গত বছর একটি টিভি চ্যানেলকে দেয়া সাক্ষাৎকারে মুহাম্মদ বিন সালমান বলেছিলেন, মৃত্যুই একমাত্র তাকে থামাতে পারে। এই বক্তব্য নিঃসন্দেহে তার সাহস ও উচ্চাকাক্সক্ষাকে প্রকাশ করে।
বাদশাহ সালমান ক্ষমতায় আসার পর এবং বিশেষ করে যুবরাজ হবার পর থেকে খুব দ্রুত গতিতেই চলছিলেন মুহাম্মদ বিন সালমান। এই নবীন যুবরাজের সাথে ট্রাম্প সহ বিশ্ব নেতাদের সখ্যতাও ছিল
অবাক করার মত । এবার মৃত্যু বোধহয় এবার তাকে কিছুটা থামিয়েই দিল। তবে তা মুহাম্মদ বিন সালমানের মৃত্যু নয়, জামাল খাসোগির মৃত্যু।
গত বছরের অক্টোবরের শুর“র দিকে তুরস্কের সৌদি দূতাবাসের ভেতর ঘটে যাওয়া জামাল খাসোগীর হত্যাকান্ডের প্রায় তিনমাস হতে চলেছে। এতদিনে খাসোগির দেহ এই হত্যাকান্ডের আর কোন রহস্য উদ্ধারের বাকি নেই। গত ১৯ শে ডিসেম্বর তুরস্কের পুলিশ আরও বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করে। বিভিন্ন জায়গায় থাকা প্রায় ১৪৭ টি ক্যামেরা থেকে প্রায় ৩৬০০ ঘন্টার ভিডিও দেখে এই রিপোর্ট তৈরি করা হয়।
এই রিপোর্টে হত্যাকারী দলের সদস্যরা কে কখন কোথায় ছিল তা সময়সহ বলা আছে। তুরস্কের পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগ তাদের তদন্ত অব্যাহত রেখেছে। তারা জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সৌদি নাগরিকদের তুরস্কের কাছে হস্তান্তরের আহবানও জানিয়েছে। তবে চতুর সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী তা নাকচ করে দিয়েছেন। খাসোগির হত্যাকান্ডে উদ্বেগ জানিয়েছেন বিশ্বনেতারা। এই হত্যাকান্ড যাতে ধামাচাপা না পড়ে
যায় সেজন্য শুরু থেকে অনেকেই দাবী জানিয়ে আসছেন। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাও তাদের রিপোর্টে মুহাম্মদ বিন সালমানকে এই হত্যাকান্ডের আদেশদাতা বলে অভিহিত করেছে।
এতকিছুর পরও সৌদি আরবের প্রভাবের কারণে এই হত্যাকান্ডের বিচার আদৌ হবে কিনা তা এখনো প্রশ্নবিদ্ধ। কারণ মুহাম্মদ বিন সালমান ট্রা¤প শিবিরের অন্যতম সদস্য। ট্রাম্প তার বন্ধুত্বের
মর্যাদা রেখেছেন। সিআই এর রিপোর্টে তিনি সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। বিশ্বনেতাদের প্রতিক্রিয়া ও বিব্রত যুবরা খাসোগির মৃত্যুতে নতুন করে জেগে ওঠেছে সারা বিশ্ব। যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমানের
নানা কর্মকান্ডে এতদিন সরাসরি কেউ কিছু না বললেও খাসোগিকে হত্যার পর চুপ থাকেনি আর কেউ। পরিস্থিতি এত ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে জানলে হয়ত খাসোগির জন্য তারা অন্য পন্থা বেছে
নিত। নিজেদের শক্তির বিষয়ে তারা এতটাই আস্থাবান ছিল যে এমন সিদ্ধান্ত নিতে তাদের কোন দ্বিধা হয়নি। খাসোগির হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়ে নিশ্চিতভাবে সৌদি আরবের ঔদ্ধত্যের প্রকাশ ঘটেছে। নিজের দেশের নাগরিকদের সাথে দেশের অভ্যন্তরে বা কারাগারে আটক ব্যাক্তিদের সাথে সৌদি আরব কেমন আচরণ করছে তা নিয়ে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন। এখানে উললেখ্য, মুহাম্মদ বিন সালমান যুবরাজ হওয়ার পর থেকে সৌদি আরবের অনেক দায়ী ও গবেষক আলেম, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীদের কারাগারে আটক করে রেখেছে। এই আটক থেকে রেহাই পান নি মক্কার মসজিদুল হারামের কয়েকজন সম্মানিত ইমামও।
স্বয়ং সৌদি আরবেই আতংকে আছেন যুবরাজ এমন মন্তব্য করেছেন একজন ফরাসি সাংবাদিক। সবার থেকে আড়ালে থাকার জন্য তিনি লোহিত সাগরে নির্মিত প্রাসাদে বসবাস করছেন। রাজপরিবারের সদস্যরাও তার বিরোধী হয়ে ওঠছেন বলে জানা যায়। সম্প্রতি একটি ভিডিওতে যুবরাজকে দ্রুত গাড়িতে ওথে একটি অনুষ্ঠান ত্যাগ করতে দেখা গেছে। এসব ঘটনা স্বাভাবিকভাবেই অনেক প্রশ্ন সৃষ্টি করেছে।
নানা সংস্কারধর্মী কাজের মাধ্যমে পশ্চিমা বিশ্বে অনেকের কাছে প্রিয় হয়ে ওঠেছিলেন মুহাম্মদ বিন সালমান। তবে সেসব নেতারা এখন তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। সর্বশেষ জি-২০ সম্মলনে কয়েকজন রাষ্ট্রপ্রধান তার দিকে ফিরেও তাকান নি। এরদোগানের আচরণে যথেষ্ট বিব্রত হয়েছেন যুবরাজ। থেরেসা মে সরাসরি তাকে খাসোগির হত্যাকান্ড ও ইয়েমেন যুদ্ধ নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। জি-২০ তে সৌদি যুবরাজের বিব্রত মুখভঙ্গি ছিল দেখার মত। সাংবাদিকরা খুব দক্ষতার সাথে এই দৃশ্য ধারণ করেছেন।
খাসোগি হত্যাকে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করে আরও বিপদে পড়েছে সৌদি আরব। প্রথমে তারা খাসোগির পোশাক পরিয়ে হত্যাকারী দলের এক সদস্যকে দূতাবাস থেকে বের করে দেখানোর চেষ্টা
করে এরপর ক্রমাগত অস্বীকারের পর তারা জানায়, জিজ্ঞাসাবাদের সময়ে দূর্ঘটনাক্রমে নিহত হন খাসোগি। প্রায় বিশদিন পর সৌদি সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে এই ঘটনা স্বীকার করে।
এই ঘটনার অন্যতম সাক্ষী ছিল খাসোগির স্মার্ট ওয়াচ। এই ওয়াচে সবকিছুর রেকর্ড আছে এবং এই রেকর্ডের ওপর ভিত্তি করে সিআইএ মুহাম্মদ বিন সালমানকে অভিযুক্ত করে এবং অপরাধীদের
তালিকা প্রকাশ করে। এই ধরণের হত্যাকান্ডের ঘটনা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই হয়ে থাকে। সেগুলো একদিন হারিয়ে যায় সময়ের আবর্তনে। খাসোগির ভাগ্যও কি এমন হবে কিনা তা বলা যাচ্ছে না। তবে সম্প্রতি এরদোগান জানিয়েছেন, এই মামলা তারা জাতিসংঘে উত্থাপন করবেন। সেই পর্যন্ত অপেক্ষা ছাড়া
আর কিছু করার নেই কারও। কেঁচো খুড়তে গিয়ে সাপ বেড়িয়ে আসে। সৌদি আরবের অভ্যন্তরে যা ঘটছে সে তুলনায় খাসোগির হত্যাকান্ড একটা কেঁচোর মত। এই কেঁচো খুড়তে গেলেও সাপ বেরিয়ে আসবে নিশ্চিত। তবে কেঁচো কে খুড়বে সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।
© 2021 নবধ্বনি - Developed by Shabaka IT