জীবন ও মৃত্যু—আমাদের সবচেয়ে বেশি ভাবিয়েছে। এখনো ভাবাচ্ছে। ভাবিয়েছে বলতে এর দর্শন, রহস্য, লক্ষ্য এমনকি এর প্রকৃতি নিয়েও আমরা বহু গবেষণা, চিন্তা-ভাবনা করেছি, কিন্তু উদ্ঘাটন করতে পারিনি, কোনো নির্দিষ্ট সমাধানে পৌঁছুতে পারিনি। এটিই মনুষ্য চিন্তার সীমাবদ্ধতা। মানুষের নিজেরও। মানুষ যে আল্লাহকে ছাড়া অক্ষম, এটি তারই প্রমাণ। তাই আল্লাহ নিজেই তাকে তার সৃষ্টিরহস্য, সৃষ্টিলক্ষ্য ও প্রকৃতি সম্পর্কে যৎকিঞ্চিত ধারণা দিয়েছেন। মানুষ সম্পর্কে যতটুকু ধারণা আল্লাহ তাআলা দিয়েছেন সেটুকুই পৃথিবীবাসীর সম্বল। অনেক ভেবেকুটে ঘুরেফিরে সবাই এখানেই ফিরেছে।
মানুষের আদি কী? প্রাণের রহস্য কী? জন্ম-মৃত্যু আদতে কী? মানুষের জৈবনিক ও দ্বিজাগতিক সত্য-মিথ্যা কতটুকু স্পর্শযোগ্য, কতটুকু শুধুই রহস্য-অনাবৃত ইত্যাদি বিষয়ে চমৎকার একটি বইয়ের সন্ধান পাই শাইখ শারাভির রচনা-সম্ভার ঘাটতে গিয়ে। শাইখ শারাভির এই বইটির নাম ‘আল-হায়াতু ওয়াল মাওত’ বা ‘জীবন ও মৃত্যু’। দার্শনিক ও চিন্তাগত পড়াশোনার জগতে আমরা এতটাই অনগ্রসর যে, কোথায় আমাদের জ্ঞান হাহাকার করছে, কোথায় সে তৃষিত চরাচরের মতো ‘পানি-পানি’ করছে, সেটি পর্যন্ত টের পাই না। যার তৃষা নেই, তার ভেতরে তৃষা নিবারণের কোনো উদ্বেগ থাকবে না—এটিই স্বাভাবিক। আমাদের বা আমার বেলায়ও হয়েছে তাই। জন্ম-মৃত্যু নিয়ে যে এত কিছু জানার আছে এবং যা স্বয়ং কুরআনেই আল্লাহ তাআলা জায়গায় জায়গায় জানিয়ে রেখেছেন— তার শূন্যতাটুকু আমরা বোধহয় টেরই পাই না, আমাদের চিন্তাদৈন্যের কারণে। বোধ করি, সেই শূন্যতা কিছুটা টের পাওয়া যাবে গভীরভাবে এই বই পড়তে বসে। আদতে জন্ম-মৃত্যুর দর্শন ও তত্ত্ব নিয়ে আমরা কতটুকুই-বা ভাবি? জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত অথচ প্রাত্যহিক চিন্তা থেকে বিচ্ছিন্ন এই প্রশ্নটি কিতাবটি পড়তে পড়তে বিপুলভাবে অনুভূত হবে। বইয়ের আলোচ্য বিষয় খুব জটিল ও তাত্ত্বিক কিছু নয়, তবু এই বই পড়ার উদ্দেশ্য স্রেফ জানা। সর্বজ্ঞ মহান আল্লাহ তাআলার বয়ানে পবিত্র কুরআন থেকে জানা। মানুষের জন্ম-মৃত্যুর ভেতরে যে এত এত রহস্য, অনুদ্ঘাটন ঘাপটি মেরে আছে সেটি না বুঝে একজন চিন্তাশীল ও বিবেকবান মানুষের স্থির হওয়ার কথা নয়। হনও না। কিন্তু আমাদেরই মতো উদাস কেউ কেউ হয় বৈ কি? নিজের অস্তিত্ব ও অস্তিরহস্য খোঁজা মানুষের আজন্মকালের সাধনা। শাইখ শারাভি কি সেই তাগিদেই জীবন ও মৃত্যু সম্বন্ধে মানুষের মনে জাগা শত শত প্রশ্ন নিয়ে কুরআনের মুখোমুখি হয়েছেন? কিংবা মানুষ তার অস্তিত্বের খুঁজে এমন বেপরোয়া ছুটবে বলেই কি আল্লাহ তাআলা তার পর্যাপ্ত ও প্রয়োজনীয় যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর ও সমাধান দিয়ে রেখেছেন কুরআনে? হয়তো। কারণ, চিন্তাশীল মানুষ মাত্রই জ্ঞানান্বেষী। সেই মানুষ তার নিজেরই অস্তিত্ব, সৃষ্টিরহস্য, জীবন ও মৃত্যুর মতো এত বড় দুটি বিষয় অমীমাংসিত রেখে দেবে, তা হয় না।
যেহেতু কুরআন ও কুরআনের মর্মবাণীর প্রতিই শাইখ শারাভির চূড়ান্ত আস্থা ছিল, সেই সূত্রে জীবন ও মৃত্যুর সাথে তাঁর উপর্যুক্ত বোঝা-পড়া সম্পূর্ণ কুরআন-নির্ভর। যদিও মিসরের প্রখ্যাত তাফসিরবিদ—এই পরিচয়ের পাশাপাশি তিনি একজন কিংবদন্তি লেখক এবং মাআহিদ আল-আজহারিয়া, জামিয়া উম্মুল কুরা, জামিয়াতুল মালিক আবদিল আজিজ-সহ আন্তর্জাতিক অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ইসলামের অন্যতম দাঈও ছিলেন।
জানুয়ারি, ২০২২