শৈশব থেকেই আমি ভ্রমণবিলাসী আর ভবঘুরে প্রকৃতির। বড় হয়ে পড়ালেখার সুবাদে এক বছর ইন্ডিয়ায় থাকাকালীন আমার ভ্রমণ পিপাসু সত্তাটা ফের জেগে উঠেছিল। দেওবন্দ, সাহারানপুর, দিল্লি ও তার আশপাশে বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান ইতিমধ্যেই ঘোরা হয়ে গিয়েছিল। এরই মধ্যে দেশ থেকে একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু এল আমাদের কাছে। তাকে উসিলা করে পুনরায় আশপাশের কিছু দর্শনীয় স্থান ঘোরার পর এবার গন্তব্য ঠিক হলো আগ্রা ও আজমির। রাতের ট্রেনে আট ঘণ্টা সফর শেষে জয়পুর হয়ে আজমির গিয়ে পৌঁছলাম খুব সকালে। কিন্তু আজমিরে হযরত মঈনুদ্দীন চিশতী রহমতুল্লাহি আলায়হির মাজারকে কেন্দ্র করে অসাধু লোকদের বিধর্মীয় সংস্কৃতি আর বাণিজ্যিক আচার-আচরণ আমাদের মুগ্ধ করতে পারেনি। সেখানের পরিবেশও কারো মনপুত হলো না। আশেপাশেও আশানুরূপ দর্শনীয় কিছু না পাওয়ায় সেখানে আর বেশিক্ষণ বিলম্ব করলাম না। আমরা এই মহান ব্যক্তির কবর জিয়ারত করে বেরিয়ে পড়লাম জয়পুরের উদ্দেশ্যে।
জয়পুরের নামডাক শুনেছি বুঝমান হওয়ার পর থেকেই। আজমির থেকে জয়পুর একশ পঁয়ত্রিশ কিলোমিটারের দূরত্ব। তাই স্থির হলো জয়পুরেই ঘুরব বাকি দিনটুকু। ঘন্টা দু’য়েকের মধ্যেই আবার জয়পুরের উদ্দেশ্যে ট্রেনে চেপে বসলাম। আগে থেকে আমাদের ভ্রমণ-তালিকায় জয়পুর না থাকায় স্টেশনে বসে গুগলের সাহায্যে তাৎক্ষণিক জয়পুরের রোডম্যাপ ও দর্শনীয় স্থানের তালিকা সংগ্রহ করে নিলাম।
আজমির স্টেশন থেকে যথাসময়ে ট্রেন ছাড়ল। আড়াই-তিন ঘন্টার পথ। ছুটে চলছে অবিরাম মরুভ‚মির মতো ধূধূ অঞ্চল মাড়িয়ে। রাজস্থানের এই দিকটা পুরোপুরি বালুময় মরুভ‚মি না হলেও অনেকটাই জনবসতিহীন বিরান অঞ্চল। ট্রেনের জানালা ভেদ করে দৃষ্টি যত দূর গেল শুধু দেখলাম উন্মুক্ত মাঠ আর জনবসতিহীন বালুকাময় অঞ্চল। অনেকক্ষণ পর পর স্টেশন এলাকা ছাড়া কোথাও কোনো বাড়িঘর কিংবা মানুষজন খুব একটা চোখে পড়ে না। হঠাৎ হঠাৎ দূরে লতাগুল্মবিহীন ছোটছোট বাবলাগাছের সারি, যার আশেপাশে ভেড়া কিংবা ছাগল অযথাই চড়ে বেড়াচ্ছে। দেখতে দেখতে কখন যে ক্লান্ত চোখে ঘুম নেমে এল, টেরই পেলাম না।
দুপুর একটা নাগাদ জয়পুর স্টেশনে এসে পৌঁছলাম। স্টেশন এলাকা থেকে একটি গাড়ি ঠিক করা হলো জয়পুর শহরের দর্শনীয় জায়গাগুলো ঘুরে দেখার জন্য। দেরি না করে সবাই দ্রæত চেপে বসলাম গাড়িতে। বর্তমান রাজস্থানের রাজধানী জয়পুর ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীনতম ঐতিহ্যবাহী একটি নগরী। ইতিহাস-ঐতিহ্য আর রূপ-লাবণ্যে ভরপুর এই শহরটিকে ভারতের গোলাপি শহর বা পিংক সিটি নামেও ডাকা হয়। শহরে ঢুকতেই দেখা গেল মস্ত বড় গোলাপি প্রবেশদ্বার। সড়কের পাশে গাঢ় গোলাপি রঙয়ের সব ভবন। ঝকঝকে আধুনিক শহর। ১৭২৭ সালে নির্মিত এই শহর প্রাচীন ভারতবর্ষের পরিকল্পিত নগরীগুলোর মধ্যে একটি।
প্রথম গন্তব্যস্থল হাওয়া মহল। কারুকার্য করা অজ¯্র জানালাওয়ালা একটি বাড়ি। বাইরে থেকে দেখলে মনে হয়, এই প্রাসাদে কোনো দেয়াল বা দরজাও নেই। শুধু সারি দিয়ে সাজানো জানালা। গাড়ি থেকে নেমে পায়চারী করতে করতে মাথা উঁচিয়ে গোনার চেষ্টা করলাম প্রাসাদটি। ঠিক কয় তলা বিশিষ্ট তা নির্দিষ্ট করতে পারলাম না। হাতে একদম সময় না থাকায় ভেতরে যাওয়ার ইচ্ছেটাকে সংবরণ করলাম
বহু কষ্টে। মোবাইলের ক্যামেরায় পুরো প্রাসাদটির ছবি ধারণ করার বৃথা চেষ্টা চালিয়ে ফিরে এলাম গাড়িতে। গাড়ি ছুটল জলমহলের উদ্দেশ্যে। পথে ড্রাইভারের উৎসাহ-অনুরোধে জয়পুরের ঐতিহ্যবাহী থ্রিপিস, শাড়ি ও অন্যান্য কাপড়ের একটি মার্কেটে নামতে হলো। সহনীয় মূল্যে আকর্ষণীয় বেশ কিছু থ্রিপিস কেনা হলো। সেখানেই প্রথম দেখি কিভাবে থ্রিপিস বা শাড়ি কাপড়ে বিভিন্ন ছাপার কাজ করা হয়। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ এই শিল্প উপভোগ করে যাত্রা করলাম জলমহলের উদ্দেশ্যে। পাহাড়ি টিলা বেয়ে গাড়ি অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই জলমহলের সামনে এসে থামল। গ্রীষ্মকালে শীতল পরিবেশে থাকার জন্যই এই ভবনটি তৈরি হয়। তিনদিকই পাহাড়-ঘেরা। পাহাড় থেকে ঢল কিংবা জল নেমে ছোট্ট একটা হ্রদের মতো সৃষ্টি হয়েছে। তিন দিক থেকে পাহাড় বেষ্টিত হওয়ায় সারাবছর পর্যাপ্ত পানি জমা থাকে এখানে। পানির ওপর গড়ে উঠেছে অপরূপ কারুকার্যখচিত গোলাপি একটি মহল। এরই নাম জলমহল। পানির ওপরে যতটুকু ভাসমান ঠিক নিচেও নাকি ততটুকু রয়েছে। স্বচ্ছ পানিতে মহলের প্রতিবিম্ব পড়ে অপরূপ এক দৃশ্যের অবতারণা হয়েছে। মহল পর্যন্ত পৌঁছার জন্য কোনো পথ বা সেতু নেই। পানি মাড়িয়ে রাজা ঠিক কিভাবে ঐ মহলে যেতেন তা বোধগম্য হলো না। হয়তো সার্বক্ষণিক জলজ বাহন প্রস্তুত থাকত তাঁর জন্য।
জলমহলের উল্টোদিকেই রয়েছে রাজপরিবারের সমাধি ক্ষেত্র। ওই মহলের কাছে যাওয়ার ব্যবস্থা নেই। দূরের রেলিংঘেরা পাড় থেকেই দেখতে হয়। রেলিংয়ে দাঁড়িয়ে এই মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখতে দেখতে অনেকটা সময় অতিবাহিত হয়ে গেল। সূর্যের আলো হাল্কা হয়ে এসেছে অনেকটা। তাই তড়িঘড়ি ছুটলাম আমেরফোর্টের উদ্দেশ্যে। জয়পুর রাজ্যের প্রাচীন রাজধানী ছিল আমের। আমেরকে এখন ক্রমবর্ধমান জয়পুর শহরের শহরতলী বলা যেতে পারে। তৎকালীন রাজপুতদের মধ্যে বিভিন্ন গোত্র ছিল। কথিত আছে, মিনা বংশীয় রাজা রালুন সিং আমের শহরের পত্তন করেন। পরবর্তীকালে কুচওয়া গোত্রের রাজারা ক্ষমতায় আসেন এবং শেষ অবধি তাঁরা জয়পুর রাজ্যের শাসক ছিলেন। কুচওয়া বংশীয় মহারাজা মানসিং (১ম) ১৫৯২ খ্রিষ্টাব্দে রয়েল প্যালেস হিসেবে আমের বা আম্বের দুর্গ নির্মাণ করেন। মানসিং-এর রাজত্বকাল ছিল ১৫৫০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৬১৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত।
পাহাড় বেয়ে ঘুরানো প্যাঁচানো রাস্তায় গাড়ি এগিয়ে চলছে। দূর থেকে পাহাড়ের ওপর দূর্গের অবয়ব ভেসে উঠল। মনে হলো খুব সন্নিকটেই। আর একটু গেলেই বোধহয় ¯পর্শ করা যাবে। কিন্তু পাহাড়ি পথ আর হাল্কা জ্যাম হওয়ায় বেশ খানিকটা সময় খরচ হয়ে গেল দূর্গের মূল ফটকে পৌঁছুতে।
এবার আমরা ভাড়া চুকিয়ে গাড়ি ছেড়ে দিলাম। আসরের নামাজের সময় হয়ে যাওয়ায় নামাজ পড়ে তারপর দূর্গ ঘোরার ইচ্ছা ব্যক্ত করল সবাই। কিন্তু পাহাড়ের ওপর রাজা মানসিং-এর এই দূর্গে মসজিদ কোথা থেকে আসবে? তবুও আত্মপ্রশান্তির উদ্দেশ্যে একজনের কাছে মসজিদের খোঁজ করতেই দেখিয়ে দিলেন লাল বেলে পাথরের দৃষ্টিনন্দন কারুকার্যখচিত একটি মসজিদ। সামনে রয়েছে একটি মনোরম চত্বর। মসজিদের দিকে তাকিয়ে সবার চোখ কপালে উঠে গেল। কৌত‚হল মেটানোর জন্য নামাজ শেষে একজন মুসল্লির কাছে জানতে চাইলাম কোত্থেকে এবং কিভাবে এল এখানে মসজিদ! লোকটি জানালেন, বাদশাহ আকবর রাজা মানসিং-এর মেয়ে যোধবাঈকে বিয়ে করার পর রাজা বাদশাহকে দূর্গে আমন্ত্রণ করেন। বাদশাহ রাজার কাছে জানতে চাইলেন, তিনি যে যাবেন সেখানে কি নামাজের ব্যবস্থা আছে? তখন রাজা বাদশার আগমনকে উপলক্ষ করে নির্মাণ করেন এই মসজিদ। লোকটির বর্ণনার সত্যতা নির্ণয় করা না গেলেও বুঝলাম চমকপ্রদ কাহিনি বটে। মসজিদ থেকে বেরিয়ে দুর্গ চত্বরে পা ফেললাম। ফুটবল মাঠের মতো খোলা পাথুরে উঠোন। সামনে পাহাড়ের মধ্যবর্তী খোলা জায়গায় নানারকম পাতাবাহার আর রঙবেরঙের ফুল গাছের উদ্যান। উদ্যানের চারপাশে স্বচ্ছ পানির লেক। এপাশ থেকে ওপাশে বইছে মৃদু মন্দ হাওয়া। নিমেষেই চোখ-মন জুড়িয়ে গেল সবার। ভেতরে প্রচুর লোকজন। কিন্তু প্রশস্ত আর খোলামেলা হওয়ায় ভিড় হচ্ছে না। যে যার মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। দুর্গটি চতুষ্কোণ আকৃতির। চার স্কয়ার কি.মি. জায়গা নিয়ে বিস্তৃত। চত্বরের চতুর্দিক ঘিরে রয়েছে অসংখ্য দূর্গ স্থাপনা। সবগুলো হিন্দু স্থাপত্য শৈলীতে তৈরি। লাল বেলে পাথর ও মার্বেল খÐে নির্মিত এই দূর্গের রয়েছে অনেকগুলি গেইট বা প্রবেশ তোরণ। দূর্গটি চার তলা বিশিষ্ট বলা যায়। বিভিন্ন মহলের ছড়াছড়ি। দেওয়ানি আম, দেওয়ানি খাস, শীষ মহল, সুখ-নিবাস ইত্যাদি।
আগ্রা বা দিল্লির লাল কেল্লায় এসব মহল দেখা যায়। তাই আমরা ভেতরে ঢুকে সময়টুকু শেষ করতে চাইলাম না। প্রাচীর ঘেঁষে হেঁটে চললাম ওপরের দিকে। দূর্গের চারপাশেই রয়েছে মজবুত ও প্রশস্ত প্রাচীর। পুরু প্রাচীর ঘেঁষে পাহাড়ের পাথর কেটে উপরে ওঠার সিঁড়ি তৈরি করা হয়েছে। আমরা সন্ধ্যা নামার আগ পর্যন্ত সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতেই থাকলাম। দূর্গের আনাচে কানাচে ঘুরতে ঘুরতে মনে হলো রণসাজে সজ্জিত এই দূর্গে এই বুঝি শোনা যাবে অশ্বের খুর ও হ্রেশাধ্বনি। বেজে উঠবে রাজপুতদের অস্ত্রের ঝনঝনানি। দূর্গের চ‚ড়া থেকে বিস্মিত চোখে দেখলাম, অস্তগামী সূর্যের আলো লেগে গোলাপি শহর জয়পুর আরো উজ্জ্বল গোলাপি বর্ণ ধারণ করেছে। যেন তাজা একটি গোলাপ তার পাপড়ি মেলে ধরেছে সৌন্দর্যের বিস্ময়ে আমাদের ভ্রমণপিপাসু হৃদয়কে উদ্বেলিত করতে। সূর্যটা পশ্চিমাকাশে হারিয়ে যাওয়া অবধি আমরা এক দৃষ্টে তাকিয়ে জয়পুরের গোলাপি সৌন্দর্যের সুধা আকণ্ঠ পান করলাম হৃদয় ভরে।
জুন ২০১৮