মাঝে মাঝে মন চায় গ্রামে ছুটে যাই। মন চায় স্নিগ্ধ প্রভাতটা পুকুর ঘাটে বসে কাটিয়ে দিই সকালের সৌন্দর্য দেখে দেখে। তাকিয়ে থাকি পুকুরের স্বচ্ছ জলের দিকে। সকালের কোমলতা নেয়ার জন্য যখন পুকুরের মাছগুলো ভেসে থাকে মনের আনন্দে, আর নাম না জানা বিভিন্ন গাছ থেকে টুপ টুপ করে শিশিরকণা পড়ে ছোট ছোট কিছু ঢেউ খেলে যায়, মিষ্টি রোদের চিকন এক ফালি আলোকরশ্মি এসে পড়ে ঢেউগুলোর উপর, ঢেউগুলো সোনার মতো চিক চিক করে ওঠেÑ প্রকৃতির এই অবাক করা সৌন্দর্য দেখতে কী যে ভালো লাগে তখন, কেমন করে বলি!
গ্রামের এসব সৌন্দর্য আমাকে খুব করে টানে। যেখানে রাতের হিমেল বাতাসে বসে বসে গল্প করে বন্ধুরা, মন খারাপ থাকা কিছু মানুষেরা। সেখানে থাকে না কোনো বৈদ্যুতিক বাল্ব বা লাইট। মিটিমিটি করে জ্বলে হারিকেন কিংবা ল্যাম্প। হিমেল বাতাসে যার আলোটা হেলেদুলে খেলা করে। মাঝে মাঝে ছোট বাতিটা প্রবল বাতাসের কারণে অনেকটা লম্বা হয়ে যায়।
কোনো এক জোসনা রাতে উঠানে মাদুর পাটির ওপর বসে বসে গোনা যায় আকাশে মিটিমিটি করে জ্বলে থাকা তারকারাজি। আর কিছু মানুষ আপন মানুষের পাশাপাশি বসে হারিয়ে যায় কল্পনার গল্পরাজ্যে। রাতের নীরবতা ভেঙে কুহুকুহু করে ডেকে ওঠে রাতজাগা পাখিগুলো।
বিদঘুটে অমাবশ্যার রাতে মিটিমিটি করে জ্বলে ওঠে জোনাকি পোকারা। বাগান থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে বের হয়ে উড়তে উড়তে আস্তে করে মিশে যায় অন্ধকারের মাঝে। ঝিঁঝিঁ পোকারা কান ধাঁধাঁনো শব্দে ডেকে জানান দেয় সন্ধ্যার আগমনী বার্তা।
যেখানে প্রতিটা রাতই প্রিয় প্রেয়সীর কোলে মাথা রেখে প্রশান্তির ঘুম ঘুমায় একদল সাধারণ সরল সোজা মানুষ। যেখানে কৃষকেরা দিনমান মাঠে খেটে ক্লান্ত দেহটা পরম শান্তিতে ডুবিয়ে দেয়ার জন্য অধীর অপেক্ষায় থাকে প্রতিটা রাত্রির।
যেখানে প্রতিদিন সকাল হয় মুয়াজ্জিনের সুমধুর আজান শুনে। সকালের সূর্য ওঠে গ্রামের প্রতিটা ঘর থেকে সুরেলা কণ্ঠে কুরআন তেলাওয়াতের আওয়াজ শুনে। ছোট ছোট খুকুমনিদের মক্তব থেকে কুরআন পড়ে আসার দৃশ্য দেখে। যেখানে সকালের শিশিরকণাগুলো দুর্বা ঘাসের উপর মুক্তাদানার মতো চিক চিক করে। শিশিরভেজা ঘাসের উপর দিয়ে ভোরের মৃদুমন্দ ঠাÐা বাতাসে শরীরটা ভাসিয়ে দিয়ে হাঁটতে অদ্ভুত এক ভালোলাগা দেহমন শীতল করে দেয়।
প্রচÐ শীতের সকালে খেজুরের রস খেয়ে কাঁপতে কাঁপতে আগুনের পাশে বসা। খেজুরের রস জ্বালিয়ে গুড় বানানোর পর আয়েশ করে খাওয়া। জ্বাল দেয়া রসের মিষ্টি গন্ধে বাতাসও মিষ্টি হয়ে ওঠে। একটু রোদ উঠলেই উঠোন-কোণে রোদ পোহাতে গল্পের আসর বসানো।
কুয়াশার চাদর মোড়ানো সকালে গ্রামের ছেলে-মেয়েরা বুকে বই নিয়ে ছুটে যায় স্কুল, মাদরাসা, মক্তবের দিকে।
শীত শেষে বসন্ত আসে। চৈত্রের দুপুরে প্রচন্ড খা খা রোদে কৃষকরা কাজ সেরে এসে বসে মাঠের মাঝে বড় বটগাছটার ছায়ায়। গাছের ডালে ডালে বাসা বেঁধে থাকে বহু নাম না জানা পাখি। ভেসে আসে তাদের সুমধুর কুজন। কৃষকেরা গাছের গুড়িতে মাথা রেখে এলিয়ে দেয় ক্লান্ত দেহটা। এক সময় ঠাÐা বাতাসে ঘুমিয়ে যায়। আর তখন বাড়িতে বসে দুপুরের প্রচÐ গরমটা তাল পাতা কিংবা হাতে বুনা নকশি পাখার বাতাস খেয়ে কাটিয়ে দেয় বাড়ি থাকা বউরা-ঝিরা। স্কুল ফিরতি ছেলে-মেয়েরা তখন বাড়ির পাশের আম কিংবা আমড়াগাছের তলায় আড্ডায় মেতে ওঠে কাঁচা ঝাল, লবন আর ধনিয়া পাতা দিয়ে মাখিয়ে আম খেতে।
বিকেলে দিনের শেষ প্রান্তে এসে যখন সূর্যি মামা পৃথিবীকে বিদায় জানাবার প্রস্তুতি গ্রহণ করে, তখন ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে মত্ত হয় বিভিন্ন খেলায়। ছোট মেয়েদের কুত-কুত খেলায় চোখ আটকে যায়..।
সন্ধ্যায় মায়েরা ছোট একটা লাঠি নিয়ে খেলায় মত্ত ছেলে-মেয়েদের বাড়ি ফেরানোর তাড়া। মাগরিবের নামাজের পর ঘরে ঘরে জ্বলে ওঠে ছোট ছোট কুপি, হ্যারিকেন কিংবা ল্যাম্প।
পল্লি-বাংলার চিরায়ত এসব সৌন্দর্য আমাকে তাড়া করে ফেরে হররোজ। ফাঁক পেলেই তাই আমি ছুটে যাই পল্লিবাংলায়, গ্রামের সুনিবিড় সবুজের সান্নিধ্যে।
নবধ্বনি, জানুয়ারি ২০১৮ সংখ্যায় প্রকাশিত