বাড়ির সামনের শিমুল গাছে ফুল ফুটতে শুরু করেছে। সারাদিন পাখিদের কিচিমিচির আওয়াজ ভেসে আসে। সুমধুর সে আওয়াজ কতটা ভাললাগে–কেমন করে বলি! বসন্ত এলে গাছে গাছে দেখা মেলে হাজারো নাম-না-জানা পাখির। বিশেষ করে ফুলগাছগুলোতে।
আমাদের দেশ ছয় ঋতুর দেশ। বসন্ত তারই একটি শাখা, যদি ছয় ঋতুর সমষ্টিকে একটা গাছ ধরা হয়। বসন্ত এলে ফুল ফুটতে শুরু করে গাছে-গাছে। দেখা মেলে অদ্ভুত ধরেণের বুনো ফুলের। বাগানের গাছগুলোও নতুন সাজে সাজতে শুরু করে। লাল, নীল, হলুদ, বেগুনীÑনানান রঙের বুনো ফুলে ভরে ওঠে বাগান। প্রতিটা গাছ ফিরে পেতে শুরু করে হারানো যৌবন। কত অদ্ভুত! ঋতুবদলের সাথে সাথে গাছেরাও নিজেদের অবয়ব বদলে নেয়। ফিরে পায় নতুন যৌবন। হেমন্তে পাতা ঝরে পড়ার পর গাছের দিকে তাকালে মনে হয়, পৃথিবীর সব থেকে নিঃস্ব আর অসহায় হলো এই গাছগুলো। হেমন্ত পার হলে দেখা মেলে বসন্তের। শুধু বসন্তের না, অদ্ভুত ধরণের সব সুন্দরের দেখা মেলে। তার মধ্যে শিমুল গাছ অন্যতম। বসন্তে তার ডালগুলো ভরে ওঠে লাল টকটকে ফুলে। তবে অন্যগাছগুলোতে পাতা থাকলেও তার ডালে কিন্তু পাতা থাকে না, পাতা বিহীন ডাল ভরে যায় গাঢ় লাল ফুলে।
কিছু শিমুল গাছে আবার শাদাটে ধরনের ফুল হয়। যেটা দেখতে খুব ভালো লাগে। সব ধরনের পাখি এসে তার ডালে ডালে বসে কিচিরমিচির সুর তোলে। তাদের মধ্যে উল্লেখ্য যোগ্য হলো শালিক, টুনটুনি, আর কাক। কাকেরা খোলা আকাশে উড়তে থাকা অবস্থায় ডাকতে থাকে কা…কা…কা… করে। মাঝে মাঝে এসে শিমুল গাছের ডালে বসে। শিমুল ফুলে দু’-একটা ঠোকরও দেয়। কিন্তু কি যেন ভেবে আবার ডাকতে শুরু করে কা…! কা…! কা…! সম্ভবত তারা আকাশে উড়তে থাকা অবস্থায় লাল শিমুল ফুল দেখে মনে করে হয়তো খাবার কোনো কিছু, কিন্তু নিচে নেমে খাবারের আর কিছু না পেয়ে আবার কা…কা…কা…করে ডেকে উড়াল দেয় শূন্য আকাশে। বসন্তকালে আরো একটা সুন্দরের দেখা মেলে, সেটা হলো কোকিল। দেখতে কাকের মতো কালো হলেও তার ডাক কিন্তু কাকের মতো কর্কশ না। ফুলেদের সাথে গ্রামাঞ্চলে কোকিলেরও সুমধুর ডাকের বসন্ত হয়, এ বসন্তকালে। শুধুই ডাক শোনা না, দেখাও মেলে অনেক কোকিলের। বেশি দেখা যায় গ্রামে যে বাড়িতে খয়া গাছ থাকে সেখানে। বসন্তের আরো একটা ফল খয়া। বসন্ত না এলে তার দেখা মেলে না।
তবে এখনকার বসন্তে কোকিলও নাকি আগের তুলনায় কম আসে। রাতুল সে-কথা তার দাদুর মুখ থেকে শুনেছে। সময় পেলেই সে তার দাদুর কাছে গিয়ে গল্প শোনে। গল্প শুনতে তার খুব ভালো লাগে। আরো যদি হয় সেটা গ্রামের কোনো অলৌকিক ঘটনা।
আজ বিকেলে রাতুল তার দাদুর কাছে যায়নি। আজ তার মনটা বেশি ভালো না। সেই বিকেল থেকে বসে আছে বারান্দার পশ্চিম কোণায়। এখানে বসে বাড়ির সামনের দিকে তাকালে রাস্তার পাশের শিমুল গাছের শাদাটে ফুল প্রায় সবই দেখা যায়। আর বারান্দায় বসে সে শাদাটে ফুল দেখতে রাতুলের কাছে খুব ভালোই লাগে। আজ মগ ডালে বসে আছে একজোড়া শালিক পাখি। পরস্পরে ঠোকাঠুকি করছে, উড়ে যাচ্ছে এ-ডাল থেকে ও-ডালে। এক ঝাঁক পাখি উড়ে এসে বসল ফুল মোড়ানো একটা ডালের ওপর, সাথে সাথে অন্য ডাল থেকে আরেক ঝাঁক পাখি শূন্য আকাশে উড়ে গেল, যেন তারা নীল আকাশের নীল রঙের সাথে মিশে যেতে চায়। উড়ে উড়ে উপরে উঠতে থাকে। এক সময় অদৃশ্য হয়ে যায়।
অন্যদিন হলে এ দৃশ্যটা কাউকে ডেকে দেখাত রাতুল। আর অন্যদিন তার কাছেও কেউ না কেউ থাকে, কিন্তু আজ আর নেই। আজ আর মনও চাচ্ছে না কাউকে ডাক দিয়ে দেখানোর।
রাতুল নিজেকে মনে মনে প্রশ্ন করে, এ ভালোলাগা আর ক’দিনই বা থাকবে? কয়েকদিন হলো পুরো গাছ ফুলে ভরে উঠেছে। বসন্ত হলো ঋতুর রাজা, গাছে গাছে ফুল আর সবুজ পাতায় সুশোভিত হবার কাল। সে জন্যই শিমুল গাছটা আজ এতো সুন্দর লাগছে। বসন্ত না এলে শরতের পাতা ঝরার পর দেখতে ভালোলাগা এ শিমুল গাছটার দিকে কেউ তাকাতোই না। আবার যখন বসন্ত পরিয়ে গ্রীষ্ম আসে তখনও আর এই ভালোলাগা কাজ করে না। কিন্তু রাতুলের কাছে এ ভালোলাগাটা সব সময়ই থাকে। তার বাবা তাকে বলেন, সব সময় বলেন : জানো রাতুল! বর্তমানে সব লেখক শহর নিয়েই লেখেন। লেখালেখির অঙ্গন থেকে গ্রাম বিদায় নিতে শুরু করেছে। অথচ জসিমউদ্দিন কিন্তু পল্লিকবি নামেই পরিচিত। কবি জীবনানন্দ দাশও কিন্তু ছিলেন গ্রাম ও প্রকৃতির কবি। মোট কথা প্রায়-ই কবি লেখকরা আগে ছিলেন গ্রামীন কাহিনি-সৌন্দর্য নিয়ে গল্প, উপন্যাস, কবিতা লেখায় মত্ত।
অথচ আজ দেখো, গ্রামীণ সব কিছুই সেই আগের মতই আছে। কিন্তু এসব নিয়ে লেখা কোনো কলমই আজ নেই। আমার মাঝে মাঝে মন চায় কোনো একজন লেখক গ্রামীণ সৌন্দর্য নিয়ে কলম ধরুক।
সেই থেকেই রাতুলের স্বপ্ন গ্রামীণ সব কিছু নিয়ে লেখালেখি করার। তখন থেকেই তার লেখার স্পৃহা বাড়তে থাকে। তখন তার স্বপ্ন হয় বাবার স্বপ্ন পূরণের অনুপ্রেরণা। এভাবেই রাতুল সব সময় প্রকৃতিকে নিজের মধ্যে ধারণ করতে থাকে। গভীর সাগরের তিমি যেমন সামনে যা পায় তাই গিলে নেয় রাতুলও তেমনি প্রকৃতিক সৌন্দর্যের যেন সবকিছু গিলে নেয়।
কিছুদিন হলো আমের মুকুলও তার মোহমোহ ঘ্রাণ ছড়াতে শুরু করেছে। আতা গাছগুলোতে ফুটতে শুরু করেছে আতাফুল। যার গন্ধটাও রাতুলের কাছে মনে হয় কড়া পারফিউমের মতো।
এরই মাঝে সন্ধ্যার অন্ধকারের চাদর ঢেকে নিতে শুরু করেছে পুরো পৃথিবীকে। দূরের গ্রামীণ মসজিদ থেকে ভেসে আসছে সন্ধ্যার আগমনী বার্তা, মাগরিবের আজান। এখনই সাড়া দিতে হবে মহিমান্বিত আল্লাহর ডাকে। আজান শেষ হতেই রাতুল তার দাদুর ডাকে সম্বিৎ ফিরে পেল। কত সুন্দর তার গ্রাম। তার গ্রামের প্রকৃতি। যেন সব সময় মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে দেখতে মন চায়। সারা বিকেল ধরে তাই-ই দেখছিল রাতুল। প্রভুর ডাকে সাড়া দিতে এবার সুন্দর এ প্রকৃতিকে বিদায় জানিয়ে মসজিদের পথ ধরল সে। আরেক সুন্দরের প্রগাঢ় আহ্বানে।
মে ২০১৮