উপরে নীল আকাশ, মাঝে মাঝে শিমুলতুলোর মতো শুভ্রশাদা মেঘের উড়োউড়ি, চোখ ফেরালেই বর্ণিল যতো পাখির ডানা ঝাপটানো, নিচে ছোটো ছোটো পাহাড়, পাহাড়ের কোলে বিস্তৃত সবুজ চাবাগান, যেন দৃষ্টির সীমানা অবধি সবুজের গালিচা বিছানো, গালিচায় ঝুলি কাঁধে কৃষ্ণাভ চা-কন্যাদের ইতস্তত হাঁটাহাঁটিÑ এই তো শ্রীমঙ্গল! আনারস লেবু আর সারি সারি রাবার বাগান, ঘন বন, বনের গহীন থেকে ভেসে আসা হিং¯্র প্রাণীর রোমাঞ্চ জাগানিয়া ডাক, খনিজ গ্যাসক‚প, হ্রদ, হাওরের শান্ত জলরাশি, জলপ্রপাত, জলপতনের বিরামহীন শব্দÑ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কী নেই শ্রীমঙ্গলে?
প্রকৃতির বর্ণিল সব সৌন্দর্যকে কোলে নিয়ে শ্রীমঙ্গলে গড়ে উঠেছে ছোট্ট ছিমছাম একটি শহর। উপজেলা শহর। জেলা শহর মৌলভীবাজার থেকে দূরত্ব প্রায় পঁচিশ কিলোমিটার। জল পাহাড় আর সবুজের সৌন্দর্যসুধা পান করতে এখানে দূর-দূরান্তের ভ্রমণপিয়াসীদের ভিড় লেগে থাকে বছরের প্রায় পুরোটা সময়জুড়ে। শীতকালে যেমন প্রচÐ শীত পড়ে, বর্ষার সময়েও বৃষ্টি হয় প্রচুর। বাংলাদেশের শীতপ্রধান ও সবচে’ বেশি বৃষ্টিপাতের অঞ্চল এখানকার খ্যাতি। এলাকাটা তাই শীত-বর্ষা সব মৌসুমেই ভ্রমণার্থীদের জন্য উপভোগ্য।
দেখার মতো জায়গাগুলো
চাবাগান
সবকিছু ছাপিয়ে শ্রীমঙ্গলের যে সৌন্দর্য সবচে’ হৃদয়কাড়া, তা চাবাগানের মনমাতানো সবুজ দৃশ্য। শহর থেকে অল্প খানিক হাঁটলেই চোখে পড়ে সবুজ গালিচার মতো বিস্তৃত চাবাগান। সারিবাঁধা ছোটো ছোটো চাগাছের মাঝে মাঝে নির্দিষ্ট দূরত্বে মহীরুহরূপে দাঁড়িয়ে আছে উঁচু উঁচু ছায়াময় গাছ। চাগাছগুলোর উচ্চতা বেশ তো বেশ আড়াই-তিন ফুট; পাতা সংগ্রহের সুবিধার জন্যই গাছগুলো ছেঁটে রাখা হয়। কৃষ্ণবর্ণা চা-কন্যারা বিশেষ একপ্রকারের ঝুলি পিঠে নিয়ে চায়ের কচিপাতা সংগ্রহে ব্যস্ত। চাবাগানের ভেতর দিয়ে আছে আঁকাবাঁকা সরুপথ। সরুপথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে অপরূপ এই দৃশ্যগুলোর অবলোকন দেহ-মনে অন্যরকম এক ভালোলাগা ছড়িয়ে দেয়।
ছোটোবড়ো ৩৮টি চাবাগান আছে শ্রীমঙ্গলে। এর মধ্যে অনেকগুলোর বয়েস শত বর্ষ পেরিয়ে গেছে। এখানকার অধিকাংশ চাবাগানই ব্যক্তিমালিকানাধীন। তন্মধ্যে ফিনলে ও ইস্পাহানী টি এস্টেটের নাম করা যেতে পারে। শহরের একদম লাগোয়া ভাড়াউড়া, বুড়বুড়িয়াসহ বেশ ক’টি চাবাগান; খানিক দূরে আছে সিন্দুরখান, কালীঘাট, রাজঘাট চাবাগানসহ পর্যায়ক্রমে বাকিগুলো।
লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান
ঠিক শ্রীমঙ্গলে নয়, শ্রীমঙ্গলের পাশের উপজেলা কমলগঞ্জে বাংলাদেশের একমাত্র রেইনফরেস্ট লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের অবস্থান। শ্রীমঙ্গল শহর থেকে চাবাগানের মাঝখান দিয়ে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি নয় কিলোমিটার পথ পাড়ি দিলেই চোখে পড়ে ঘন সবুজের চাদরে মোড়ানো লাউয়াছড়া। জীববৈচিত্রে ভরপুর এ উদ্যানের আয়তন ১২৫০ হেক্টর। উঁচুনিচু ছোটো ছোটো টিলায় বেড়ে ওঠা ১৬৭ প্রজাতির অসংখ্য বৃক্ষে আচ্ছাদিত পুরো উদ্যান। প্রচুর বৃষ্টিপাত হওয়ায় সূর্যের আলোর ছোঁয়া পেতে প্রতিটা বৃক্ষ একটি আরেকটির সাথে প্রতিযোগিতা করে বেড়ে ওঠে। একেকটি বৃক্ষের উচ্চতা তাই আকাশ ছুঁইছুঁই। মজার ব্যাপার হলো, বিশাল এই বনাঞ্চলটি সম্পূর্ণ কৃত্রিমভাবে তৈরি! ১৯২৫ সালে তৎকালীর বৃটিশ সরকার জায়গাটিতে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলো। সেই বৃক্ষগুলোই আজ গহীন অরণ্যের রূপ নিয়েছে। বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৭ সালে বনটিকে জাতীয় উদ্যান হিশেবে ঘোষণা দেয়। চিরহরিৎ এই অরণ্যটি ভ্রমণার্থীদের জন্য এখন চিত্তাকর্ষক পর্যটনকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।
লাউয়াছড়ার একটু ভেতরে প্রবেশ করলেই বৃক্ষের মগডালে দেখা যায় বিলুপ্তপ্রায় উল্লুক ও বিভিন্ন প্রজাতির বানরের লাফালাফি। আরেকটু ভেতরে গেলে অরণ্যের গহীন থেকে ভেসে আসা নাম জানা-অজানা নানা প্রাণীর ডাক-চিৎকার শোনা যায়। ভাগ্য ভালো থাকলে চোখে পড়তে পারে ভাল্লুক, মেছোবাঘ, বনবিড়াল, খাটাশ, হরিণ, বন মোরগ ও নানা প্রজাতির সাপ। এছাড়াও এই বনে আছে ২৪৬টিরও অধিক প্রজাতির পাখি, অজগরসহ ৬ প্রজাতির সরিসৃপ, বন্য কুকুর, মুখপোড়া হনুমান, শিয়াল, সবুজ কোকিল, কয়েক প্রজাতির পেঁচা, বাজপাখি, ঈগল ইত্যাদি। পুরো বনজুড়েই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অনেকগুলো পাহাড়ি ছড়া। পাখ-পাখালির কলকাকলি তো আছেই।
রাবার-বাগান
বাংলাদেশ বন শিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশন (বশিউক) রাবার বিভাগ সিলেট জোন শ্রীমঙ্গলে অবস্থিত। এ বিভাগের অধীনে রয়েছে সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত মোট ৪টি রাবার বাগান। শ্রীমঙ্গলে সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত সাতগাঁও রাবার বাগান ছাড়াও জেমস ফিনলে টি কোম্পানি ও ডানকান ব্রাদার্স-এর প্রায় প্রতিটি চাবাগানে রাবার চাষ করা হচ্ছে। এছাড়া ব্যক্তি মালিকানাধীন অসংখ্য রাবার বাগান রয়েছে শ্রীমঙ্গলে। শ্রীমঙ্গল-মৌলভীবাজার সড়কের মধ্যিখানে ভৈরববাজারে রাস্তার খুব কাছেই অবস্থিত মাজদিহি রাবার বাগান, দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। খুব সকালে রাবার বাগানে গেলে রাবার শ্রমিকদের রাবার কষ আহরণ ও রাবার তৈরি প্রক্রিয়া দেখা যায়। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত রাবার গাছের ফাঁকে ফাঁকে ঘুরে বেড়ালে রাবার বীজের রিমঝিম শব্দে আপনি এক ধরনের ঘোরের মাঝে চলে যাবেন।
আনারস-বাগান
চায়ের মতো আনারস চাষের জন্যেও বিখ্যাত শ্রীমঙ্গল। দেশের সবচে’ বেশি আনারস চাষ হয় এখানে। শ্রীমঙ্গলের আনারস স্বাদ ও ঘ্রাণের কারণে সবার কাছে প্রিয়। শ্রীমঙ্গলের ভ্রমণপিয়াসুরা আনারস বাগানের সৌন্দর্য হৃদয়ফ্রেমে বন্দি করতে শহর থেকে গাড়ি বা মোটরসাইকেলে চেপে চলে যান মোহাজেরাবাদ, বিষামনি, পিচের মুখ অথবা সাতগাঁও পাহাড়ে। ভোরে এসব এলাকায় গেলে দেখা যায় শত শত শ্রমিক বাগানের টাটকা আনারস পেড়ে ঠেলাগাড়িতে সাজিয়ে রাখছে। সাজানো গোছানো আনারস বাগানের এই সৌন্দর্য কোনো অংশেই চাবাগানের চেয়ে কম না।
বিটিআরআই
বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট, সংক্ষেপে বিটিআরআই। চা নিয়ে গবেষণা ও চাশিল্পের উন্নয়নে ১৯৫৭ সাল থেকে এখানে কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি। বিটিআরআই কমপ্লেক্সও দেখার মতো একটি জায়গা। কমপ্লেক্সের চারপাশের চাবাগান, চানার্সারি, চা পরীক্ষাগার, চা প্রকৃয়াজাতকরণ প্লান্ট, শতবর্ষী চাগাছ, আরব ও রোবাস্টা কফিগাছ, অফিসার্স ক্লাবের পেছনের হ্রদ, অর্কিড ও ভেষজ বাগান ভ্রমণবিলাসী যে কাউকে মুগ্ধ করে।
চা-যাদুঘর
২০০৯ সালে শ্রীমঙ্গলের টি-রিসোর্টে স্বল্প পরিসরে টি-বোর্ডের উদ্যোগে যাদুঘরটি নির্মাণ করা হয়। বাংলাদেশে চায়ের বিভিন্ন জাত, চা চাষ সম্পর্কিত নানা উপাদান ও চা চাষের দেড়শ’ বছরের ইতিহাসকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার জন্যেই এই ব্যবস্থাপনা। ব্রিটিশ আমলে চাবাগানে ব্যবহৃত বিভিন্ন যন্ত্রপাতি, চাশ্রমিকদের ব্যবহৃত বিশেষ কয়েন, রাজনগর চাবাগানের নিজস্ব কয়েন, বাগান লাগোয়া ব্রিটিশ বাংলোয় ব্যবহৃত শতাধিক আসবাবপত্র, ব্রিটিশ আমলের ফিল্টার, চাগাছের মোড়া-টেবিল, প্রোনিং দা, প্লান্টিং হো, রিং কোদাল ইত্যাদি দ্বারা সাজানো হয়েছে যাদুঘরটি। সংগ্রহশালা আরো সমৃদ্ধ করার কাজ অব্যাহত আছে।
সিতেশ বাবুর মিনি চিড়িয়াখানা
১৯৭২ সালে শ্রীমঙ্গলের মিশন রোডে খ্যাতিমান পশু সংরক্ষক সিতেশ রঞ্জনের পিতা সিরিশ রঞ্জন দেব তৈরি করেন একটি ব্যক্তিগত চিড়িয়াখানা। পিতার মৃত্যুর পর সিতেশ রঞ্জন নিজেই চিড়িয়াখানাটির পরিচর্যা শুরু করেন। বর্তমানে চিড়িয়াখানাটির অবস্থান শ্রীমঙ্গলের ভাড়াউড়ায় সিতেশ রঞ্জন দেবের খামারবাড়িতে। এখানে বেশকিছু দুর্লভ ও বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীর দেখা পাওয়া যায়। যেমন- মেছো বাঘ, বিরল আলবিনো বাঘ (শাদা বাঘ), সোনালি বাঘ, ভাল্লুক, গন্ধগোকুল, সজারু, খাটাশ, বনরুই, উড়ুক্কু কাটবিড়ালী, সাইবেরিয়ান লেজ্জা লামবার্ড, লজ্জাবতী বানর, ইন্ডিয়ান সোনালি বানর, মায়া হরিণ, চিত্রাহরিণ, সোনালি কচ্ছপ, বন্য খরগোশ ইত্যাদি। সরীসৃপের মধ্যে রয়েছে গুইসাপ, অজগর ইত্যাদি। রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি, যেমনÑ ধনেশ, পাহাড়ি ময়না, লক্ষণ টিয়া, হেমালিয়ান টিয়া, সবুজ ঘুঘু, বন্য মথুরা, বনমোরগ, সরালী, কালিম, তিতির, শঙ্খচিল, হরিয়াল, শিশিবক ইত্যাদি।
মাধবপুর হ্রদ
লাউয়াছড়া যে রোড ধরে যেতে হয়, আরো কিলো দুয়েক এগুলেই ন্যাশনাল টি কোম্পানি বা এনটিসি’র চাবাগান। বাগানের ১১ নম্বর সেকশনে মনোরম একটি জলাধার। এটাই মাধবপুর হ্রদ। চা চাষ ও প্রক্রিয়াজাতের জন্য প্রচুর পানির প্রয়োজন হয়, এনটিসি তাদের এই প্রয়োজন মেটাতে ১৯৬৫ সালে বাগানের মধ্যস্থিত তিনটি টিলাকে বাঁধ দিয়ে পানি জমিয়ে কৃত্রিমভাবে গড়ে তোলে মাধবপুর হ্রদ। প্রায় ৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ ও স্থানভেদে ৫০ থেকে ৩০০ মিটার প্রস্থের এই হ্রদের আয়তন প্রায় ৫০ একর । হ্রদটির বুকে সারা বছরই কমবেশি ভেসে বেড়ায় নানা জাতের হাঁস, সরালি, পানকৌড়ি, জলপিপি আর শীতকালে তাদের সঙ্গী হয় পরিযায়ী পাখির দল। মাধবপুর হ্রদের মূল আকর্ষণ বেগুনি শাপলা। এছাড়াও আছে নীল পদ্ম, টিলার পাশজুড়ে ফুটে থাকা ভাঁট ফুল। চাবাগান কর্তৃপক্ষ বাগানের টিলার নিচে লেকের পাড় ঘেঁষে হাঁটার জন্য সরু পথ করে দিয়েছে, টিলার ওপর তৈরি করেছে খড়ের তাঁবু। এখান থেকে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের বেশকিছু পাহাড় দেখা যায়।
হাইল হাওর
শ্রীমঙ্গলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আরেকটি অবিচ্ছেদী অংশ হাইল হাওর। দিগন্তজোড়া শান্ত জলরাশি, এখানে ওখানে দু-একটি জলডিঙির নীরব আনাগোনা, গেঁয়ো কিশোর-কিশোরীর গ্রামীণ উচ্ছলতা অন্যরকম এক ভালোলাগা ছড়িয়ে দেয় ভ্রমণার্থীদের দেহমনে। হাইল হাওরের আসল সৌন্দর্য হচ্ছে নানা প্রজাতির পাখি। অনুক‚ল পরিবেশ বিরাজ করায় বারো মাসই এলাকাটি পাখির কলতানে মুখরিত থাকে। শীতকালে পরিযায়ী পাখি তো আছেই। বর্ষায় হাইল হাওরের বিস্তীর্ণ জলরাশি দেখলে মনে হয় চারপাশে পানি ছাড়া আর কিছুই নেই। হাওরজুড়ে জেলেদের মাছ শিকারের দৃশ্যও মনে রাখার মতো।
বাইক্কা বিল
হাইল হাওরেরই সৌন্দর্যমণ্ডিত একটা অংশ বাইক্কা বিল। মাছ ও পাখির অভয়াশ্রম হিসেবে গড়ে তোলা সংরক্ষিত এই বিলের সৌন্দর্য যেন স্বপ্নময়। শ্রীমঙ্গল থেকে মৌলভীবাজার যাবার হাইওয়ে ধরে মধ্যিখানে কালাপুর বাজার। কালাপুর বাজার থেকে বরুণা-হাজিপুর রাস্তা দিয়ে হাজিপুর বাজার। সেখান থেকে ৩-৪ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে কিংবা বাইকে চড়ে বাইক্কা বিল। হাজিপুর বাজার থেকে চাইলে গাইডও নেয়া যায়। বিলটিকে হাইল হাওরের প্রাণ বলা যেতে পারে। কেননা এই অংশটিই পর্যটকদের ভ্রমণকে পরিপূর্ণ করে তোলে। পাখির কলতানে দিনের পুরোটা সময়ই বিলটি মুখরিত থাকে। পাখি দেখার জন্য আছে তিনতলা বিশিষ্ট একটি ওয়াচটাওয়ার। আছে দূরবীনের ব্যবস্থাও। ওয়াচটাওয়ারে উঠে চোখে দূরবীন লাগিয়ে ইচ্ছে মতো অবলোকন করা যায় রঙ বেরঙের বিভিন্ন প্রজাতির পাখির সৌন্দর্য।
বিলুপ্তপ্রায় বিভিন্ন দেশীয় মাছ, যেমনÑ কালবাউশ, গইন্না, আইড়, চিতল, গুলশা, পাবদাসহ প্রায় ১৫-২০ প্রজাতির মাছ সংরক্ষণ করা হচ্ছে বিলটিতে এবং ফলাফলও আশাব্যাঞ্জক। এছাড়াও বাইক্কা বিলে মাখনা, শালুকসহ বেশকিছু জলজ ফল পাওয়া যায়। বিলভরা শাপলা ও পদ্ম তো আছেই।
হামহাম জলপ্রপাত
অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমীদের খুবই প্রিয় একটি স্পট হামহাম জলপ্রপাত। প্রকৃতির নিবিড় স্পর্শে জলপতনের অবিরাম কলনাদ অদ্ভুত এক রোমাঞ্চমাখা আনন্দে আন্দোলিত করে প্রকৃতিপ্রেমী যে কারো হৃদয়-মন। শ্রীমঙ্গলের পাশের উপজেলা কমলগঞ্জে হামহাম জলপ্রপাতের অবস্থান। যাতায়াতপথ খুবই দুর্গম। অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমী ছাড়া সাধারণ পর্যটকদের কেউ খুব একটা যেতে চান না। কমলগঞ্জ শহর থেকে প্রায় ৩৮ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বের রাজকান্দি ফরেস্টরেঞ্জের কুরমা বন বিটে অবস্থিত হামহাম জলপ্রপাত। মজার ব্যাপার এই জলপ্রপাতের মাত্র দু’শো ফুট পূর্বে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সীমানা।
শ্রীমঙ্গল থেকে হামহাম যেতে হলে স্থানীয় বাস, মাইক্রোবাস বা জিপে করে যেতে হবে কুরমা চেকপোস্ট পর্যন্ত। দূরত্ব ৩০ কিলোমিটার। কমলগঞ্জ থেকে গেলে ২৫ কিলোমিটার। তারপর কুরমা চেকপোস্ট থেকে ১০ কিলোমিটার কাঁচা রাস্তা হাঁটলে অরণ্যঘেরা চাম্পারায় চাবাগান। দীর্ঘপথ পায়ে হাঁটার ক্লান্তি দূর করতে চাবাগানে খানিকক্ষণ বিশ্রাম নেয়া যেতে পারে। তারপর আবারও ৫ কিলোমিটারের পায়ে হাঁটা পথ। এই পথ পাড়ি দিলে পৌঁছা যাবে সীমান্তবর্তী ত্রিপুরা পল্লি তৈলংবাড়ি কলাবন বস্তিতে। এবার এখান থেকে ৩০০-৪০০ টাকার বিনিময়ে সাথে একজন গাইড নিয়ে দুই-আড়াই ঘণ্টা পাহাড়ি বিপদসংকুল রাস্তা পাড়ি দিলেই চোখে ভাসবে পরম আরাধ্য অপরূপ হামহাম জলপ্রপাত। পথে প্রায় ৬ কিলোমিটার পাহাড়ি টিলা ও ২ কিলোমিটার দীর্ঘ কর্দমাক্ত ছড়ার পানি এবং সর্বশেষ একটি উঁচু পাহাড় মোকামটিলা অতিক্রম করতে হবে। হামহাম যাওয়ার জন্য সরকারিভাবে কোনো রাস্তা বা অবকাঠামো তৈরি করা হয়নি, তাই সেখানে যাওয়ার সময় সাথে খাবার-দাবার, মিনারেল ওয়াটার নিয়ে যেতে হবে, নইলে না খেয়েই থাকতে হবে।
মনিপুরি পল্লি
বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃতাত্তি¡ক গোষ্ঠীর মধ্যে অন্যতম মনিপুরি আদিবাসি। মৌলভীবাজারের বড়লেখা, কমলগঞ্জ, শ্রীমঙ্গল, কুলাউড়া, হবিগঞ্জের চুনারুঘাট এবং সুনামগঞ্জের ছাতকে মনিপুরি আদিবাসীদের বসবাস রয়েছে। দেশীয় সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদী অংশ হচ্ছে মনিপুরী নৃত্য ও মনিপুরী তাঁত। যদিও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, কাঁচামালের দুষ্প্রাপ্যতা ইত্যাদি নানাবিধ সমস্যায় মনিপুরী তাঁত শিল্প অনেকটা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে, তারপরও অনেক মনিপুরি পরিবার সযতেœ শিল্পটিকে টিকিয়ে রেখেছে। শ্রীমঙ্গলের রামনগর মনিপুরি পাড়ায় এখনো ঐতিহ্য ধরে রাখার প্রয়াসে বেশ ক’টি তাঁতে তৈরি হচ্ছে শাড়ি, থ্রি-পিস, ওড়না, ব্যাগসহ নানা ধরনের পণ্য। তাঁত শিল্প সম্পর্কে জানতে এবং তাঁতে কাপড় বুনার প্রক্রিয়া দেখতে চাইলে ঘুরে আসতে পারেন শ্রীমঙ্গলের রামনগর মনিপুরি পাড়ায়। মনিপুরিদের আতিথেয়তা গ্রহণ করতে শ্রীমঙ্গল শহর থেকে রিকশাযোগে সহজেই যাওয়া যায় মনিপুরি পাড়ায়। তবে বাংলাসনের কার্তিক মাসের শেষ পূর্ণিমা তিথিতে মনিপুরিদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব রাসোৎসব দেখতে চাইলে যেতে হবে কমলগঞ্জের মাধবপুরস্থ জোড়ামÐপ অথবা আদমপুরস্থ মনিপুরি শিক্ষা ও সংস্কৃতি কেন্দ্রে।
খাসিয়া পানপুঞ্জি
আদিবাসী খাসিয়া স¤প্রদায় দূর্গম পাহাড়ি এলাকায় উঁচু পাহাড়ি টিলা পরিস্কার করে পান চাষ করে থাকে। এসব পান চাষ এলাকাই ‘পুঞ্জি’ নামে পরিচিত। প্রতিটি পানপুঞ্জিতে ২৫-৩০টি পরিবার গোষ্ঠীবদ্ধভাবে বসবাস করে। খাসিয়ারা পাহাড়ি পতিত ভ‚মিতে সুউচ্চ গাছের পাশে লতানো পানের চারা রোপণ করে। রোপণকৃত এ চারা অল্পদিনেই বড় গাছ বেয়ে উপরে উঠে যায়। টিলার পর টিলা সুউচ্চ গাছগুলো সবুজ পান পাতায় ঢেকে থাকে আর বড় গাছে লতানো পান গাছের এই দৃশ্য অত্যন্ত নয়নাভিরাম। খাসিয়া স¤প্রদায়ের পুরুষরা বাঁশের তৈরি এক প্রকার মই ব্যবহার করে গাছ থেকে পান সংগ্রহ করে। সে পান খাসিয়া নারীরা গুছিয়ে খাঁচায় ভরে। শ্রীমঙ্গলে এই দৃশ্য দেখতে চাইলে যেতে হয় নাহার, নিরালা, চলিতাছড়া, লাউয়াছড়া প্রভৃতি পানপুঞ্জিতে। এসব পুঞ্জিতে প্রতিদিনই সকাল-বিকেল পান ক্রেতাদের জিপ গাড়ি যাতায়াত করে। শ্রীমঙ্গল শহর থেকে এদের সাথে ভাড়া দরদাম করে চলে যাওয়া যায় যে কোনো পুঞ্জিতে।
মাগুরছড়া পরিত্যক্ত গ্যাসকূপ
১৯৯৭ সালের ১৪ জুন গভীর রাতে এ গ্যাসক‚পে ড্রিলিংয়ের সময় অগ্নিবিস্ফোরণে আশপাশের খাসিয়া পুঞ্জি, চা-বাগান, রেললাইন, সবুজ বনাঞ্চল সবকিছু পুড়ে ছাঁই হয়ে যায়। এই গ্যাসক‚পটি এখন পরিত্যক্ত এবং সংরক্ষিত এলাকা। চারদিকে কাঁটাতারের বেড়া। গত ১১ বছর ধরে এ এলাকাটিতে আবারও সজীবতা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালাচ্ছে বন বিভাগ। প্রকৃতিও নিজরূপ ফিরে পাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। আগুনে পোড়া গাছগুলো এখনও কালের সাক্ষী হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে মাগুরছড়ায়। দর্শনার্থীরা এ এলাকায় বেড়াতে এসে অবাক বিস্ময়ে অবলোকন করেন মাগুরছড়ার পুড়ে যাওয়া দৃশ্যাবলি।
মসজিদে জান্নাতুল ফিরদাউস
শ্রীমঙ্গলের পর্যটনশিল্পে নতুন এক সংযোজনের নাম মসজিদে জান্নাতুল ফিরদাউস। বছর কয়েক হলো সুরম্য এই মসজিদটি নির্মাণের। শহর থেকে মাত্র ৭-৮ কিলোমিটার দূরত্বে এর অবস্থান। মসজিদটি তৈরি করা হয়েছে তুর্কি নকশায়। বিস্তৃত চায়ের পাহাড়, ঢেউখেলানো আনারস আর লেবুবাগানের ভেতর দিয়ে আঁকাবাঁকা পথ মাড়িয়ে একজন ভ্রমণার্থী যখন মসজিদ দহলিজে পৌঁছেন, সৃষ্টি তখন নতুনভাবে ধরা দেয় তার কাছে। সমতল ভ‚মি থেকে প্রায় ৭০-৮০ ফুট উপরে ছোট্ট এক টিলায় ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকা এই মসজিদটির বারান্দা পর্যন্ত পৌঁছুতে পাড়ি দিতে হয় দৃষ্টিনন্দন ১৩৯টি সিঁড়ি। ঝকঝকে এই সিঁড়িগুলোর দু’পাশে সাদা এবং মাঝখানে থাকা টকটকে লাল রঙ ভ্রমণার্থীর মনেও রঙ ছড়ায়। একেকটা সিঁড়ি মাড়িয়ে আপনি যখন উপরের দিকে উঠতে থাকবেন, ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে থাকবে প্রকৃতির বুকে মানুষের গড়া সৌন্দর্য।
খাজা মুজাম্মেল হকের পুত্র খাজা টিপু সুলতান এ মসজিদটি নির্মাণ করেছেন। পাহাড়ি অঞ্চলের অজপাড়া এলাকায় প্রতিষ্ঠা পাওয়া এই মসজিদটিতে মুসল্লি সংখ্যা হাতেগোনা হলেও পর্যটকদের ভিড় চোখে পড়ার মতো। এটা যেন এখন আর কোনো মসজিদই নয়, কেবলই একটা পর্যটন স্পট।
সাত রঙ-এর চা
সাত রঙ বললে ভুল হবে, রঙ এখন দশটায় পৌঁছেছে। একই কাপে একসাথে দশ রঙ-এর চা। একটা আরেকটার সাথে মেশে না। চায়ের দাম রঙ প্রতি দশ টাকা করে। দশ রঙের এককাপ নিলে একশো টাকা গুণতে হয়। শ্রীমঙ্গলের মনিপুরিপাড়া রামনগরের বাসিন্দা রমেশ রাম গৌড় এই চায়ের উদ্ভাবক। প্রথমে তার নীলকণ্ঠ চা কেবিনেই কেবল এই চা পাওয়া গেলেও এখন অনেকেই তা তৈরি করার পদ্ধতি রপ্ত করে ফেলেছে। শ্রীমঙ্গলের যে কোনো পর্যটন স্পটে এখন দেদারছে পাওয়া যায় দশরঙা চা। আহামরি এই চিজটার স্বাদ না নিয়ে শ্রীমঙ্গল ভ্রমণার্থীরা কখনো ফেরেন না। খাওয়ার পর প্রতিক্রিয়া স্বরূপ তাদের মস্তিষ্কে প্রথমেই যে কথাটা বেজে ওঠে, তা হলো– ‘ইয়ে দিল্লি কা লাড্ডু। জো খায়ে ও পস্তায়ে, আওর জো না খায়ে ও ভি পস্তায়ে!’
মার্চ, ২০১৭