নবধ্বনি
  • হোম
  • স্বাগত কলাম
  • প্রচ্ছদ রচনা
  • মুক্তগদ্য
  • গল্প
  • রঙধনু
  • দিনলিপি
  • পুরানো সংখ্যা
No Result
View All Result
নবধ্বনি
  • হোম
  • স্বাগত কলাম
  • প্রচ্ছদ রচনা
  • মুক্তগদ্য
  • গল্প
  • রঙধনু
  • দিনলিপি
  • পুরানো সংখ্যা
No Result
View All Result
নবধ্বনি

আব্দুর রাহমান আস সুমাইতঃ অন্ধকার মহাদেশে আলোর অভিযাত্রী

নাজমুস সাকিব

আব্দুর রাহমান আস সুমাইতঃ অন্ধকার মহাদেশে আলোর অভিযাত্রী
Share on FacebookShare on Twitter

 

এ যুগে একজন মানুষ কতটা মহৎ হতে পারেন? কতটুক বিলিয়ে দিতে পারেন অন্যের জন্য নিজেকে কিংবা কতজন মানুষের জন্য কল্যাণ বয়ে আনতে পারেন শুধু একজন মানুষ?

প্রশ্নটা একটু কঠিন।  তবে যাদেরকে আমরা মহান মানুষ মনে করি, নামী-দামী পুরষ্কারে যাদের ভূষিত করি তাদের কথা আমরা এখানে বলতে পারি।  হয়ত তিনি কোনো দেশের স্বাধীনতা এনে দেয়া একজন অবিসংবাদিত নেতা, অথবা সংগ্রাম করে সমাজকে বদলে দেয়া একজন সমাজকর্মী।  আরও বলতে পারি, শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করা কোনো মহানায়ক অথবা চমকপ্রদ কিছু আবিষ্কার করা একজন বিজ্ঞানী।

মহান মানুষ সম্পর্কে আমাদের ভাবনা এর চেয়ে বেশিদূর যায় না।  স্বীকৃতি কিংবা কোনো আন্তর্জাতিক পুরষ্কার না পেলে আমরা চিনতে পারি না কাউকে।  এ যুগে বড় হওয়ার মাপকাঠি যেন এতটুকুই।

তবে আজকে যার কথা বলব তিনি মহত্ত্বে ছাড়িয়ে গেছেন এমন সবাইকে যাদের আমরা মহান মানুষ বলে মনে করি। যিনি ছাপিয়ে গেছেন দেশ ছাপিয়ে পুরো একটি মহাদেশে। মানুষের জাগতিক কল্যাণের পাশাপাশি কাজ করেছেন পরকালের মহাকল্যাণের জন্য।  কুয়েতের ডাঃ আব্দুর রহমান আস সুমাইত সেই মহান ব্যক্তির নাম।  আফ্রিকার কোটি মানুষের কাছে তিনি আরব শেখ বলে পরিচিত।  তাকে নিয়ে নবধ্বনির ঈদসংখ্যার এই আয়োজন।

শুরুর গল্প

ডাঃ আব্দুর রহমানের প্রথম জীবনটা বেশ সাদামাটা না হলেও ছিল সম্ভাবনাময়।  কুয়েতের সম্ভ্রান্ত বংশের সন্তান। বিদেশে পাঠানো হয়েছিল উচশিক্ষার জন্য। বাগদাদ থেকে ডাক্তারি পাশ করে উচ্চ শিক্ষার জন্য অনেক বছর কাটিয়েছেন ইংল্যান্ড ও কানাডায়।  কানাডা থেকে ডিগ্রী নিয়ে আবার কর্মজীবন শুরু করেছিলেন ইংল্যান্ডে।

দু বছর তার ইচ্ছে হলো দেশে ফেরার।  স্ত্রী উম্মে সুহাইবের সাথে একদিন কথায় কথায় জানালেন তার ইচ্ছের কথা। কিন্তু কুয়েতে গিয়েই কী লাভ? টাকা-পয়সা তো আর জীবনের উদ্দেশ্য নয়।  তাছাড়া তাদের দুজনের কারোরই অর্থের মোহ নেই।

‘চলুন, আমরা এক কাজ করি। ‘ স্ত্রীই প্রথমে তুললেন কথাটা।  কোনো দরিদ্র দেশে চলে যাই।  সেখানে আপনি ডাক্তারি করবেন। আমি শিক্ষকতা করব।  পাশাপাশি ইসলামের দাওয়াত দিব দুজনে।

আব্দুর রহমান স্ত্রীর প্রস্তাব ভেবে দেখলেন।   তাঁরও আগে থেকে এমন ভাবনা ছিল। জীবনের নানা ব্যস্ততায় আর সে সুযোগ হয়ে ওঠে নি।  ভালো কাজের প্রতি তার আগ্রহ তো ছোট বেলা থেকেই। কলেজে পড়ার সময় বন্ধুরা মিলে চাঁদা দিয়ে একটি গাড়ি কিনেছিলেন শ্রমিকদের যাতায়াতের জন্য।  নিজেরা সে গাড়ি দিয়ে সকাল-সন্ধ্যা পৌঁছে দিতেন কুয়েত সিটির বহু শ্রমিককে।

দুজনে মিলে ভাবতে লাগলেন কোথায় যাওয়া যায়। সবদিক ভেবে বেছে নিলেন মালয়েশিয়া। এমনিতে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ।  তাছাড়া জাতি হিসেবে এরা বেশ ভদ্র।  সেখানে কোথাও চাকরির পাশাপাশি ইসলামের দাওয়াত দিবেন দুজনে।

ইংল্যান্ড থেকে সব গুটিয়ে তারা একেবারে চলে এলেন কুয়েতে।  এসেই খোঁজ করতে লাগলেন মালয়েশিয়া যাবার কোনো উপায় বের করা যায় কিনা।

স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আস সুমাইত বলছিলেন, আল্লাহ চেয়েছিলেন আমাকে আফ্রিকায় নিয়ে যাবেন। তাই মালয়েশিয়া যাবার সব পথ বন্ধ করে দিয়েছিলেন আমার জন্য।  অনেক চেষ্টা করেও মালয়েশিয়া যাবার কোনো উপায় আমি বের করতে পারি নি।

অন্য কোনো দেশে গিয়ে কাজ করার সুযোগ করে দেয়ার জন্য প্রায়ই ধর্ম মন্ত্রণালয়ে আসা-যাওয়া করতে লাগলেন। তখন তিনি কুয়েতের আস সাবাহ হাসপাতালের অন্যতম চিকিৎসক।  এমন একজন চিকিৎসককে দাতব্য সংস্থার কাজ দিতে রাজি হন নি মন্ত্রী।

আব্দুর রাহমান এতে মনক্ষুন্ন হন। হাসপাতালের চাকরি তার কাছে বোঝা মনে হতে থাকে।  তবে এর মধ্যেও তিনি আলো ছড়িয়ে যান সবার মধ্যে। তার কাছে আসা রোগিদের তিনি চেষ্টা করতেন সুপথে নিয়ে আসতে। রোগি যদি মদ্যপ বা ধর্ম-কর্ম থেকে দূরে এমন কেউ হত তাকে তিনি আরও বেশি গুরুত্ব দিতেন।  এক বছরে এমন বারোজন রোগির জীবন বদলে যায় তার হাতে।

এর মধ্যে একদিন একটা প্রজেক্টের দায়িত্ব পেলেন আব্দুর রাহমান।  ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকে একাজের জন্য তাকে নির্বাচিত করা হয়।  ধনাঢ্য এক নারী কিছু অর্থ অনুদান দিয়েছেন কুয়েতের কোথাও একটি মসজিদ বানানোর জন্য। আব্দুর রাহমান ভাবলেন, মসজিদটি নির্মিত হোক আফ্রিকার কোনো দরিদ্র দেশে। সে মহিলাকে জানালেন তার ইচ্ছার কথা।

আব্দুর রাহমানের প্রস্তাবে তিনি জানালেন, আমার কোনো অসুবিধা নেই।  আমি গ্রাম্য মানুষ।  বয়স হয়েছে অনেক। অত কিছু বুঝি না। এই টাকা দিয়ে তোমরা যা ভালো মনে করো করতে পার। নিজের কর্মচারীকে দিয়ে এই বার্তা পাঠান সেই নারী।

মসজিদ নির্মাণের জন্য আব্দুর রাহমান বেছে নেন মালাওয়াই।  সেখানে গিয়ে নানা অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন তিনি। শুরু হয় তার নতুন যাত্রা।

মালাওয়াইয়ের অভিজ্ঞতা  

মসজিদ বানানোর প্রকল্প নিয়ে মালাওয়াইতে যান আব্দুর রাহমান আস সুমাইত। এই প্রথম তার আফ্রিকায় আসা। মসজিদ বানিয়ে ফিরে যাওয়াই উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু সেখানকার মুসলিমদের অবস্থা দেখে বেদনাহত হতে হয় তাকে। নিজেকে মুসলিম বলে পরিচয় দেয় কিন্তু ইসলামের মৌলিক কোনো বিষয় তাদের জানা নেই। পুরো গ্রামে এমন একজন মানুষ তিনি পান নি যে বলতে পারে ফজরের নামায কত রাকাত।

ধর্মীয় জীবনের পাশাপাশি তাদের সামাজিক দুরাবস্থা চোখে পড়ে তার। সামান্য রোগে ভিটামিনের অভাবে চোখের সামনে মারা যেতে দেখেন বহু মানুষ। মুসলিম হওয়ার কারণে খ্রিস্টান মিশনারিদের তৈরি হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হত না তাদের। শিক্ষা না থাকায় কুসংস্কার এবং অন্ধকারে ছেয়ে গিয়েছিল সেখানকার সমাজ।

আব্দুর রাহমান সেখান থেকে সংকল্প করেন তাদের জন্য কাজ করার।  প্রতিষ্ঠা করেন আল আউনুল মুবাশির নামের দাতব্য সংস্থা।  মালাওয়াই থেকে এভাবে তিনি ছড়িয়ে যান আফ্রিকার ৪০ টি দেশে।

 

 

আফ্রিকায় ইসলামের সুপ্ত বীজ

‘আফ্রিকায় ইসলাম পৌঁছেছিল হাজার বছর আগে।  এমন না যে প্যারাসুটের মত আমরা গিয়ে হাজির হয়েছি সেখানে।  বরং সেখানে বহু আগেই রোপিত হয়েছে ইসলামের বীজ।  শিক্ষার অভাব এবং ফ্রান্সের উপনিবেশ ইসলামের নিশানা মুছে দিয়েছে সেখান থেকে। ’একটি বক্তব্যে এভাবে বলছিলেন আস সুমাইত।

কেনিয়া ও জিম্বাবুয়েতে ১৩০০ বছর আগের মসজিদ আছে।  জানজাবারে তিনি একটি প্রাচীন কববের দেখা পেয়েছেন। সেখানে নুকতাবিহীন আরবিতে একজন আরবের নাম লেখা। আরও লেখা আছে হিজরি ৯৪ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।  সম্ভাবনা আছে, তিনি কোনো সাহাবি অথবা প্রথম সারির একজন তাবেয়ি।

বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে দেখেছেন সবার নাম মুসলিম।  কিন্তু তারা জানে না ইসলাম কী? একটা গোত্র নিজেদের পরিচয় দিয়েছে প্রোটেস্ট্যান্ট মুসলিম বলে।  তারা বলে, আমরা বাপ-দাদাদের থেকে শুনে এসেছি আমরা মুসলিম।  আর কয়েক বছর আগে পাদ্রীরা এসেছে আমাদের কাছে।  তারা বলেছে তোমরা প্রোটেস্ট্যান্ট। তাই আমরা প্রোটেস্ট্যান্ট মুসলিম।

মাদাগাস্কারে দেখা পেয়েছিলেন আন্তিমোর গোত্রের। যারা নিজেদেরকে আরব বংশ বলে পরিচয় দেয়।  তারা জানায়, জেদ্দা নামের একটি গ্রাম থেকে এসেছিল তারা।  মক্কা ও হিজায নামে তাদের দুটি গ্রামও আছে।  আস সুমাইত পরে কয়েকজন গবেষকদের দিয়ে তাদের ইতিহাস উদঘাটন করেছিলেন।  হাজার বছর আগে কোনো গোত্রীয় যুদ্ধের ভয়ে তারা দেশ ত্যাগ করেছিল।

একটি গোত্রের মুখে বলতে শুনেছেন, ‘নুরে মক্কা নুরে মদিনা। ’ আরও শুনেছেন ‘নুরুল্লাহ। ’ তারা  জানায়, প্রাচীনকাল থেকে তারা শুনে আসছে এই শব্দগুলো।  শপথ করার সময় তারা এগুলো উচ্চারণ করে। কিন্তু জানা নেই মক্কা-মদিনা বা আল্লাহ মানে কী। তারা মুখে মুখে বলে, ‘রা আবু বকর, রা ওমর, রা ওসমান এবং রা আলি। ’ আরও বলে, ‘রা আমিনা। ’ তাদের ভাষায় রা মানে সম্মানিত।  ইসলাম ভুলে গেলেও বংশগতভাবে এসব নাম তাদের মুখে মুখে চলে আসছে।

আস সুমাইত তাদের বলেছিলেন, আমি তো মক্কা-মদিনা থেকে এসেছি।  তখন তারা তার হাত চেপে ধরে। আমাদের দয়া করে বলে যান মক্কা-মদিনা আসলে কী? আমরা কোনোদিন জানতে পারি নি।

পরে আফ্রিকার নানা দেশে এমন আরও গোত্র পেয়েছেন যারা আরব বংশের।  কালের পরিক্রমায়  হারিয়ে গেছে তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস।  ফারামবা ও গাবরা দুটি এমন গোত্র।  তারা জানায়, ১৯৪৭ সালের আগে তাদের কাছে আরবি অনেক কিতাব ছিল এগুলো তারা পড়তে জানতে না। তবে বাপ-দাদাদের থেকে ঐতিহ্য হিসেবে পাওয়া এসব খুব যত্নে রক্ষা করত।  ১৯৪৭ সালের পর থেকে ফরাসিরা সব পুড়িয়ে ফেলে।  যারা ধার্মিক ছিল তাদের হত্যা করে।

আরেক গোত্রে পেয়েছেন অদ্ভুত এক রীতি।  কারও বয়স চল্লিশ হওয়ার আগে তাকে গোত্রের রহস্য জানানো হয় না। আব্দুর রাহমান অনেক চেষ্টা করেন কী এই রহস্য জানতে।  তারা যখন নিশ্চিত হয় তার বয়স চল্লিশের বেশি তখন একটি পুরনো বই নিয়ে আসে।  সেখান থেকে একজন পড়ে শোনায়, আল্লাহ এক, তাঁর কোনো শরিক নেই।

ইসলামের প্রতি তাদের ভালোবাসাও অপরিসীম। তিন দশকের অভিজ্ঞতায় এমনটাই দেখেছেন আব্দুর রাহমান। সামান্য খাবার-পানির জন্য ইসলাম ত্যাগ করতে বএলেছে তাদের পাদ্রীরা।  ইথিওপিয়াতে এক ইমাম অসহায় হয়ে হাত পেতেছিলেন গির্জার পাদ্রীর কাছে।  পাদ্রী তাকে ধর্মত্যাগ করতে বলে।  ইমাম রাজি হন নি।  এরপর পাদ্রী তাকে বলে, ঠিক আছে।  তুমি খ্রিস্টান না হলেও অন্তত সবাইকে মিথ্যা বলে জানাও তুমি খ্রিস্টান হয়ে গেছো।  ইমাম এতেও রাজি হন নি।  তাকে খাবার-পানি দেয়া হয় নি।

দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে পুরো গ্রাম একসময় হিজরত করে।  আস সুমাইত এই ঘটনা জানতে পেরে পরে সেই ইমামের খোঁজে যান সেই গ্রামে।  ইমামের বাড়িতে ঢুকে দেখেন তাদের কংকাল পড়ে আছে ঘরের ভেতর।

একদিন আস সুমাইত কথা বলছিলেন এক গোত্র প্রধানের সাথে।  তখন মিশনারীদের পক্ষ থেকে খাদ্য সামগ্রী নিয়ে কয়েকটি ট্রাক আসে।  গোত্রপ্রধান পাদ্রীর সাথে কথা বলে হাতের ইশারায় তাকে না করে দেয়।  আব্দুর রাহমান তাকে জিজ্ঞেস করেন কী না করলে?  গোত্র প্রধান জানায়, এরা কিছু খাবার দিতে চেয়েছিল।

আব্দুর রাহমান তাকে বলেন, তোমার লোকেরা না খেয়ে মারা যাচ্ছে।  তুমি খাবার নিলে না কেন?

গোত্রপ্রধান এরা কটা খাবার দিয়ে আমাকে কিনে ফেলতে চায়।  আর তোমরা অন্য ধর্মের মানুষ হয়েও আমাদের সেবা করছ।

মিশনারিদের প্রতি অনেক ঘৃণা আফ্রিকানদের মনে। ইসলামের সরল বিশ্বাসকে তারা খুব সহজেই গ্রহণ করে নেয়। ইসলামের বীজ লুকানোই আছে তাদের মনে।  প্রয়োজন সেখানে একটু সেচ দেয়ার।

যেভাবে কাজ করেছেন আস সুমাইত

কোনো দাতব্য সংস্থায় সাধারণত দাতার অভাব হয় না।  অনেক ধনী একসাথে কয়েক মিলিয়ন দিনার দান করে দিতে পারেন।  কিন্তু সবসময় এমন অনুদান পাওয়া যাবে না।  আস সুমাইত চেয়েছিলেন কল্যাণের এই ধারা অব্যাহত থাকুক। তাই ছুটে গিয়েছেন সাধারণ মানুষের কাছে। সামান্য পরিমাণ কিন্তু নিয়মিত দান করবেন এমন দাতাদের থেকে দান গ্রহণ শুরু করেন।  ধীরে ধীরে দাতাদের সংখ্যা বাড়তে থাকে।

শুধু মসজিদ বা মাদরাসা বানিয়েই থেমে থাকেন নি আস সুমাইত।  গ্রামে গ্রামে গিয়ে মানুষের সাথে মিশেছেন।  তাদের প্রয়োজনীয় সহায়তা দেয়ার পাশাপাশি জীবনমান উন্নত করার জন্য কাজ করেছেন।  কৃষি বা কুটির শিল্পের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন।  উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে লাভজনক কৃষি উৎপাদন করেছেন।  কোনো কোনো এলাকায় দেখা গেছে, গ্রামবাসী নিজেরাই নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে।  নিজেদের স্কুল-মাদরাসা কিংবা এতিমখানা চালিয়েছে নিজেদের অর্থে। তাদের উৎপাদিত পণ্য রপ্তানি করা হয়েছে অন্য দেশেও।  এজন্য শুধু ব্যবস্থাপনা করতে হয়েছে।  প্রচুর অর্থ দিয়ে তাদের সাহায্য করতে হয় নি।

মসজিদ-মাদরাসার পাশাপাশি কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছেন।  চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপন করেছেন।  এভাবে জাগতিক সকল চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা করেছেন সবার আগে।  দলে দলে মানুষ তখন ইসলাম গ্রহণ করেছে।

দান গ্রহণের ক্ষেত্রে শুধু অর্থের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেন নি।  দাতাদের কাছ থেকে নিয়েছেন ব্যবহৃত ঘড়ি, চশমা, পোশাক এবং শিক্ষোপকরণ।  ফেলে রাখা এসব বস্তুও জীবন বদলে দিয়েছে আফ্রিকার বহু মানুষের।

সেবা দেয়ার ক্ষেত্রে কখনো মুসলিম-অমুসলিম বিভেদ করেন নি। তার প্রতিষ্ঠিত হাসপাতালে চিকিৎসা পেয়েছে খ্রিস্টানরাও।  গোত্রপ্রধানদের সাথে দেখা করে দিয়েছেন নানা উপহার।  ইসলামের উদারতা ও সাম্য তুলে ধরেছেন তার কাজের মাধ্যমে।

বরং ইসলাম গ্রহণের পর সাহায্য করা কমিয়ে দিয়েছেন অনেক ক্ষেত্রে।  যেন কেউ মনে না করে সাহায্যের বিনিময়ে তাদের কিনে নেয়া হচ্ছে।  তবে তাদেরকে সাবলম্বী হওয়ার পথ বাতলে দিয়েছেন।  শিল্প প্রতিষ্ঠান ও কৃষিকাজে সহায়তা করেছেন।

এর ফলাফল ছিল অবিশ্বাস্য।  আস সুমাইত সে গল্প বলেছেন তার নানা বক্তব্যে।  তার প্রতিষ্ঠিত নারী প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে  আসা নারীদের বেশিরভাগই থাকত অমুসলিম।  গলায় ক্রুশ ঝুলিয়ে আসা নারীরা ফিরে যেত বোরকা পরে। এবং ইসলাম প্রচারক হয়ে।  এক এলাকায় উচ্চমাধ্যমিক স্কুল তৈরি করেছিলেন আস সুমাইত।  সেখানে পড়তে আসা ছাত্ররা প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেছিল গির্জা পরিচালিত স্কুলে।  সবার গলায় ছিল ক্রুশ।  আব্দুর রাহমান শিক্ষকদের বলে দেন, কাউকে কখনো বলবেন  না ক্রুশ খুলে ফেলো অথবা নামায পড়তে আসো।

তিনমাস পর বদলে গেলো স্কুলের চেহারা।  ছাত্ররা সবাই ক্রুশ খুলে নামাজ শুরু করল।  শুধু তাই না, সাপ্তাহিক ছুটির দিনে ৪০-৫০ মাইল হেঁটে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দিতে লাগল দূর-দূরান্তে।

পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর সেই ছাত্ররা আবেদন করেছিল সার্টিফিকেটে তাদের নাম বদলে দিতে।  কারণ তাদের মুসলিম নাম বদলে দিয়েছিল গির্জার স্কুল। নিঃস্বার্থ সেবায় এভাবে ইসলাম ছড়িয়ে পড়েছে আফ্রিকার দরিদ্র দেশগুলোতে।

সাধারণত গৃহযুদ্ধ কবলিত অঞ্চলে কাজ করতে পারতেন না আস সুমাইত।  তাই সেসব অঞ্চল এড়িয়ে চলতে হত তাকে।  একবার সেনেগালের যুদ্ধ কবলিত এক শাসক এসে তার কাছে আবেদন করেন সেখানকার গ্রামগুলোতে পানির পাম্প তৈরি করে দিতে।  গোলযোগপূর্ণ এলাকা বলে সেখানে সরকার কাজ করতে পারছে না। এখানকার মানুষ যোগ দিয়েছে বিদ্রোহী বাহিনীতে।

আস সুমাইত তার সংস্থার পক্ষ থেকে সেখানে ছয়টি পাম্প তৈরি করে দেন।  এর পরের সপ্তাহে সেখানকার কয়েক গ্রামের মানুষ ইসলাম গ্রহণ করে।

ইসলাম ধর্ম প্রচারে খ্রিস্টান মিশনারীদের থেকে অনেক এগিয়ে গেছেন আস সুমাইত।  এর মূল কারণ উদারপন্থা।  এক বক্তব্যে একটি এলাকার কথা বলেছিলেন সুমাইত।  সেখানে প্রায় বিশ বছরে অনেক অর্থ খরচ করেছে মিশনারীরা। তাদের থেকে অনেক কম অর্থমূল্যের সেবা দিতে পেরেছেন আস সুমাইত।  কিন্তু মানুষের মন জয় করতে পেরেছিলেন তিনি।  তাই দলে দলে সবাই ইসলাম গ্রহণ করেছে।

সেখানকার অধিবাসীদের বাইবেলের অনুবাদ শোনার জন্য ক্যাসেট ও টেপরেকর্ডার দিয়েছিল সেখানকার পাদ্রী।  কিন্তু লোকজন সেই ক্যাসেটে কুরআন রেকর্ড করে নেয় শোনার জন্য।  অবশেষে বাধ্য হয়ে মিশনারীরা সে এলাকা ত্যাগ করে এবং বলে যায়, যীশু তোমাদের ভালোবাসেন না।

মিশনারীরা ধর্মান্তরের ক্ষেত্রে জোর করে থাকে।  প্রভাব বিস্তার করা থাকে তাদের লক্ষ্য।  এ পথ সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলেছেন আস সুমাইত।  সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন সবার সাথে।

অবশ্য মিশনারিদের মধ্যে কিছু ব্যতিক্রম ঘটনাও পেয়েছেন।  এক পাদ্রী মৃত্যুশয্যায় এক মিলিয়ন ডলার তুলে দিয়েছেন আস সুমাইতের হাতে।  বলেছেন, আমার মৃত্যুর পর গির্জা সব নিয়ে নেবে।  তুমি এটা দিয়ে মানুষের সেবা করো।  আরেক পাদ্রী মসজিদের জন্য জমি প্রদান করেছিলেন তার সংস্থাকে।

মানুষকে সরল কথায় দাওয়াত দিয়েছেন আস সুমাইত। শিক্ষাবঞ্চিত সভ্যতাহীন এসব মানুষকে বঝাতে গিয়ে কৌশল অবলম্বন করতে হয়েছে তাদের। মাদাগাস্কার, কেনিয়া ও জিম্বাবুয়েতে তিনি কিছু গোত্রের দেখা পেয়েছেন যারা ছয়শ বছর আগে আরব থেকে হিজরত করেছিল। তাদের কাছে গিয়ে আস সুমাইত বলেন আমরা তোমাদেরই ভাই।  আরবে থাকা তোমাদের ভাইরা তোমাদের খোঁজ খবর নেয়ার জন্য আমাকে পাঠিয়েছে।

খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের কাছে ইসলামের বাণী পৌঁছেছেন অনন্য এক পন্থায়।  তাদের বলেছেন, আমাদের কুরআনে একটি সূরার নাম মারইয়াম।  আরেকটি সূরার নাম আলে ইমরান।  আমাদের সবার প্রতিপালক আললাহ।

এসব গোত্রকে ইসলামের পথে আনতে অনেক সময় লেগেছে।  বারো বছর, চৌদ্দ বছর এমনকি পঁচিশ বছরের পরিকল্পনা নিয়ে তাদের জন্য কাজ করেছেন আস সুমাইতের সংস্থার ধর্ম প্রচারকরা।

এক গোত্র তার কাছে দাবি করেছিল বৃষ্টির জন্য দোয়া করতে।  গত তিনবছর ধরে সেখানে বৃষ্টি নেই।  যদি বৃষ্টি আসে তাহলে তারা ইসলাম গ্রহণ করবে।  আব্দুর রাহমান প্রথমে অজুহাত দেখান তাদের। বলেন আমি ক্লান্ত। সবেমাত্র এসেছি তোমাদের কাছে।  তোমাদের সাথে কথা বলি।

তারা কোনো কথাই শুনতে রাজি নয়।  একটি গাছের নিচে বসেই তাকে দুয়া করতে বলে।

আব্দুর রাহমান কেঁদে কেঁদে দোয়া শুরু করেন।  আল্লাহকে বলেন, আব্দুর রাহমান যদি ব্যর্থ হয়, আব্দুর রাহমান যদি অপমানিত হয় তাহলে তো কোনো দুঃখ নেই।  কিন্তু আব্দুর রাহমানের ভুলের জন্য আপনার দ্বীনের যেন অসম্মান না হয়।

কয়েক ঘন্টা দুয়া করে তিনি বসে রইলেন।  সামনে খাবার রাখা ছিল।  সারাদিনে খাবার ছুঁয়ে দেখার সময় হয় নি।

একটু পর বিকাল দিকে আকাশ কালো হয়ে এলো।  অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামল খরা ভূমিতে।  এভাবে ইসলামের আলো জ্বলে ওঠে তাদের মধ্যে।

কল্যাণের পথে এক যোদ্ধা

ছোটবেলা থেকে চ্যালেঞ্জ নিতে ভালোবাসর রাহমান আস সুমাইত। সেজন্যই তো বাগদাদে ডাক্তারি পড়তে গিয়েছিলেন।  কারণ শুনতে পেয়েছিলেন, বাগদাদের মেডিকেলে সহজে কেউ পাশ করে না। তাই আমেরিকা বাদ দিয়ে বাগদাদকে বেছে নেন।  মানব সেবার পথেও এমন বহু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন তিনি।  সেগুলোকে জয়ও করেছেন নিজের দৃঢ় মনোবল দিয়ে।

আফ্রিকায় দাতব্য সংস্থার কাজ করতে গিয়ে নানামুখী বাধা এসেছে সামনে। সবচেয়ে বড় বাধা ছিল মিশনারীরা।  ফ্রান্স ও আমেরিকার এসব দাতব্য সংস্থা বহু চেষ্টা করেছে তাকে বাধা দিতে। কিন্তু সাহসের সাথে সাথে সতর্ক হয়ে পথ চলেছেন তিনি।

কখনো মসজিদ নির্মাণে বাধা দিয়েছে তারা।  মসজিদের জন্য নির্বাচন করা জমি আগেই কিনে নিয়েছে গির্জা কর্তৃপক্ষ। তবে এক্ষেত্রে স্থানীয়দের সহায়তা পেয়েছেন তিনি। কখনো কোনো গোত্রের সরদার নিজের জমি তুলে দিয়েছে তার হাতে।

কখনো বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে আফ্রিকার আবহাওয়া, পরিবেশ ও দূর্গম পথ।  প্রচন্ড গরমে বাধ্য হয়ে নোংরা পানি খেতে হয়েছে তাকে।  কুমির আছে এমন নদী পার হতে হয়েছে ছোট নৌকায় করে।  গহীন জঙ্গলে কাটাতে হয়েছে রাত। সেখানে একটু পর পর শোনা যায় সিংহের গর্জন।

আব্দুর রাহমান আস সুমাইত বিলাসী জীবনে অভ্যস্ত করেন নি নিজেকে কখনো।   ছাত্রাবস্থায় প্রতিদিন একবার খেতেন।  খাটে না শুয়ে মেঝেতে শুতেন যেন আরামে অভ্যস্ত না হয়ে যান।  তাই এসবে কোনোদিন পিছপা হন নি।  আফ্রিকানদের কুঁড়েঘরে কাটিয়েছেন বহুরাত।  তাদের খাবার খেয়ে কাটিয়েছেন দিনের পর দিন।  বয়স এবং অসুস্থতা কোনোটিই তাকে দমাতে পারে নি।  শেষ বয়সে অন্যের কাঁধে ভর করে চষে বেড়িয়েছেন গ্রামের পর গ্রাম।  তিনবার স্ট্রোক আর দুবার ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন। সাথে ডায়াবেটিক আর প্রেশার তো আছেই।  নিয়মিত পাঁচবার ইনসুলিন নিতে হত তাকে।  কিছু ওষুধ তাকে প্রতিনিয়ত সেবন করতে হত যেগুলো ফ্রিজে রাখতে হত।  আফ্রিকার নানা এলাকায় সেখানে বিদ্যুতই নেই সেখানে ফ্রিজ পাওয়া যাবে কোথায়।  তবু আল্লাহর ওপর ভরসা করে পথ চলতেন তিনি।

ইরাকের কুয়েত আক্রমণের সময় তাকে গ্রেফতার করা হয়।  ইরাকি সৈন্যরা তার ওপর অকথ্য নির্যাতন করে।  হাত ও পায়ের হাড় ভেঙ্গে দেয়া হয়।  জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর সুস্থ হয়ে আবার তিনি আফ্রিকা অভিযান শুরু করেন।

মানব সেবায় নিজের সব কিছু উজাড় করে দেয়ার পরও নিন্দা থেকে রেহাই পান নি আস সুমাইত।  ইরাক-কুয়েত যুদ্ধের সময় তার কাছে থাকা সকল অনুদান তিনি কুয়েতিদের জন্য বিলিয়ে দেন।  আফ্রিকায় কাজ করার জন্য অনেকে তার সমালোচনা করেছে।  হাসিমুখে সেসব সয়ে নিজের কাজ করেছেন তিনি।  একজন যোদ্ধার মতই সব বাধা পেরিয়ে ব্রত হয়েছেন মানুষের সেবায়।

বিচিত্র অভিজ্ঞতার ঝুলি

প্রায় ত্রিশ বছরের বেশি দীর্ঘ সময় আফ্রিকার এক দেশ থেকে আরেক দেশে ছুটে বেড়িয়েছেন ডাঃ সুমাইত।  বিভিন্ন দেশের বড় বড় শহর থেকে শুরু করে বহু প্রাচীন জনগোষ্ঠী বা আদিবাসী সবার কাছে ছুটে গেছেন তিনি। তাদের প্রয়োজনীয় সহায়তার পাশাপাশি পৌঁছে দিয়েছেন ইসলামের বাণী।

এই লম্বা সময়ে নানা দেশে নানা বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছে তার।  মাদাগাস্কারে এক গ্রামে সন্ধান পেয়েছিলেন এক গোত্রের। তাদের নাম আন্তিমোর।  নিজেদের তারা আরব বংশের বলে পরিচয় দেয়।  তারা বলে, জেদ্দা নামের এক গ্রাম থেকে তাদের পূর্বপুরুষরা হিজরত করেছিল হাজার বছর আগে।  তাদের সেখানে একটি গ্রামের নাম মক্কা।  কাবার মত একটি ঘরও বানিয়েছে তারা।  নাঙা পায়ে সেই ঘর সাতবার তাওয়াফ করার পাশাপাশি সেখানে কুরবানীও করে থাকে তারা।

আব্দুর রাহমান আস সুমাইতের সম্মানে তারা তাঁকে সেই ঘরে ঢুকতে দিতে রাজি হয়।  কিন্তু বাধ সাধে তাঁর স্ত্রী ও মেয়েদের বেলায়।  মাথা ঢেকে সেখানে যাওয়া তাদের আইন বিরুদ্ধ।  আব্দুর রাহমান তাদের বোঝানোর চেষ্টা করেন। এক পর্যায়ে তারা রেগে যায় এবং সেখান থেকে দৌড়ে পালিয়ে আসতে হয় তাদের।

বেনিনের হাজি রুকাইয়ার গল্প সবার কাছে বলতেন আব্দুর রাহমান।  সেই নারী মুসলিম ছিলেন। সূরা ফাতিহা আর কিছু দোয়া দরুদ ছিল তার ধর্মীয় জ্ঞান। একটি দোকান দিয়েছিলেন তিনি। সেই দোকানে যারা আসত তাদের ইসলামের কথা বলতেন রুকাইয়া।

আব্দুর রাহমানের দল সেই গ্রামে একটি মসজিদ তৈরি করে দেয়।  সেখানে ইমাম হওয়ার মত আর কাউকে পাওয়া যায় নি।  উপায় না দেখে গ্রামবাসী রুকাইয়াকেই ইমাম বানিয়ে দেয়।

আফ্রিকায় বহু এলাকায় দেখা গেছে এমন চিত্র।  মসজিদের ইমাম কিন্তু সূরা ফাতিহাও শুদ্ধ করে তার জানা নেই।

নারীদের এমন উৎসর্গের আরও গল্প শুনিয়েছেন তিনি।  এক নারী মসজিদ নির্মাণের জন্য তার একমাত্র সম্বল গাভীটি দান করে দিয়েছিলেন।  সেই মসজিদের নাম রাখা হয় মসজিদুল বাকারা।

মুসলিমদের মধ্যে ধর্মের প্রতি আগ্রহ অনেক দেখেছেন আব্দুর রাহমান।  কিন্তু শিক্ষার অভাব অন্ধকার পথে নিয়ে  গেছে তাদের।  এক গ্রামে মুসলিমদের মধ্যে দেখেছেন অদ্ভুত রীতি।  সারা সপ্তাহ ধরে আল্লাহর ইবাদত করলেও প্রতি  শনিবার সবাই একজন মহিলার উপাসনা করে।  মহিলা মুসলিম।  মহিলার স্বামীও সবার সাথে শরীক হয় এই উপাসনায়।

আফ্রিকার নানান গোত্রের এমন অদ্ভুত রীতিনীতি অবাক করেছে তাকে।  একদিন দক্ষিণ সুদানের এক লোককে বলা হয়েছিল তার ছেলেদের নাম লিখে দিতে।  লোকটি মুসলিম এবং ডাঃ সুমাইতের সংস্থায় কাজ করত।  পরদিন লোকটি বিশাল এক তালিকা নিয়ে আসে।  আব্দুর রাহমান ভাবেন, লোকটি হয়ত তার গোত্রের সবাইকে নিজের সন্তান মনে করে।  তার এ অনুভূতির জন্য তিনি তাকে বাহবা দেন।  লোকটি আপত্তি করে বসে।  না এরা সবাই আমার নিজের সন্তান।

চোখ কপালে ওঠে আব্দুর রাহমান আস সুমাইতের। তালিকায় ৬৬ জনের নাম।  সবাই তোমার সন্তান?

লোকটি বলে,  জ্বি।  এখানে তো শুধু ছেলেদের নাম। মেয়েদের নাম তো লিখি নি।

এবারে হতভম্ব হয়ে যান আস সুমাইত।  তোমার মেয়ে কজন?

ছেলে মেয়ে মিলে আমার সন্তানসংখ্যা মোট ১৬০ জন।  আমার স্ত্রী ৪৪ জন।

আস সুমাইত বলেন এ কীভাবে সম্ভব।  ইসলামে চার জনের বেশি স্ত্রী রাখা যায় না।  এটা তো হারাম।  তুমি জলদি এর সমাধান করো।

লোকটি বলে কীভাবে সমাধান করব? এদের একজনকে ছাড়াও তো বাঁচব না আমি।

কিছুদিন পর তার সাথে আবার দেখা হয় আস সুমাইতের।  লোকটি বলে শায়খ, আপনার কথামত আমি সমাধান করে ফেলেছি।  আস সুমাইত শুনে খুশি হন।  তাকে জড়িয়ে অভিনন্দন জানান।

একটু পরই তার মনে প্রশ্ন জাগে, কীভাবে সমাধান করেছে তা তো শোনা হলো না। আব্দুর রাহমান তাকে ডেকে  জিজ্ঞেস করেন, কীভাবে সমাধান করলে বলো তো!

লোকটি জানায়, আমি চারজনকে আলাদা করে বলেছি, এখন থেকে শুধু এরা আমার স্ত্রী।  বাকি সবাই দাসী।

বদলে যাওয়ার নানা গল্প

আস সুমাইতের হাতে ২৯ বছরে বদলে গেছে আফ্রিকার ৩৯ টি দেশের কোটি কোটি মানুষের জীবন।  শুধু তার হাতেই ইসলাম গ্রহণ করেছে ১ কোটি ১০ লাখ মানুষ। নিজের তত্ত্বাবধানে লালন-পালন করেছেন দেড় লক্ষ এতিমের।  নির্মাণ করেছেন ৫৭০০ টি মসজিদ। পানির পাম্প তৈরি করেছেন ৯৫০০ টি। প্রতিষ্ঠা করেছেন ৮৬০ টি স্কুল, ৪ টি  বিশ্ববিদ্যালয় এবং ২০৪ টি ইসলামিক সেন্টার।  ১২৪ টি হাসপাতাল ও ৮৪০ টি ইসলামিক স্কুল।  তার দাতব্য সংস্থা থেকে শিক্ষা ফি দেয়া হয়েছে ৯৫ হাজার শিক্ষার্থীর পক্ষ থেকে।  এদের মধ্য থেকে উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের বাইরে পাঠানো হয়েছে অনেক মেধাবীকে।  প্রায় ৫১ মিলিয়ন কুরআনের কপি বিতরণ করেছেন তিনি।  এরমধ্যে ছয় মিলিয়ন কুরআন ছাপানো হয়েছে তার সংস্থার অর্থে।  আফ্রিকান নানা ভাষায় কুরআনের অনুবাদ করিয়েছেন আস সুমাইত।

এসব গাণিতিক হিসাব।  বাস্তবে আফ্রিকার বদলে যাওয়ার চিত্র আরও স্পষ্ট। আল-জাজিরা তার সম্পর্কে বলেছে, গত  ত্রিশ বছরে আফ্রিকা মহাদেশের চিত্র বদলে গেছে।  এর পেছনে অনেক বড় অবদান আস সুমাইতের।  তার পরিচর্যা কেন্দ্রে লালিত অনেক এতিম শিক্ষিত হয়ে নিজেদের দেশের মন্ত্রী, রাষ্ট্রদূত এবং উচ্চপদস্থ নানা পদে কাজ করছে। কেনিয়ার স্বাস্থ্যমন্ত্রী তাদের একজন। এছাড়া বহু চিকিৎসক ও প্রকৌশলী শিক্ষা গ্রহণ করেছে তার নির্মিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে।

দুর্ভিক্ষ ও গৃহযুদ্ধ কবলিত এসব দেশ সম্পর্কে পৃথিবীর অন্যান্য দেশগুলো যখন বেখবর তখন আস সুমাইত নিরবে  কাজ করে গেছেন তাদের জন্য।  দুর্ভিক্ষের সময় একটি শিশুর দেখা পেয়েছিলেন তিনি।  তার দেহে হাড্ডি ছাড়া আর কিছু ছিল না।  আস সুমাইত ভেবেছিলেন শিশুটি বাঁচবে না।  তাকে আর খাবার দেয়ার দরকার নেই।

কিন্তু শিশুটির মায়ের চোখে জল দেখে মন কেঁদে ওঠে তার। তিনি বলছিলেন, দাতব্য সংস্থার অর্থগুলো আমার কাছে আমানত।  এই শিশুটির বাঁচার আশা নেই।  আমি তার জন্য এখান থেকে অর্থ খরচ করতে পারব না।  তবে আমি নিজের পকেট থেকে তার জন্য খাবারের ব্যবস্থা করছি।  শিশুটির দৈনিক খাবারমূল্য কুয়েতি মুদ্রায় মাত্র ষোল পয়সা। আস সুমাইতের দেয়া অর্থে খাদ্যের যোগান হয় শিশুটির।  অবশেষে জীবন ফিরে পায় সে।   দশ বছর পর সে পবিত্র কুরআনও মুখস্ত করে।  তার নাম সিদ্দিক কিনানাহ।

টোগোতে একটি রেডিও স্টেশন তৈরি করেছিলেন আস সুমাইত। সেখানে কুরআন প্রচারিত হত। একদিন একজন প্রকৌশলী ফোন করেন সেখানে। জিজ্ঞেস করেন, তোমরা এটা কি গান স¤প্রচার করো? মধুর এই সুর একদম মনের মধ্যে গেঁথে যায়। যদিও এর অর্থ কিছুই আমরা বুঝতে পারি না। তাকে জানানো হয় এটা কুরআনের তেলাওয়াত। মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থ।

প্রকৌশলী কুরআনের অনুবাদ যোগাড় করে পড়তে শুরু করে।  এরপর সে ইসলাম গ্রহণ করে। তার দেখাদেখি তার কোম্পানির আরও অনেক প্রকৌশলী-কর্মচারী আলোকিত হয় ইসলামের আলোয়।

‘তোমাদের কাছে সূরা ইখলাসের মত এত সুন্দর বাণী আছে।  আমাদের কাছে আগে কেন আসো নি? ত্রিত্ববাদের বিশ্বাস বিষ ফোঁড়ার মত বইয়ে বেড়িয়েছি আমরা এতদিন। ’ বলছিলেন সেই প্রকৌশলী।

অনেক গোত্রের লোকেরা ইসলাম গ্রহণের পর কেঁদেছে তাদের পূর্বপূরুষদের কথা মনে করে।  তারা ইসলামের আলো না পেয়েই চলে গেছে অন্ধকার কবরে।

একজন গোত্র প্রধানের গল্প শুনিয়েছেন তিনি।  কুরবানীর মাংস বিতরণ করতে গিয়েছিলেন তাদের কাছে।  গোত্রপ্রধান জানতে চান এরা কী চায়।  তাকে বলা হলো, এরা কিছুই চায় না।  এমনি মাংস বিতরণ করতে এসেছে।  গোত্রপ্রধান অবাক হন।   মসজিদের জন্য জমি প্রদান করে তার পক্ষ থেকে।  একসময় সে আগ্রহী হয় ইসলাম গ্রহণের জন্য।  কিন্তু তার দাবি যে এই মসজিদ নির্মাণের অর্থ দিয়েছেন তার কাছেই সে ইসলাম গ্রহণ করবে।  তাকে বোঝানো হয় তিনি আশি বছর বয়স্ক একজন বৃদ্ধা।  আফ্রিকায় আসা তার পক্ষে সম্ভব না।   কিন্তু তিনি  নাছোড়। অবশেষে তাকে কুয়েতে আনা হয়।  সেই বৃদ্ধার পরিবার বিশালদেহী সেই লোককে দেখে হতবাক।  কুয়েতের আমিরের সাথেও তার সাক্ষাত হয়।

ইসলাম গ্রহণের পর গোত্র প্রধান বলেন,  সূরা ফাতিহা মুখস্থ না করে আমি ঘুমাব না।  এরপর সারারাত জেগে তাকে সূরা ফাতিহা পড়ানো হয়।  পরে তাকে হজ্জেও পাঠানো  হয়।  হজ্জের জনসমাগম দেখে গোত্রপ্রধান খুব অভিভ‚ত হন। আস সুমাইতকে তিনি বলেন, তোমাদের এখানে কত দেশের মন্ত্রী রাষ্ট্রদূত সবাই একরকম পোশাক পরে হজ্জ করে।  অথচ আমি কতদিন কফি খেতে খেতে আমাদের গির্জার পাদ্রীর সুন্দর পোষাক দেখে ঈর্ষন্বিত হয়েছি।  কিন্তু তার মত একটা পোশাক কেনার কথা ভাবতেও পারি নি।  এই গোত্রপ্রধান দেশে ফিরে যাবার পর তার হাতে ৬১ হাজার মানুষ ইসলাম গ্রহণ করে।

যে আলোয় আলোকিত সবাই 

আব্দুর রাহমান আস সুমাইত মানব সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিলেন। তার এই ধর্মীয় চেতনা ও মানবপ্রেম সংক্রমিত হয়েছিল পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের মধ্যেও।  স্ত্রী উম্মু সুহাইব তো তার এই মিশনের সবচেয়ে বড় প্রেরণা। সাংসারিক কাজে তাকে কোনোদিন ব্যস্ত হতে দেন নি। নিজে একাই মানুষ করেছেন সন্তানদের। নিজের পৈত্রিক সম্পত্তিও বিলিয়ে দিয়েছেন এজন্য।

কোনো একবার চিকিৎসার প্রয়োজনে বেশ কিছুদিন কুয়েতে থাকতে হয়েছিল আব্দুর রাহমানকে।  এসময় তিনি ব্যবসা করতে শুরু করেন।  দৈনিক প্রায় এক হাজার কুয়েতি দিনার লাভ হতে থাকে।  উম্মু সুহাইব তাকে বলেছিলেন, সন্তানদের ভবিষ্যত নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না।  তাদের আল্লাহ দেখবেন। আপনি আপনার কাজ নিয়ে ভাবুন।

আস সুমাইতের ছেলেরা সবাই পড়াশোনা করে শিক্ষিত হয়েছেন। বড় ছেলে ডাক্তার হয়েছেন তার মত। দেশের বাইরে পড়াশোনা শেষ করে তিনিও যোগ দিয়েছেন বাবার সাথে। ইউরোপ কিংবা কুয়েতের আয়েশি জীবন ছেড়ে বেছে নিয়েছেন আফ্রিকার সাধাসিধে জীবন। কাজ করেছেন মানুষের কল্যাণে।

মেয়েরাও পিছিয়ে নেই।  বাবার সাথে তারাও ছুটে গিয়েছেন আফ্রিকায়।  বিয়ের সময় স্বামীকে শর্ত দিয়েছেন তাকে দাওয়াতের কাজে যেতে দিতে হবে।  জনসেবার পাশাপাশি অন্ধকারে থাকা মানুষদের দেখিয়েছেন আলোর পথ।

আস সুমাইতের নাতনীও ছোটবেলা থেকে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন নানার কাজে।  মাত্র তেরো বছর বয়সে তিনি আফ্রিকা সফর করেছিলেন।  কোনো কাজের পুরষ্কার হিসেবে এই সুযোগটি দাবি করেছিল নাতনী।

শেষ বয়সে মাদাগাস্কারে থাকতে শুরু করেন আস সুমাইত।  বছরে দশমাস সেখানে আর দু মাস কুয়েতে থাকতেন তিনি।  আয়েশি জীবন ছেড়ে মাদাগাস্কারের অনাড়ম্বর জীবন বেছে নিয়েছিলেন তার স্ত্রীও।  আফ্রিকার মাটি, আফ্রিকার মানুষ সবকিছুর প্রতি একটা ভালোবাসা জন্মে গিয়েছিল তাদের মনে। আস সুমাইত মনে মনে চাইতেন, এখানেই যেন তার মৃত্যু হয়। কিন্তু তা হয় নি।  মৃত্যুর আগে বেশ কিছুদিন অসুস্থ থাকায় কুয়েতে চিকিৎসা নিতে হয় তাকে। ২০১৩ সালের ১৫ আগস্ট পরপারে চলে যান তিনি।

আলোর ধারা বহমান

আফ্রিকায় কাজ করার পাশাপাশি উন্নত দেশগুলোতে সফর করেছেন আস সুমাইত।  সবাইকে উদ্বুদ্ধ করেছেন ইসলামের আলো ছড়িয়ে দেবার জন্য।  তিনি বলতেন, আমরা মনে করি পকেট ভর্তি থাকলেই সুখ।  কিন্তু আসলে সুখ তো মানুষের অন্তরে আল্লাহ দেন।  আল্লাহর ব্যাংকে টাকা রাখুন।  এক টাকায় আল্লাহ আপনাকে সাতশ টাকা দিবেন।  ইসলামের মত অনেক বড় সম্পদ আল্লাহ আপনাকে আমাকে দিয়েছেন।  এর কদর করুন।

আস সুমাইত চাইলে নিজে অনেক ধন-সম্পদ উপার্জন করতে পারতেন।  তা না করে নিজের অর্থও বিলিয়ে দিয়েছেন সেবার জন্য।  বাদশাহ ফয়সাল পুরষ্কারের বিরাট অর্থমূল্য পুরোটা দান করে দিয়েছেন দাতব্য সংস্থায়।

তার মৃত্যুর পর আফ্রিকার অনেকে ভেবেছিল এখন থেকে বুঝি সাহায্য আসা বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু না তা হয় নি।  মানুষের প্রতি তার এই ভালোবাসা ছড়িয়ে দিয়েছেন সন্তানদের মধ্যেও।  তাই তার শুরু করা কল্যাণের ধারা আজও বহমান।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

ShareTweetShare

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরোনো সংখ্যা

মাসিক নবধ্বনি জানুয়ারি ২০১১ সংখ্যা

মাসিক নবধ্বনি জানুয়ারি ২০১১ সংখ্যা

মাসিক নবধ্বনি জানুয়ারি ২০১৭ সংখ্যা

মাসিক নবধ্বনি জানুয়ারি ২০১৭ সংখ্যা

মাসিক নবধ্বনি ফেব্রুয়ারি ২০১৭ সংখ্যা

মাসিক নবধ্বনি ফেব্রুয়ারি ২০১৭ সংখ্যা

মাসিক নবধ্বনি মার্চ ২০১৭ সংখ্যা

মাসিক নবধ্বনি মার্চ ২০১৭ সংখ্যা

মাসিক নবধ্বনি এপ্রিল ২০১৭ সংখ্যা

মাসিক নবধ্বনি এপ্রিল ২০১৭ সংখ্যা

মাসিক নবধ্বনি মে ২০১৭ সংখ্যা

মাসিক নবধ্বনি মে ২০১৭ সংখ্যা

আমাদের সম্পর্কে

যোগাযোগ

সোশ্যাল মিডিয়ায় আমরা

© 2021 নবধ্বনি - Developed by Shabaka IT

No Result
View All Result
  • স্বাগত কলাম
  • প্রচ্ছদ রচনা
  • মুক্তগদ্য
  • গল্প
  • রঙধনু
  • দিনলিপি
  • পুরোনো সংখ্যা

© 2020 নবধ্বনি - Developed by Shabaka IT.

Welcome Back!

Login to your account below

Forgotten Password?

Create New Account!

Fill the forms below to register

All fields are required. Log In

Retrieve your password

Please enter your username or email address to reset your password.

Log In

Add New Playlist