জুনায়েদ জামশেদ। বৈচিত্রের আলোকধাঁধানো রঙিন জগত থেকে হিজরত করে আল্লাহওয়ালা বাস্তব জীবনে ফিরে আসা এক চরিত্র। এখন এ চরিত্র শুধুই স্মৃতি; একটি সফল ও বর্ণাঢ্য জীবনের পরিসমাপ্তি।
জুনায়েদের জীবন মানে গোমরাহির অতল গহŸর থেকে হেদায়েতের রাজপথে উঠে আসার এক বিস্ময় জাগানিয়া আখ্যান।
বিশ্বকাঁপানো একজন পপশিল্পী ছিলেন জুনায়েদ জামশেদ। বিশাল অঙ্কের বাজেট নিয়ে বিভিন্ন দেশে কনসার্টে গান গাওয়া ছিলো তার পেশা। এক একটি লাইভ কনসার্টের চুক্তির পরিমাণ বাংলাদেশের কয়েকজন শিল্পীর বার্ষিক আয়ের সমান। অনেক অ্যালবাম বের হয়েছিলো তার গানের। দাওয়াত ও তাবলিগের মেহনতে একদিন লোকটি দেখা পেয়ে গেলেন বিশ্ববরেণ্য আলেম ও মুবাল্লিগ মাওলানা তারিক জামিল সাহেবের। এরপর পাল্টে যায় সবকিছু। অনেকটা নাটকীয়ভাবেই পরিবর্তন আসে জুনায়েদের জীবনে। গান গাওয়া ছেড়ে দেন তিনি। মেধাবী একজন শিল্পী নিজের ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ শিখরে অবস্থান করেও সুনাম-সুখ্যাতি ও বর্ডুল ভবিষ্যতকে দু’পায়ে দলে সাদাসিধে ঈমানি জিন্দেগিকে বেছে নেন। সঙ্গীতের আবরণ পরিবর্তন করে সঙ্গীতেরই পবিত্রতম আরেক রূপে গেয়ে ওঠেন–
ইলাহি তেরি চৌকাঠ পর ভিখারি বনকে আয়া হো…
সারা পা…
উম্মতকে গাম মে শব ভর রোনা…
মিঠা মিঠা পেয়ারা পেয়ারা…
মেরে মুহাম্মাদ কা নাম;
মুহাম্মাদ কা রওযা…
আয় আল্লাহ…
সাব সে আনসাব সাব সে আলা মেরে মুহাম্মাদ কা কাম…
ডুবতে হোও কো কিনারে লাগানা মেরে মুহাম্মাদ কা কাম;
সুতে হোওকো পেয়ার সে জাগানা মেরে মুহাম্মাদ কা কাম…
বে তলবো মে তলব জাগানা মেরে মুহাম্মদ কা কাম…
নবিপ্রেমে ঘোর লাগানো এই সুর হঠাৎ করেই থেমে যায় গত ৯ ডিসেম্বর ২০১৬। থেমে যায় চিরদিনের জন্য। পাকিস্তানের বিখ্যাত ক্রিকেটার সাঈদ আনোয়ারের আমন্ত্রণে দশদিনের সফরে চিত্রাল গিয়েছিলেন জুনায়েদ। গিয়েছিলেন তাবলিগেরই কাজে। স্ত্রী ছিলেন সাথে। দশদিনের জায়গায় বারোদিন সময় দেন চিত্রালে। বারোদিন পর ইসলামাবাদে ফেরার পথে হৃদয়বিদারক বিমান দুর্ঘটনায় স্ত্রীসহ নিহত হন তিনি।
ইসলামি সঙ্গীতের জন্য বিশ্বখ্যাত জুনায়েদ জামশেদের মৃত্যুর খবরে পাকিস্তানসহ পুরো বিশ্বেই শোকের ছায়া নেমে আসে। বাংলাদেশের সঙ্গীতপ্রেমীরাও শোকে মুহ্যমান হন। যার সঙ্গীত হৃদয় শীতল করে দিতো, যার সুরে মন উতলা হতো আল্লাহর প্রেমে, সেই প্রিয় মানুষের হুট করে দ্রæত চলে যাওয়া যেন মানতে পারছেন না কেউ।
মাওলানা তারিক জামিল প্রচÐ ভালোবাসেন জুনায়েদ জামশেদকে। জুনায়েদের অকস্মাৎ এই ইন্তেকালে শিশুর মতো কেঁদেছেন তিনি। তার সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মাওলানা তারিক জামিল বলেন-
‘মাশা-আল্লাহ! ইবাদতের ক্ষেত্রে মুসলিম উম্মাহ এখন অনেক এগিয়ে আছে। নামাজির সংখ্যাও প্রচুর। হজ-ওমরাকারীও আছে। কিন্তু উম্মতে মুসলিমা আজ চরিত্রের পাঠ ভুলতে বসেছে। জুনায়েদের মতো এমন সুচরিত্রের অধিকারী মানুষ জীবনে আমি খুব কম দেখেছি। একবার সাহাবি আবু হুরায়রা রা.-কে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম বললেনÑ ‘হে আবু হুরায়রা! চরিত্রের উন্নয়ন ঘটাও।’ নবিজি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামকে সাহাবিরা জিজ্ঞেস করলেন, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! কিভাবে চরিত্রের উন্নয়ন ঘটাবো? নবিজি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম বললেনÑ ‘যে তোমার সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করবে, তার সঙ্গে তুমি সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করো। যে তোমাকে বিমুখ করবে, তাকে তুমি দান করো। যে বাড়াবাড়ি করবে, তাকে ক্ষমা করে দাও।’
জুনায়েদ জামশেদ এই হাদিসেরই প্রতিচ্ছবি ছিলো। যে তার সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করতো, সে তার সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতো, যে তাকে বিমুখ করতো সে তাকে দান করতো, কষ্টদাতাকে স্বাচ্ছন্দে ক্ষমা করে দিতো। সে আমার দীর্ঘদিনের সবচেয়ে কাছের একজন বন্ধু ছিলো। ২০০৭ সন থেকে আমরা প্রতি বছর আল্লাহ তাআলার ইচ্ছায় হজে গিয়েছি। সম্মানিত হাজি সাহেবানদের খেদমতেও সে ছিলো পরম নিবেদিতপ্রাণ একজন খাদেম। সবার কাছে গিয়ে খোঁজখবর নিতো। কারো কিছু প্রয়োজন হলে বা কেউ কোনো সমস্যায় পড়লে দৌড়ে যেতো। সে ছিলো আল্লাহ তাআলার এক মুখলিস বান্দা। সবার কাছে আমার আবেদন, আপনারা সবাই তার জন্য দয়াময় রবের কাছে দোআ করবেন।’
এরপর আর কিছু বলতে পারেননি মাওলানা তারিক জামিল। কান্নায় বন্ধ হয়ে যায় তার কথা।
ইসলামকে নিয়ে, নবিজিকে নিয়ে হৃদয় শীতল করা মায়াবী কণ্ঠ আর মর্মস্পর্শী সুরের শিল্পী জুনায়েদ জামশেদ আজ বেঁচে নেই, কিন্তু তার সুর ও শব্দ আমাদের হৃদয়কে আলোড়িত করে যাবে অনেকদিন পর্যন্ত।
জগতের রঙিন যশখ্যাতি ছেড়ে যে মানুষটা আপনার পথের ভিখারি হয়েছিলোÑ আল্লাহ! আপনি তাকে জান্নাতের উদ্যানে সুরের জলসায় অতিথি হিসেবে বরণ করে নিন!
নবধ্বনি ২০১৭ সংখ্যায় প্রকাশিত