২০০৬ অথবা ২০০৭ সালে আমাদের বাসার কম্পিউটারে প্রথমবারের মতো জুনায়েদ জামশেদের ইসলামি সঙ্গীত শোনার সুযোগ হয়। ‘ইলাহি তেরি চৌকাঠ পর’ শিরোনামে গাওয়া তার ইসলামি গানটি আমাদের এতোই মোহগ্রস্ত করেছিলো যে, এরপর দীর্ঘদিন ধরে তা শুনেছি এবং এর প্রতিটি শব্দ হৃদয়ে অনুভব করেছি। এরপর গত দশ বছর ধরে জুনায়েদ জামশেদের গাওয়া বিভিন্ন গান ও গজল শুনে আসছি।
জুনায়েদ জামশেদ এককালে পাকিস্তানের সঙ্গীতজগতে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন তার ‘দিল দিল পাকিস্তান’ গানটি দিয়ে। খ্যাতির শীর্ষচূড়ায় যখন অবস্থান করছিলেন, তখন সব ছেড়ে তিনি আল্লাহর পথে নিজেকে সঁপে দিলেন। পাকিস্তানের প্রখ্যাত দায়ি মাওলানা তারেক জামিলের দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টায় এক ভিন্ন জুনায়েদ জামশেদকে আমরা দেখতে পাই।
জুনায়েদ জামশেদ বাদ্য-বাজনার গান ছেড়ে ইসলামের পথে এসে সাধু দরবেশ হয়ে পথের ভিখারি হননি। বরং তিনি প্রতিনিয়ত নিজের মেধা ও শ্রমকে কাজে লাগিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেছেন। তার পথ বদলে গেলেও সাফল্য বদলায়নি। দীনের পথে একনিষ্ঠ অনুসারী হয়েও তিনি সমাজ থেকে দূরে সরে পড়েননি।
জুনায়েদ জামশেদ নিজের নামে একটি ব্র্যান্ড তৈরি করেছিলেন, যা সব বয়সের পুরুষ ও নারীর তৈরি পোশাক বিক্রি করে থাকে। ২০০২ সালে জে ডট নামে এই ব্র্যান্ডের যাত্রা শুরু হয়। এরপর এর শাখা-প্রশাখা খুব দ্রæত পাকিস্তানজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে পাকিস্তানের বিভিন্ন শহরে জুনায়েদ জামশেদ ব্র্যান্ডের ৫০টির বেশি দোকান রয়েছে। এর বাইরে ইউরোপ, আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশেও এর শাখা ছড়িয়ে পড়েছে। জুনায়েদ জামশেদ ধীরে ধীরে তার ব্যবসা আরও প্রসারিত করেন। কোর্তা-কামিজের পাশাপপাশি জুয়েলারি, পারফিউম, জুতাসহ বিভিন্ন পণ্য উৎপাদন ও বিক্রি শুরু করেন জুনায়েদ জামশেদ।
ইসলামের পথে ফিরে আসা মানে ধন সম্পদ ছেড়ে সাধু-সন্যাসী হয়ে যাওয়া, এ ধারণা ভেঙেছেন জুনায়েদ জামশেদ। বরং আপন আলোয় তিনি প্রতিনিয়ত উদ্ভাসিত হয়েছেন। নতুন নতুন ইসলামি সঙ্গীত পরিবেশন করে তার ভক্ত ও শ্রোতা-দর্শকদের মোহিত করতেন জুনায়েদ জামশেদ। বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে টিভিশো করতেন তিনি। উপস্থাপক, আলোচকসহ নানা ভূমিকায় তাকে দেখা যেতো পাকিস্তানের প্রথম ও মধ্যমসারির টিভি চ্যানেলগুলোর পর্দায়।
ফ্যাশন ও পোশাক বাণিজ্যের পাশাপাশি ইসলামি সঙ্গীতচর্চা এবং মিডিয়া ব্যক্তিত্ব হিসেবে নিজের শক্ত অবস্থান তৈরির শত ব্যস্ততার মধ্যেও তাবলিগে সময় ব্যয় করতেন জুনায়েদ জামশেদ। যে আদর্শের ছোঁয়ায় বদলে গেছে তার জীবন, সেই আদর্শের প্রচারে তিনি আমৃত্যু নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন। এমনকি এরকমই এক জামাত থেকে ফেরার পথে তিনি বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন।
জুনায়েদ জামশেদ এই বাংলাদেশের আলো ঝলমলে সমাজের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ হতে পারেন। একজন প্রকৃত মুসলিম হিসেবে জীবন যাপন করেও যে ব্যবসা বাণিজ্যে সফল উদ্যোক্তা হওয়া যায়, এর প্রমাণ মেলে জুনায়েদ জামশেদের গত এক যুগের সাফল্যের দিকে তাকালে। আবার একইভাবে যেসব পর্দায় তার গানগুলো প্রচারিত হয়েছে অসংখ্যবার, সেইসব পর্দায় ভিন্ন রূপে হাজির হয়েও আগের মতো দর্শকপ্রিয় হওয়া যায়Ñ জুনায়েদ জামশেদ নিজ মেধা ও শ্রমে এর উদাহরণ দেখিয়েছেন।
জুনায়েদ জামশেদের সবচেয়ে বড় গুণ তার সহজাত চরিত্র। সমাজের সব শ্রেণি ও পেশার মানুষের সঙ্গে তার সদ্ভাব ছিল। কারও সঙ্গে শত্রæতা নয়, সবার সঙ্গে বন্ধুতাÑ এটিই ছিলো তার জীবনের বাণী। পাকিস্তানের মতো একটি দেশে তিনি তরুণ প্রজন্মের কাছে প্রিয়মানুষে পরিণত হয়েছিলেন তার অমায়িক চরিত্র ও উদার মনোভাবের কারণে। যেখানে যেতেন, সবাইকে বুকে জড়িয়ে ধরতেন। হাসিমুখে তাদের সঙ্গে ছবি তুলতেন। তরুণদের সঙ্গে প্রাণ খুলে গল্প করতেন।
সাধারণত বাংলাদেশে যারা তাবলিগ জামাতের মেহনতে জড়িত, তারা অন্যদের এড়িয়ে চলেন। পীরের মুরিদ, আলেমসমাজসহ বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের সঙ্গে তাবলিগ মেহনতের কর্মীরা দূরত্ব রেখে চলেন। যারা তাবলিগে সময় দেন, কেবল তাদের সঙ্গে তাবলিগওয়ালারা সখ্যতা করেন। জুনায়েদ জামশেদ এ ধরনের সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে থেকে নিজেকে সবার কাছে সবার মানুষ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। মানুষ হিসেবে তার এই গুণ থেকে আমাদের সবার শেখার অনেক কিছু রয়েছে।
জুনায়েদ জামশেদ তার তারুণ্যে গিটার হাতে নেচে গেয়ে সবাইকে মাতোয়ারা করেছেন। এরপর ইসলামের আলোয় ফিরে এসে গজলের জলসায় সবাইকে তন্ময় করেছেন। আবার মসজিদের মিম্বরে হাসিমুখে সবাইকে শুনিয়েছেন দীনের কথা, আল্লাহ ও নবিজির কথা। এভাবে জুনায়েদ জামশেদ নিজের জীবনে ইসলামের পূর্ণাঙ্গ রূপকে ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করেছেন সবসময়। ফলে সঙ্গীতশিল্পী, ব্যবসায়ী, টিভিতারকাসহ তার অন্যান্য পরিচয় তাকে ইসলামের দায়ি হওয়া থেকে আটকে রাখতে পারেনি।
জুনায়েদ জামশেদের আরেকটি বড় গুণ ছিলোÑ তিনি আলেমদের সান্নিধ্য ছাড়েননি। দু-চার বছর তাবলিগ করে দীনের কিছু কথা বলতে শিখে নিজেকে কখনো বড় ভাবেননি তিনি। বরং মৃত্যু পর্যন্ত নিজেকে মাওলানা তারিক জামিলের সেবক হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। এ গুণী আলেম এবং দায়ি ব্যক্তিত্বের সঙ্গে জুনায়েদ জামশেদ ১০ বার হজ আদায় করেছেন। সময় পেলেই তিনি মাওলানার কাছে ছুটে যেতেন, তার কাছ থেকে হৃদয়ের পাথেয় নিতেন।
বিমান দুর্ঘটনায় জুনায়েদ জামশেদের আকস্মিক মৃত্যু তার অসংখ্য ভক্তকে কাঁদিয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তার সঙ্গীতশ্রোতারা প্রিয় মানুষের মৃত্যুতে শোকাহত নির্বাক হয়ে পড়ে। তার জানাজায় বিপুল মানুষের উপস্থিতি বলে দেয়, তিনি ছিলেন সমাজের সবার প্রিয়মুখ। জুনায়েদ জামশেদ বেঁচে থাকলে উর্দু ইসলামি সঙ্গীতের জগত আরও অনেকদূর এগিয়ে যেতো, তার মৃত্যুতে এ আফসোস আমাদের রয়ে গেলো।
জুনায়েদ জামশেদ অনেকবার বাংলাদেশে এসেছেন। দাওয়াত ও তাবলিগের ইজতেমায় অংশ নিয়েছেন। বিভিন্ন এলাকার মসজিদে মসজিদে থেকেছেন। মানুষকে আল্লাহর দিকে ডেকেছেন। ইসলামি গানের আসরে অংশ নিতেও তিনি একবার এসেছিলেন। ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে তার কণ্ঠে গাওয়া বাংলা গজল ‘নবী মোর পরশমনি’ এ দেশের অসংখ্য শ্রোতাকে উদ্বেলিত করেছিলো। ফলে বাংলাদেশের মানুষের কাছেও তিনি অতি চেনামুখ হয়ে ওঠেন। বাংলাদেশজুড়ে লাখো কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থী এবং দীনদরদি তরুণ সমাজ জুনায়েদ জামশেদের কণ্ঠে ইসলামি গান শুনে প্রতিনিয়ত আল্লাহ ও নবির ভালোবাসায় বিগলিত হতো।
জুনায়েদ জামশেদের জীবন ছিলো বৈচিত্রময়। তিনি ছিলেন প্রতিভাবান এবং মেধাবী তরুণ। জীবন জীবিকার জন্য যেমন তিনি নিজের মেধা কাজে লাগিয়েছেন, তেমনিভাবে মানুষের কাছে মহান ¯্রষ্টার বাণী পৌঁছে দিতেও অকাতরে নিজের সময় উৎসর্গ করেছেন। মেধা, শ্রম ও সময়ের এমন সুন্দর সমন্বিত নিবেদন খুব কম মানুষের জীবনে দেখা মেলে।
জুনায়েদ জামশেদের গাওয়া যেসব গান গত এক দশক ধরে আমাদের মোহিত করেছে, এর মধ্যে রয়েছে– ইলাহি তেরি চৌকাঠ পার, উম্মাতি, মুহাম্মাদ কা রওজা, মেরা দিল বদল দে, দুনিয়া কে আয় মুসাফির, মেরে নাবি পেয়ারা নাবি, ফাইজানে মুহাম্মাদি, আয় আল্লাহ তুহি আতা ইত্যাদি।
জুনায়েদ জামশেদের কণ্ঠ যেমন আমাদের হৃদয়কে দ্রবীভূত করে, তেমনি তার গানের কথা আমাদের অন্য এক আবহে নিয়ে যায়। কথা ও সুরের এমন অপূর্ব সমন্বয়ের প্রতিভা সব শিল্পীর ভাগ্যে জোটে না।
জুনায়েদ জামশেদ ১৯৬৪ সালের ৩ সেপ্টেম্বর তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ২০১৬ সালের ৭ ডিসেম্বর এক বিমান দুর্ঘটনায় মর্মান্তিকভাবে মারা যান এই গুণী ব্যক্তিত্ব।
আমাদের কৈশোর ও তারুণ্যে মিশে আছে জুনায়েদ জামশেদের সুর। এর বিনিময়ে আগামীর অনাগত দিনগুলোতে তার জন্য অব্যাহত থাকবে আমাদের প্রার্থনা– পরম করুণাময় যেন তাকে জান্নাতের উদ্যানে সুরের জলসায় অতিথি হিসেবে বরণ করে নেন।
© 2021 নবধ্বনি - Developed by Shabaka IT