল।
মেহরানের ডাক শুনেও আমার ঘোর কাটল না তখন। কোনোরকম ফিরে দেখি সে অদূরে দাঁড়িয়ে। বলল—‘আমি চলে যাব সকালে। ফুপির বাড়ি যাওয়ার নাম করে কাফেলার সাথে মিশেছিলাম। আপনাকে তো আর বেঁধে রাখা যায়নি, তাই আনন্দের সাথে বিদায় দিতে এলাম৷ খালি হাত ছাড়া আমার আর কিছুই নেই। অনেক ভেবেচিন্তে মওলানার একটি কথা ধার করে এনেছি। একটু ভেবে দেইখেন। দেখবেন? মওলানা তাঁর কাতেব হুশামু্দ্দিনকে একদিন বলেছিলেন—“জানো হুশাম, ভালোবাসা পাথরের ফাটল বেয়ে চুইয়ে পড়া জলের মতো। কতজন তা দেখতে পারে, বলো?”’
ধীরে ধীরে ঘুমি তলিয়ে যাচ্ছিলাম যেন। চাঁদ কি ডুবে গিয়েছে, নাকি শুকতারারা হারিয়ে যাচ্ছে পশ্চিম আকাশ থেকে৷ ওই তো সুবহে সাদিকের সাদা আলো আকাশে ছড়িয়ে পড়ছে৷ হালকা শীত শীত করছে যে৷ সর্বশেষ আমি শুনতে পেয়েছিলাম মওলানা মনসবীর একটি পঙক্তি—‘ঝর্ণার কলকলধ্বনি থেকে বাতাসে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে, পাখিরা যেন দলবেঁধে ডাকছে—ভালোবাসাকে কয়জন দেখতে পায়?’
শিক্ষার্থী, জামিয়া রাহমানিয়া আজিজিয়া, মুহাম্মদপুর, ঢাকা
জানুয়ারি ২০২২