পূর্ব দিগন্ত ভেদ করে সূর্য উঁকি দিচ্ছে। একটু পরেই জানালা দিয়ে হামলে পড়বে মায়ের নরম হাতের মতো মোলায়েম রোদ্দুর। লাল পর্দায় প্রতিফলিত হয়ে পুরো রুম রক্তিমাভায় ভরপুর হয়ে যাবে। এমন সময় লিখতে বসলে অজান্তেই মন গেয়ে ওঠে—‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে রক্ত লাল রক্ত লাল…।’
কিন্তু আমি সূর্য কিংবা ‘রক্ত লাল’ নিয়ে লিখতে বসিনি। বসেছি শীত নিয়ে লিখতে–শীতের স্মৃতি নিয়ে লিখতে। যদিও শীতকাল পড়েছে চারদিন হলো, কিন্তু উত্তরের শিরশিরে ঠান্ডা হাওয়া ছাড়া তেমন কোনো আমেজ চৈতন্যকে নাড়া দিচ্ছে না। ভোরে সূর্য ওঠার আগে যে কুয়াশা, তার দেখা তো হেমন্তেও মেলে। ‘মাঘের শীতে বাঘেও কাঁপে’ টাইপ শীত না পড়লে কি আর শীতের আমেজ আছে? তার জন্য অবশ্য মাঘ মাস অবধি অপেক্ষা করতে হবে। এত অপেক্ষা না করে বরং শীতের স্মৃতিচারণই করি!
কী স্মৃতিচারণই-বা করব! স্মৃতিরা হয় কুয়াশার মতো। ঝাপসা, ধরা যায় না ছোঁয়া যায় না অথচ জীবন্ত। সেখানে আবার শীতের স্মৃতি! যাকে আপাদমস্তক ঢেকে রাখে ‘ধরা যায় না ছোঁয়া যায় না’ টাইপ কুশায়ার পর্দা! আবার প্রাবন্ধিকেরা ব্যাকরণের ভাষায় বলেন, ‘শীত হচ্ছে রিক্ততার ঋতু, শূন্যতার ঋতু। প্রকৃতিকে রিক্ত করে দিতে শীতের আগমন হয়।’ কথার সত্যমিথ্যা যাচাই করতে যাব না। তবে একটা ছোট্ট উদাহরণ দিতে পারি। আমি সবেমাত্র পদ্য লিখতে শিখেছি—তখনও পদ্য, ছড়া কিংবা কবিতা এসবের কোনো পার্থক্য বুঝতাম না, জানতাম না ছন্দও। সন্দেহ হয়, রিক্ত শব্দের অর্থও জানতাম কি না, এমন সময় আমার আনাড়ি হাতে শীতের ছবি আঁকতে গিয়ে লিখেছিলাম, ‘বাগানে চেয়ে দেখি বাগান আজ/পুষ্পহীন, পত্রহীন, লাবণ্যরিক্ত।’ তাই রিক্ততাই যার বৈশিষ্ট্য তার আবার স্মৃতি কী! যে সবকিছু শূন্যই করে দিয়ে গেল তার আবার কী-ই বা স্মৃতি থাকতে পারে! কিন্তু আমার মনে হয়, আমাদের কৈশোর-জীবনে–গ্রামীণ কিংবা শহুরে–সব বাঙালিদের শৈশব-কৈশোরের স্মৃতির একটা বড় অংশ দখল করে রেখেছে এই রিক্ততার ঋতু শীত—ডিসেম্বর। ডিসেম্বরের সাথে শীতের একটা অঘোষিত সম্পর্ক বহুদিন যাবৎ বিদ্যমান থাকার কারণে বার্ষিক পরীক্ষা শেষে সবাই গ্রামের বাড়ি কিংবা নানুর বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে শীতকে সাদরে বরণ করে নেয়। এরচেয়ে মজার স্মৃতি আর কী হতে পারে! সবার মতো আমারও এমন কিছু শীতের স্মৃতি আছে। কিন্তু শীতের কুয়াশার মতো সেই স্মৃতিগুলোও কুয়াশাচ্ছন্ন। অবশ্য এ-নিয়ে আমার কোনো দুঃখবোধ নেই। জীবনের সব ঘটনাই যে স্মৃতির পাতায় জীবন্ত থাকতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই! কিছু কিছু ঘটনা বরং ভুলে যাওয়াই ভালো। কিছু কিছু বিষয় স্মৃতির পাতায় ধোঁয়াটে হয়ে থাকাতেই তার মহত্ত্ব। আমার কৈশোরের কুয়াশামাখা দিনগুলি স্মৃতির পাতায় তেমনি ঘন কুয়াশায় ঢাকা। খুব ছোটবেলায়—নানাজান খানকায় বসে কুরআন তেলাওয়াত করছেন, আমরা গিয়ে বড়ই কুড়াচ্ছি কিংবা আব্বার সাথে মাছ কিনতে যাওয়ার কথা আবছা আবছা মনে পড়ে। আরেকটু বড় হয়ে—ফোর ফাইভে পড়ার সময়ে—ডিসেম্বরের কনকনে শীতে হিমা আপা, প্রভা, আমি খালি পায়ে এক্কাদোক্কা খেলছি—এমন কত স্মৃতি-ই ঢাকা পড়ে আছে স্মৃতির কুয়াশায়! কত বন্ধুবান্ধব, কত নিষ্পাপ চেহারা লুকিয়ে আছে কুয়াশার আড়ালে! এসব স্মৃতিরোমন্থন করে আজ কুয়াশা ভেদ করতে চাই না। কুয়াশামাখা দিনগুলির স্মৃতি না-হয় কুয়াশায় ঢাকাই থাকুক! পাছে ভয় হয়, স্মৃতিরোমন্থন করতে গিয়ে কুয়াশা ভেদ হয়ে যদি স্মৃতিগুলো হারিয়ে যায় স্মৃতি থেকে! তাই স্মৃতিগুলো স্মৃতিতেই থাকুক—কুয়াশার স্মৃতি, কুয়াশার মতো, কুয়াশায় ঢাকা, ধোঁয়াশার মতো, জীবনানন্দের মতো, জীবনানন্দের কবিতার মতো।
হয়বতনগর, কিশোরগঞ্জ সদর
জানুয়ারি ২০২২