একটি ইউটিউব ভিডিও। জুনায়েদ জামশেদ নিজ মুখে শোনাচ্ছেন তার বদলে যাবার গল্প। নবধ্বনির জন্য ভিডিওর কথাগুলো বাঙলা ভাষায় সাজিয়েছেন মাসুম আহমাদ।
আমার আব্বা ছিলেন খুবই সৎ। কোনো হারাম তাঁকে কখনো স্পর্শ করতে পারতো না। এ কারণে বাড়িতে কিছুটা সংযমের হালত বিরাজ করতো সবসময়। পরিবারের এই টানাটানির অবস্থা দেখে আমার মাথায় টাকা কামাই করার নেশা চাপলো। কিভাবে দু’হাতে টাকা কামাই করা যায়, সেই নেশায় হন্যে হয়ে উপায় খুঁজতে লাগলাম।
ছোটোবেলা থেকে আমার গলা ছিলো খুব সুন্দর। আমি সেই গলা কাজে লাগিয়ে সঙ্গীতচর্চা শুরু করলাম। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে চারদিকে আমার বিশেষ সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়লো। এভাবে এক সময় আমি দেশের সেরা শিল্পীতে পরিণত হলাম। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আমন্ত্রণ আসতে থাকলো। বাংলাদেশ আর ভারত ছাড়া বিশ্বের সব দেশে গান গাইলাম। একেকটা গানে লাখ লাখ টাকা কামাই করতে লাগলাম। গাড়ি-বাড়ি সবই হলো। কিন্তু তারপরও মনে কেন যেন শান্তি পেতাম না।
২০০৩ সালের কথা। একদিন জুন মাসের প্রচÐ গরমে করাচির রাস্তা দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিলাম। বাইরে তখন লু-হাওয়া বইছে। রাস্তায় পায়ে হাঁটা মানুষের সংখ্যা খুব কম। এমন সময় দেখি, তাবলিগের কিছু ভাই গাশতে বের হয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। আর তাদের শরীর দিয়ে ঝর ঝর করে ঘাম ঝরছে। জামা-কাপড় সব ভিজে গেছে। তাদেরকে দেখে মনে মনে বললাম, লোকগুলো পাগল ছাড়া আর কী! নিজেদের আরামও নষ্ট করছে, অন্যদেরকেও বাড়ি থেকে বের করে কষ্টের মধ্যে ফেলার ফিকির করছে। পরক্ষণেই চিন্তা করলাম, আমি এই এসি গাড়িতে কতো আরামে বসে আছি। কিন্তু এরা কীসের জন্য নিজেদেরকে এই কষ্টের মধ্যে ফেলছে? কেন তারা এই ত্যাগ স্বীকার করছে? চিন্তাটা মাথায় আসতেই বিরক্তির বদলে এবার আলাদা একটা মমত্ব চলে এলো তাদের প্রতি।
তখন আমি তাদের দোআ নেয়ার জন্য গাড়ি ঘুরিয়ে একেবারে তাদের আমির সাহেবের সামনে গিয়ে ব্রেক কষলাম। আমির সাহেব হতচকিত হয়ে গেলেন। আমি গাড়ি থেকে তাকে সালাম দিলাম। তারপর বললাম, আপনারা অত্যন্ত ভালো কাজ করছেন। আমার জন্য দোআ করবেন। আমির সাহেব কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, ইনশাআল্লাহ! দোআ করবো। এরপর আমি চলে এলাম। তারা মসজিদে চলে গেলেন।
উল্লেখ্য যে, আমির সাহেব সবার পিছনে ছিলেন বিধায় আমাদের এই সংক্ষিপ্ত মুলাকাত জামাতের দু’চারজন সাথী ছাড়া অন্যরা দেখতে পায়নি। মসজিদে যাওয়ার পর আমির সাহেব তার সাথীদের কাছে বললেন, জুনায়েদ জামশেদের সাথে আমার দেখা হয়েছে। এরপর তিনি কীভাবে আমার সাথে দেখা ও কথা হলো, তা বললেন। ওই জামাতে আমার স্কুল-জীবনের এক সহপাঠী ছিলো। সে আমার নাম শুনে বললো, আরে, সে তো আমার সহপাঠী। তার পেছনে মেহনত করা দরকার। তারপর সে কীভাবে যেন আমার মোবাইল নাম্বার সংগ্রহ করলো এবং আমার সাথে যোগাযোগ করলো।
একদিন আমার বাড়িতে এলো এবং সেদিন থেকে শুরু করে দীর্ঘ তিন বছর আমার পেছনে মেহনত করলো। কখনো আমার হাত ধরলো, কখনো আমার পা ধরলো, কখনো মাথার পাগড়ি খুলে আমার পায়ের কাছে রেখে দিলো। বলতোÑ জুনায়েদ! এখন তুমি যে সম্মানের মধ্যে আছো, এটা চিরস্থায়ী নয়। এটা একদিন শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু আমি তোমাকে যে পথে আহŸান করছি, প্রকৃত সম্মান সে পথেই আছে। এখন হয়তো তুমি বুঝতে পারবে না। কিন্তু একদিন তোমার বুঝে আসবে যে, আমিই তোমার প্রকৃত কল্যাণকামী।
এই তিন বছরে না বুঝে বিরক্ত হয়ে আমি বেশ কয়েকবার তাকে গলা ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছি। কিন্তু আল্লাহর এই বান্দা কিছুতেই আমাকে ছাড়লো না। তিন বছর মেহনত করার পর আমাকে সে একদিনের জন্য তাবলিগে যেতে রাজি করালো। আমি একদিনের নিয়তে বের হলাম। একদিন শেষ হলো, আরেকটি দিনের জন্য অনুরোধ করলো। সেখানে গিয়ে আমার ভালো লাগলো। তাই তার কথা মেনে পরদিন থাকলাম। এরপর আবার আরও একদিনের জন্য থাকতে অনুরোধ করলো। আমি থেকে গেলাম। এভাবে একদিন একদিন করতে করতে আমার চিল্লা পুরো হয়ে গেলো।
চিল্লা থেকে ফিরে এসে দ্বিধাদ্ব›েদ্ব পড়ে গেলাম। গান-বাদ্য তো আল্লাহর নাফরমানির কাজ। তাই গান গাইতে ভালো লাগলো না। আবার চিন্তা করলাম, না গাইলে সংসার চলবে কী করে? এসব চিন্তা করে মনের সাথে লড়াই করে যেতে লাগলাম। এ সময় মাওলানা তারিক জামিল সাহেব বারবার আমাকে অভয় দিতে লাগলেন। হিম্মত যোগাতে লাগলেন। ফলে আমি গান গাওয়া একেবারে বন্ধ না করলেও সংখ্যা কমিয়ে দিলাম। সেই সাথে বন্ধুমহলে আস্তে আস্তে ঘোষণা করতে লাগলাম যে, গানের জগত থেকে আমি সম্পর্ক ছিন্ন করতে যাচ্ছি। এরপর আমি আগের পোশাক পরিত্যাগ করে ইসলামি লেবাস ধরলাম। দাড়ি একবার রাখি, একবার কাটিÑ এভাবে চলতে লাগলো।
২০০৬ সালের কথা। একদিন পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জনাব জাফরুল্লাহ জামালি আমাকে ফোন করে বললেন, টিভিতে তোমাকে পাকিস্তানের জাতীয় সঙ্গীত গাইতে হবে। আমি বললাম, আমি তো গান গাওয়া ছেড়ে দিয়েছি। তিনি বললেন, সেটা কেমন কথা! আমার অনুরোধ রাখবে না? আমি বললাম, আপনার অনুরোধ রাখতে পারি, কিন্তু আপনাকেও আমার একটা শর্ত মানতে হবে। তিনি বললেন, কী শর্ত? আমি বললাম, শর্ত হলো, এই গাওয়াই হবে আমার জীবনের শেষ গাওয়া। টিভিতে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন করার পর আমি গোটা জাতির সামনে ঘোষণা করে দেবো যে, আজ থেকে এই জগতের সাথে আমি সম্পূর্ণরূপে সম্পর্ক ছিন্ন করলাম।
তিনি আমার শর্ত মেনে নিলেন। সেদিন আমি গানের জগত থেকে সরে দাঁড়াবার কথা টিভিতে ঘোষণা দিয়ে দিলাম। তখন আমার মনের অবস্থা যে কী হয়েছিলো, তা আমি ভাষায় ব্যক্ত করতে পারবো না।
এদিকে শয়তান কিন্তু বসে থাকলো না। আমার সংকল্প থেকে আমাকে টলাবার জন্য বিভিন্নভাবে সে জাল ফেলতে লাগলো। বড় বড় অফার আসতে লাগলো। একটিমাত্র গান গাওয়ার জন্য, একটিমাত্র শোতে অংশ নেয়ার জন্য লাখ লাখ টাকার প্রস্তাব আসতে লাগলো। কিন্তু আমি আল্লাহর উপর ভরসা করে সব লোভ ত্যাগ করলাম। ইতোমধ্যে আমার ঈমানি পরীক্ষা শুরু হয়ে গেলো। বেতন দিতে না পারার কারণে ছেলেমেয়েকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে আনলাম। গাড়িটা বিক্রি করে দিলাম। একসময় বাড়িও বিক্রি করে দিলাম। এরপর নগদ টাকা যা ছিলো, তা দ্রæত শেষ হয়ে আসতে লাগলো। সর্বশেষ যেদিন আমার পকেটে ১০০ টাকা ছিলো, সেদিন স্ত্রীর হাতে টাকাটা তুলে দিয়ে বললাম, এই আমার শেষ সম্বল! কাল থেকে সংসার কিভাবে চলবে, তা আমি জানি না। তুমি আমার কাছে কোনো টাকা-পয়সা চাইবে না। স্ত্রী ঈমানের তালিম অর্জন করেছিলো। বললো, আপনাকে সে চিন্তা করতে হবে না। আজ যিনি রিজিক দিচ্ছেন, আগামীকালও তিনিই রিজিক দেবেন।
বস্তুত আমার এই পরিবর্তনের ক্ষেত্রে আমার স্ত্রীর অবদান অনেক বেশি। তার সহযোগিতা ও সমর্থন না পেলে আমার এই রাস্তায় আসা কষ্টকর হয়ে যেতো। সে-ই আমাকে আমার জগতে ফিরে যেতে নিরুৎসাহিত করেছে। আল্লাহর উপর ভরসা করার তাগিদ দিয়েছে। তার অবদান এই জীবনে ভোলার নয়। আল্লাহ পাক তাকে উত্তম প্রতিদান দান করুন।
অবস্থা যখন এই পর্যায়ে এসে পৌঁছলো, আর আমি যখন পরীক্ষার শেষ সীমায় এসে পৌঁছলাম, তখন আল্লাহ তাআলার রহমত ও সাহায্য আসা শুরু হলো। বস্তুত আল্লাহ তাআলা কোরবানি চান। কিন্তু তিনি কোরবানি নেন না। তিনি শুধু বান্দাদেরকে পরীক্ষা করেন। আল্লাহ তাআলা হজরত ইবরাহিম আলায়হিস সালামকে তার প্রিয় পুত্র ইসমাঈল আলায়হিস সালামকে কোরবানি করার আদেশ দিয়েছিলেন। অতঃপর তিনি যখন কোরবানি দেয়ার জন্য প্রস্তুত হয়েছেন, ছেলের গলায় ছুরি চালিয়ে দিয়েছেন, তখনই আল্লাহ তাআলার সাহায্য এসে গেছে। আল্লাহ তাআলা দুম্বা পাঠিয়ে দিয়েছেন।
একই ধারাবাহিকতায় আল্লাহ তাআলা হয়ত আমার কোরবানিও কবুল করেছেন। তাইতো যখন আমি হারাম পথে রিজিক তলব করা ছেড়ে দিলাম, তখন পরীক্ষার শেষ সীমায় পৌঁছার পর তিনিই হালাল রিজিক আসার ব্যবস্থা করে দিলেন। এখন আমি পায়জামা-পাঞ্জাবি তৈরি করি। সারা পাকিস্তানে আমার ৪৫ টা শোরুম আছে। সবগুলো আমি চিনিও না। কোথাও আমার যাওয়াও লাগে না। আমি এখন একেবারে অবসর। প্রায় সারাবছর তাবলিগে সময় লাগিয়ে বেড়াচ্ছি। আগে গান গাওয়ার জন্য সারা বিশ্ব সফর করতাম, এখন দাওয়াতের কাজে পৃথিবীর আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়াচ্ছি। আর লাভ করছি মহান আল্লাহর মহব্বত আর অগডুত মানুষের ভালোবাসা।
শেষ পর্যন্ত আল্লাহ তাআলা আমার গলাটাকেও কাজে লাগিয়ে দিলেন। একদিন মুফতি তকি উসমানি সাহেব ফোনে আমাকে খবর দিলেন। তার খেদমতে হাজির হলে তিনি একটা হামদ আমার হাতে তুলে দিয়ে বললেন, এটা রেকর্ড করিয়ে ফেলো। হামদ রেকর্ড করিয়ে বাজারে ছাড়ার সাথে সাথে হৈ চৈ পড়ে গেলো। এরপর হামদ-নাতের অ্যালবাম তৈরি করে বাজারে ছাড়লে ২০০৭ সালে সারা পৃথিবীতে উর্দু অ্যালবামের সর্বোচ্চ বিক্রির রেকর্ড ভঙ্গ করলো। এভাবে বাজারে আমার ইসলামি গজলের অনেক অ্যালবাম ছড়িয়ে গিয়েছে। আমার মৃত্যুর পরেও এগুলো মানুষের মুখে মুখে জারি থাকবে। আগে থাকতো আমার গান, এখন থাকবে আমার গজল।
কিছুদিন আগে দক্ষিণ আফ্রিকার বিখ্যাত মাদরাসা দারুল উলুম জাকারিয়ায় সফর করলাম। সেখানে ছাত্রদের মুখে মুখে আমার গজল উচ্চারিত হচ্ছে। শুনে আমি অভিভূত হয়ে গেলাম। দীনের খাতিরে আল্লাহ তাআলা আমাকে এতো সম্মান দান করেছেন। বস্তুত আল্লাহ তাআলা কারও ঋণ বাকি রাখেন না। সাথে সাথে শোধ করে দেন।
প্রকৃত বন্ধু তারাই যারা সবসময় বন্ধুর কল্যাণ কামনা করেন এবং বন্ধুকে সৎপথে ফিরিয়ে আনার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেন। অনুরূপভাবে আদর্শ স্ত্রী তারাই যারা স্বীয় স্বামীকে অন্যায় ও হারাম থেকে বাঁচানোর জন্য এবং গুনাহের পথ থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা ও সহযোগিতা করেন এবং এ কারণে যাবতীয় দুঃখ-কষ্ট হাসিমুখে বরণ করে নেন। আমার হেদায়েতের পথে আসায় আমার সেই দীনি সাহায্যকারী বন্ধু ও আমার সহযোগিনী স্ত্রীর ত্যাগ আমার জীবনের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
নবধ্বনি জানুয়ারি ২০১৭ সংখ্যায় প্রকাশিত