ইন্তেকালের তিন দশক অতিক্রান্ত হয়েছে, কিন্তু কুরআন যাঁরা শোনেন, পৃথিবীর যে অঞ্চলের অধিবাসীই হোন, তাঁদের কাছে এখনও সমানমাত্রায় জনপ্রিয় হয়ে আছেন কিরাআতশিল্পের কিংবদন্তি কারি আবদুল বাসিত আবদুস সামাদ। মিসরের অজপাড়া এক গাঁয়ে জন্মেও তিলাওয়াতের সুর দিয়ে কাঁপিয়ে গেছেন সারা বিশ্ব। কিরাআতশিল্পকে তিনি গ্রহণ করেছিলেন নিজের জীবনের ধ্যান-জ্ঞান হিসেবে। এবং তিনিই প্রথম কারি, যিনি বাণিজ্যিকভাবে তিলাওয়াত রেকর্ড করেছিলেন।
পুরোনাম আবদুল বাসিত মুহাম্মদ আবদুস সামাদ। ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে মিসরের কেনা অঞ্চলের আল-মারাজেহ গ্রামে তাঁর জন্ম। কিরাআত ও তিলাওয়াতে কুরআন বিষয়ে শাস্ত্রীয় পড়াশোনা তাঁদের পারিবারিকভাবেই ছিল। দাদা শেখ আবদুস সামাদ ছিলেন স্থানীয়ভাবে বিখ্যাত একজন কারি। কিরাআত ও তাজভিদুল কুরআন বিষয়ে ছিল তাঁর শাস্ত্রীয় পারদর্শিতা। পিতা মুহাম্মদ আবদুস সামাদ ছিলেন যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা, সরকারি চাকুরে হলেও তিনিও ছিলেন কিরাআত বিষয়ে পারদর্শী।
অতি অল্প বয়সেই আবদুল বাসিত কুরআন হিফজ করে ফেলেন। কুরআনের প্রতি ছিল তাঁর স্বভাবজাত আগ্রহ। তাই কুরআন হিফজের পর নিজ আগ্রহেই ইলমুল কিরাআত বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করেন শায়খ মুহাম্মদ সেলিমের কাছে। সেলিমের শিক্ষালয়টি কারি আবদুল বাসিতের বাড়ি থেকে বেশ দূরে ছিল, কিন্তু কিরাআতের প্রতি আগ্রহের ফলে সেই দূরত্ব তাঁর কাছে দাঁড়াতে পারেনি। প্রতিদিন বাড়ি থেকে পায়ে হেঁটে দূরের ওই শিক্ষাক্ষেত্রে তিনি হাজিরি দিতেন। ফলে মাত্র ১২ বছর বয়সে কিরাআতে সাবআ তথা সাত কেরাতের উপর এবং ১৪ বছর বয়সে ১০ কেরাআতের উপর শাস্ত্রীয় দক্ষতা অর্জন করতে সক্ষম হন। পাশাপাশি পাড়া-মহল্লা ও স্থানীয় পরিসরের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কুরআন তিলাওয়াত করে সবার প্রশংসা কুড়ান।
১৯৫১ সালে পেশাগতভাবে তিনি মিসরের একটি রেডিওস্টেশনে কারি হিসেবে নিযুক্ত হন। তাঁর বয়স যখন ২৫ ছুঁইছুঁই, কায়রোর সাইয়্যিদা যাইনাব মসজিদে কুরআন তিলাওয়াতের এক অনুষ্ঠানে সমকালের বরেণ্য কয়েকজন কারি’র সামনে তিলাওয়াত করার সুযোগ পান। সেই তিলাওয়াতে তাঁর প্রতি নিদারুণ মুগ্ধ হন উপস্থিত অতিথি-অডিয়েন্স নির্বিশেষে সকলেই। এবং মূলত সেখান থেকেই তাঁর খ্যাতির সুবাস ছড়াতে শুরু করে।
তারপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বরিত হতে থাকেন। সফর করেন পৃথিবীর নানা প্রান্তের অনেকগুলো দেশ। একে একে ভারি হতে থাকে তাঁর অভিজ্ঞতা ও অর্জনের ঝুলি। প্রাচ্যের দেশগুলোতে তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন ‘সোনালি সুরের শিল্পী’ খেতাবে, পশ্চিমের লোকেরা তাঁকে চিনতে লাগল ‘ঐশী সুরের জনক’ এবং আরবে তাঁর পরিচিতি দাঁড়ায় ‘সাওতু মাক্কাহ’ নামে৷
১৯৫৬ সালে সিরিয়া সরকারের তরফে কিরাআতশিল্পে পারদর্শিতার জন্য বিশেষ সম্মাননায় ভূষিত হন। ১৯৫৯ সালে সিরিয়ার প্রধানমন্ত্রীর তরফে বিশেষ পদক, ১৯৬৫ সালে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর তরফে বিশেষ পদক, ১৯৭৫ সালে সেনেগালের রাষ্ট্রপতির তরফে বিশেষ সম্মাননা, ১৯৮০ সালে পাকিস্তান থেকে স্বর্ণপদক, ১৯৮৪ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হকের তরফে বিশেষ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা, ১৯৮৭ সালে মিসরের তৎকালীন শাসক হুসনি মুবারকের তরফে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা-সহ দেশবিদেশের আরও নানা সংস্থা ও সরকারের কাছ থেকে বহু পদক ও সম্মানজনক স্বীকৃতি লাভ করেছেন।
১৯৮৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ডায়াবেটিসের রোগী ছিলেন। এর সঙ্গে যুক্ত হয় লিভারের সমস্যা। হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় একপর্যায়ে। কিন্তু স্বাস্থ্যের অবস্থা ক্রমশ খারাপ হতে থাকে। অবশেষে ১৯৮৮ সালের ৩০ নভেম্বর বুধবার কুরআনের এই বিস্ময়কর সুরের কারিগর তাঁর সুরের জাদুতে নিজেকে অমর রেখে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন।
তাঁর জানাজায় স্মরণকালের সবচেয়ে বড় জমায়েত হয়েছিল। মিসরে অবস্থিত প্রতিটা মুসলিম দেশের দূতগণ তাঁদের রাষ্ট্র ও জনগণের তরফে কারি আবদুল বাসিত আবদুস সামাদের জানাজায় অংশগ্রহণ করেন। দক্ষিণ মিসরে, তাঁর গ্রামের বাড়ি আল-মারাজেহেই তাঁকে সমাহিত করা হয়।
তথ্যসূত্র : উইকিপিডিয়া ইংলিশ
ফেব্রুয়ারি ২০২২