মায়াকানন।
পৌষ মাস। শীতকাল।
শহরের কোলাহলপূর্ণ দিন ভালো লাগে না সাজিদের। গতকাল সন্ধ্যায় তার শিক্ষকতার দুই বছর শেষ হয়েছে। প্রতিদিন বাসা থেকে গিয়ে ক্লাস নিয়ে আসে একটি মাদরাসা থেকে। এ-জন্য কোনো বেতন নেয় না। আয়ের জন্য ছোট একটি ব্যবসা আছে। খুব সতর্কতার সাথে হালাল তরিকায় ব্যবসা করে। ছোট্ট এই জীবনকে সে একটি নির্দিষ্ট অনুশাসনের বলয়ে আটকে রাখতে শিখেছে।
সাজিদের রুটিনবদ্ধ জীবনে ব্যত্যয় ঘটে কম।
ভোর হয়েছে। পাখিরা জেগে ওঠার জানান দিচ্ছে। ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনির মধুর কোলাহলে যখন আড়মোড়া ভাঙছে মায়াকানন আবাসিক এলাকাটি, তখন দুটি প্রাণ জায়নামাজে বসে মুনাজাত শেষ করল।
সাজিদ চোখ মুছে ঘড়ির দিকে তাকায়। ডিম লাইটের আবছা আলোতে সে বুঝতে পারে মসজিদে নামায শুরু হতে পঁচিশ মিনিট বাকি।
পৌষের ক্লান্ত দুপুর ছাপিয়ে সন্ধ্যা নামে মায়াকানন আবাসিক এলাকায়। মশা বেড়ে যাওয়ায় ঘরের মেয়েরা জানালাগুলো লাগিয়ে দিচ্ছে।
পাঁচ তলার বারান্দায় বসে কেবলই কালো কালার মগে কফি শেষ করেছে আমাল। গতমাসে সাজিদ এটা গিফট করেছিল। জীবন সঙ্গী হিসেবে সাজিদকে পেয়ে আমাল সবসময় আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে। প্রতিদিন সে সাজিদের কাছে পবিত্র দুটি চোখ আশা করে।
ধ্রুবতারা।
প্রথম কবে এই নামটা শুনেছিল সাজিদের মনে নেই। তবে যেদিন থেকে চিনেছে রাতের আকাশে কোন তারাটাকে ধ্রুবতারা বলা হয়, সেদিন থেকে প্রায় রাতেই একা একা ধ্রুবতারা দেখত সে। অকারণে ভালো লাগা এই কাজটি তাকে আনন্দ দিত।
অনেক চেষ্টা করেও নিজেকে ঘুমের চাদরে জড়াতে পারছে না সাজিদ। বারান্দায় কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করল। আকাশের দিকে নজর পড়তেই মনে হলো ছাদে গেলে ভালো লাগবে। থেমে থেমে শীতল বাতাস বইছে। তবুও চাদর জড়িয়ে সিড়ি ভেঙে ছাদে যায়।সকালে উঠে আমাল খুব মনখারাপ করবে জেনেও তাকে ডাকেনি।
এক ঘণ্টা ধরে ছাদে একা একা হাঁটছে সাজিদ।এভাবে বহুরাত একা হেঁটেছে সে।
কিন্তু আজ একটু অন্যরকম লাগছে। চাঁদটাও আজকে যেন একটু বড় করেই উঠেছে। সত্যিই কি চাঁদে একজন বুড়ি থাকে? তাকে আবিষ্কারের ব্যর্থ চেষ্টা করে এক মনে চাঁদের দিকে তাকায়।
দূরের বাড়িগুলো কুয়াশায় লুকিয়ে থাকে।
মাঝে মাঝে হালকা মেঘ চাঁদের ওপর নির্বিঘ্নে বয়ে চলছে। এ যেন তার নিজস্ব সম্পদ। মেঘকে কখনও কখনও পাহাড়ের মতো লাগে, কখনও সে ছুটে চলা বাহিনীর মতো।
দলবাঁধা মেঘের আকৃতি দেখতে পাহাড়ের মতো। একবার সাজিদ পাহাড় দেখতে গিয়েছিল। ছেলেমানুষি অনেক ইচ্ছেকে তখন বাস্তবায়ন করতে চাইত সে। সবকিছুকে ছাপিয়ে দিনান্তের সূর্য ডুবছিল আর সাজিদ পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে দেখছিল পাহাড় আর সূর্যের সমান্তরাল আলিঙ্গন।
হঠাৎই কারো উপস্থিতি টের পেল।
‘আমাল? কখন আসলে?’
‘তোমার কাছে কেবলই। বাকি দূর থেকে তোমার হাঁটাহাঁটি দেখছিলাম অনেকক্ষণ ধরে। কিছু চিন্তা করছ?’
‘না, এমনিতেই চাঁদগলা অপূর্ব জোছনায় নিজেকে নিয়ে ভাবছি। স্মৃতির মেঘগুলোকে একটুখানি পরখ। এই আর কি।’
‘জানো সাজিদ, আজ কত তারিখ?’
‘সম্ভবত ছাব্বিশে ডিসেম্বর।’
আমাল মোবাইলের স্ক্রিনটা তার সামনে ধরল।
‘বারোটা পঞ্চাশ! তাহলে ক্যালেন্ডারে তারিখ পরিবর্তন হয়েছে দেখছি। জানো আমাল, মা প্রায় জন্মদিনেই বলতেন, তুই এমনই এক শীতের জোছনাময় মুগ্ধ রাতে আমার কোলে এসেছিলি। দেখো, কত সুন্দর প্রভুর নিয়মগুলো। আজও জোছনা। রাতটাকেও খুব ভালো লাগছে। জীবনের সাতাইশটি বছর চলে গেল। কিন্তু মা? তিনি আজ নেই। তিনি অনেক দূরে। অচিনপুরে।’
সাজিদ বলতে থাকে—‘মা, ক্ষমা চাচ্ছি। কত কত রাতে তোমার পেটে লাথি মেরেছি। এমনই এক জোছনা রাতে আমাকে কোলে নিয়েছিলে। কপালে চুমু এঁকে বলেছিলে, ইসরাফিলের সিংগায় ফুঁকে আজ কী আসে যায়।
‘আজ তুমি নেই। আজও জোছনা দেখতে পাই। রাতগুলোও মুগ্ধ হয়। কিন্তু কেউ আর বলে না এমনই এক রাতে তোর জন্ম হয়েছিল। চোখের কোনে শিশির বিন্দুর মতো চিকচিক করে অশ্রুবিন্দু।’
হালকা শীতল বাতাসে সম্মিত ফিরে পায় সাজিদ। আমালের গায়ে সাদা চাদর দেখে ঠোঁটের কোণে একটি হাসির আভা ফুটিয়ে কান্না লুকাবার ব্যর্থ চেষ্টা করে।
ভোর হচ্ছে। কুয়াশার চাদরে ঝুলে থাকে একটি আকাশ। আড়মোড়া ভেঙে জাগতে থাকে মায়াকানন আবাসিক এলাকাটি।
শিক্ষার্থী, মালিবাগ জামিয়া, ঢাকা
জানুয়ারি ২০২২