সিরিয়া! নামটি কানে বাজলেই চোখে ভাসে লাশের পাহাড়। স্বজন-শোকের বুকফাটা আর্তনাদ। সব হারানোর বোবা গোঙানি। ঘরে-বাইরে–সবখানে সারাক্ষণ বোমা হামলার ভয়। আর মৃত্যু-নীল আতঙ্ক। সিরিয়া আজ শক্তিধর দেশগুলোর এক জটিল রণক্ষেত্র। চতুর্মুখী হামলায় বিপর্যস্ত জনজীবন। নিহত হচ্ছে বেশুমার বনি আদম। দিনের পর দিন আগুনের লেলিহান শিখা দাউ দাউ করে জ্বলছে সিরিয়ার পথে-প্রান্তরে। বিধ্বস্ত হচ্ছে মানুষের বাড়িঘর, হাসপাতাল ও মসজিদ। অকালে ঝরে পড়ছে নিষ্পাপ ফুল-শিশুরা। নীরব অভিমানে ঝরে গেল আয়লান কুর্দি। ঝরে গেল ওয়াশিম জাকুর। ঝরে যাওয়ার উপক্রম ওমরান দাকনিশের। এসব ঝরে যাওয়া ফুল-শিশু বর্তমান সিরিয়া সঙ্কটের স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি। এক লাখ ৮৫ হাজার ১৮০ বর্গকিলোমিটারের এই দেশটির নির্মম বাস্তবতার হৃদয়বিদারক সাক্ষ্য দিয়ে গেল ঝরে পড়া ফুলকলিরা।
ওমরান দাকনিশের ছবি পৃথিবীর মানুষকে বারবার জানান দিয়ে যাচ্ছে সিরিয়া সঙ্কট নিরসন কতটা জরুরি। পাঁচ বছরের রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধে জর্জরিত সিরিয়ার আলেপ্পো শহরে উদ্ধার হওয়া এই শিশুর ছবি সারা বিশ্বকে করে দিয়েছে হতভম্ব। ওমরানের ছবিতে ফুটে উঠেছে, এ যুদ্ধ সাধারণ মানুষের মধ্যে কী ভয়াবহ বিপর্যয়ের সৃষ্টি করেছে, তার ছায়াছবি। ওমরান দাকনিশ ছাড়া আরও অনেক সিরিয়ান শিশুর ছবি ইন্টারনেটে লাখো বার শেয়ার করা হয়েছে। ওমরানের নামের সাথে উঠে আসে আরও অনেক শিশুর নাম। সিরিয়ার মাদায়া শহর থেকে ঘিনা ওয়াদি নামের এক শিশুকন্যাকে উদ্ধার করা হয়। যার বয়স মাত্র ১০ বছর। ঘিনাকে উদ্ধারের দাবিতে ৩৪ হাজারেরও বেশি টুইটার ব্যবহারকারী ‘সেভঘিনা’ নামে হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করেছেন। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল থেকে পাওয়া খবরে বলা হয়েছে নিজের অসুস্থ মায়ের জন্য ওষুধ কিনতে গিয়ে স্নাইপারের গুলিতে আহত হয় ঘিনা। এমনকি সিরিয়ার সরকার প্রথমদিকে ঘিনা ওয়াদিকে চিকিৎসার জন্য মাদায়া শহর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে দিতে সম্মত হয়নি। শেষে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও জাতিসংঘের চাপের মুখে সরকার অনুমতি দেয়। ফলে সিরিয়ান রেডক্রিসেন্ট দামেস্কে ঘিনার চিকিৎসার বন্দোবস্ত করতে সক্ষম হয়। এমন শত শত ঘিনা সিরিয়ার অলি-গলিতে নানা বিপর্যয়ের শিকার হচ্ছে।
‘আল্লাহর কাছে আমি সব বলে দেবো’ বলে এক পাহাড় অভিমান বুকে নিয়ে মরে গিয়েছিল এক শিশু। আরেক সিরিয়ান শিশু ভাবছিল মরে যাওয়াই ভালো। কেননা বেহেশতে তো না খেয়ে মরতে হবে না। অথচ ‘যুদ্ধ চাই না শান্তি চাই’Ñএটা পৃথিবীর সব মানুষের ¯েøাগান। তারপরও যুগ যুগ ধরে যুদ্ধের দামামা বেজে চলেছে দেশ হতে দেশান্তরে। আর যুদ্ধের নির্মমতার সবচেয়ে বেশি শিকার হচ্ছে শিশুরা। সিরিয়ার শিশুদের অবস্থাও এই নিয়ম থেকে ব্যতিক্রম নয়। নিকট অতীতে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ একাত্ম হয়ে কেঁদেছে মৃত সিরিয়ান শিশু আয়লান কুর্দির বাবা আবদুল্লাহর সাথে। শিশু আয়লানের ছোট দেহটি বিশ্ব বিবেককে নাড়া না দিতে পারলেও মৃত্যুর পর সারা বিশ্বের বিবেকবান মানুষকে করেছে জাগ্রত। আয়লানের জন্ম সিরিয়ার কোবানি শহরে। কিন্তু তার মৃত্যু তুরস্কের উপকূলে। ক্ষমতাসীন বাসার আল-আসাদের বোমারু বিমান কোবানির ওপর বোমা নিক্ষেপ করেছিল। ঠিক ঐ সময়েই আসাদবিরোধী মার্কিন মদদপুষ্ট জোটও মেশিনগানের গুলিতে জর্জরিত করেছিল কোবানি শহরকে। লাখো লাখো দিশেহারা মানুষ প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে ছুটেছিল সীমান্তের দিকে। অনেকে আশ্রয় নিয়েছিল লেবানন অথবা তুরষ্কে। তাদেরই অন্তর্ভুক্ত ছিল আয়লান কুর্দির পরিবার।
আয়লান কুর্দির মতো ভাগ্যবিড়ম্বিতদের দলে নাম লেখাচ্ছে আরও অনেক শিশু। এক কোটি ৮০ লাখ মানুষের বসতি মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম বৃহত্তম দেশটি আজ পৃথিবীর সবচেয়ে অনিরাপদ জায়গা। তাতে সর্বাধিক অনিরাপদ শিশুরা। ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে বলি হচ্ছে হাজারও শিশুর তাজা তাজা প্রাণ। বিমান হামলায় বৃষ্টির মতো বোমা নিক্ষেপে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে তাদের নিষ্পাপ-কোমল দেহগুলো। শিশুহত্যা যেন সিরিয়ার প্রতিদিনকার ডালভাত। শহরের অলিগলিতে সারি সারি শিশুর লাশ। রক্তের ¯্রােত। ইউনিসেফ, এসএনএইচআর ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচের দেওয়া তথ্যানুযায়ী গত সাত বছরে ২৪ হাজারেরও বেশি সিরিয়ান শিশু মৃত্যুবরণ করেছে। জি নিউজ জানায়, নথি অনুযায়ী ২০১১ সালের পর থেকে এক বছরেরও কম বয়সি ২৬৫ শিশু মারা গেছে সিরিয়ায়। এ ছাড়াও মারা গেছে এক বছরের ১৮৪, দুই বছরের ১৫৭, চার বছরের ২০২, পাঁচ বছরের ২৪৪, ছয় বছরের ১৮৯, সাত বছরের ১৮০, আট বছরের ১৮৩ ও নয় বছর বয়সের ১৫২ জন। বেশিরভাগ মৃত্যুই নথিভুক্ত নয়। তাই এই পরিসংখ্যান একটি খÐিত চিত্র মাত্র।
যুদ্ধে নিহত হওয়া শিশুরা ছাড়া নির্মমতার শিকার হচ্ছে বেঁচে যাওয়া শিশুরাও। প্রতিনিয়ত তারা মুখোমুখি হচ্ছে স্বজন হারানোর শোকের। অসহায়ত্বের। কিন্তু এত এত শিশুর মৃত্যুর পরও আমরা, বিবেকহীন জাতিরা নির্বিকার। প্রতিবাদ নেই। আছে শুধু ভাইরাল ফটো দেখে দেখে মায়াকান্না। অথচ আমাদের মনে রাখা উচিত ছিল, শিশুরা মাটির পৃথিবীতে নেমে আসা এক ঝাঁক স্বর্গীয় পাখি। এক বাগান জান্নাতি ফুল। বিদঘুটে রূপের এই দুনিয়ায় মানুষের মন বিশুদ্ধ রাখার প্রেরণা। তাদের অমানবিক হত্যায়, নিশ্চল নির্বিকার হয়ে বসে থাকায় মানবতার ধ্বংস অনিবার্য।
লিখেছেন : মিরপুর, বাহুবল, হবিগঞ্জ থেকে
মে ২০১৮