ডাক্তার কাওসার বিরক্ত হচ্ছেন ভদ্রলোকের কথায়। অন্য ডাক্তারের তৈরি পুরানো রিপোর্ট দেখে তিনি চিকিৎসা করেন না, চিকিৎসার জন্য আবার নতুন করে টেস্ট করাতে হবে, কথাটা বারবার বলার পরও লোকটা নাছোড় বান্দার মতো বলছে, ‘স্যার, একটু দেখেন না! টেস্ট তো একই, এই দু’দিন হলো সবে করিয়েছি, নতুন করে আবার করাতে গেলে অনেকগুলো টাকা লাগবে, এত টাকা জোগাড় করা আমার পক্ষে সম্ভব না, স্যার! দেখেন না একটু!’
লোকটার চেহারায় বেশ আভিজাত্যের ছাপ, শিক্ষিতও মনে হচ্ছে, তারপরও কেন বারবার একই আবদার করছে ডাক্তার কাওসার বুঝতে পারছেন না। এবার একটু শক্ত কণ্ঠে তিনি ভদ্রলোককে বললেন, ‘প্লিজ আঙ্কল, বাইরে অনেক ভিজিটর দাঁড়িয়ে আছে, আপনার পেশেন্টকে দেওয়ার মতো অতো সময় আমার হাতে নেই। স্যরি, আপনি এখন আসতে পারেনÑযে টেস্টগুলো দিয়েছি, ওগুলো করিয়ে আগামী সপ্তাহে রিপোর্টসহ আবার দেখা করবেন। টাকা-পয়সা ব্যাপার না, রোগ তো আল্লাহই দিছেন, আল্লাহপাকই ব্যবস্থা করে দেবেন। ব্যবস্থা না হলে ঘরে বসে আল্লাহর নামে তসবি জপেন, ডাক্তার দেখাবার দরকার নেই।’
দুঃখে কি অপমানেÑবলা মুশকিলÑভদ্রলোকের চেহারার রঙ পরিবর্তন হয়ে গেল। এতক্ষণের অনুনয়মাখা মুখে এবার বেশ খানিকটা রাগত ভাব ফুটে উঠল। সঙ্গের মহিলাকে নিয়ে তিনি বেরিয়ে এলেন চেম্বার থেকে। আজকের মতো এতটা অপমানিত তিনি জীবনে বোধহয় আর কখনো হননি। টেস্ট তো সামান্য ক’টা টাকার ব্যাপার, বরং টাকা জিনিসটাই তাঁর কাছে সামান্য, জীবনভর এই জিনিসটাকে তিনি থোড়াই কেয়ার করে এসেছেন, আজ এই সামান্য জিনিসের জন্যই তাঁকে এতটা অপমানিত হতে হলো! এমনকি তাঁর কারণে মহান আল্লাহ পাকের শানেও ডাক্তার মশকারা করতে ছাড়ল না।
এসেছিলেন স্ত্রীকে নিয়ে। স্ত্রীর হার্টে সমস্যা দীর্ঘ দিন ধরে। সিলেটের বড় বড় সব ডাক্তার দেখানো শেষ। কিছুতেই কিছু হয় না। ডাক্তার কাওসার এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ। ভালো সুনাম আছে তাঁর। সিলেটে সপ্তাহে একদিন বসেন। মাস কয়েক ধরে যে ডাক্তারের চিকিৎসা নিচ্ছিলেন, তাঁর পরামর্শেই ভদ্রলোক ডাক্তার কাওসারের কাছে এসেছিলেন। আগের ডাক্তার বলেই দিয়েছে, ‘আমার করা টেস্ট-রিপোর্ট দেখলেই ডাক্তার কাওসার চিকিৎসা করতে পারবেন, কিন্তু তাঁর নীতি এটা না। তাঁর নিজস্ব ডায়াগনস্টিক সেন্টারে টেস্ট করিয়ে তিনি রিপোর্ট দেখেন। বাইরের টেস্ট অ্যালাউ না। তারপরও আপনি অনুরোধ করে দেখতে পারেন। হয়তো দয়া হতে পারে।’
ডাক্তারের এই কথার ভিত্তিতেই ভদ্রলোক অনুরোধ করেছিলেন ডাক্তার কাওসারকে। বিনিময়ে একরাশ অপমান নিয়ে ফিরলেন।
ভদ্রলোক প্রচÐ আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন মানুষ। জীবনভর শিক্ষকতা করেছেন। হাইস্কুলের মাস্টার ছিলেন। শেষ বয়সে এসে এই আত্মমর্যাদায় খানিকটা আঘাত লাগাতে শিক্ষকতাই ছেড়ে দিয়েছেন। এলাকার ক্ষমতাসীন দলের এক নেতা তাঁর স্কুলের এক ছাত্রকে একদিন অন্যায়ভাবে থাপ্পড় মেরেছিল, ভদ্রলোক প্রতিবাদ করতে যাওয়ায় তাঁকেও অপমান করে। ভদ্রলোক জানেন, স্কুল কর্তৃপক্ষকে বলেও এর কোনো ন্যায় বিচার পাওয়া যাবে না, নেতা বলে কথা! তাই কাউকে কিছু না বলে পরদিনই স্কুল থেকে অব্যাহতি নেন।
স্ত্রীর হার্টের সমস্যা খুবই নাজুক। ডাক্তার কাওসার ছাড়া আর উপায়ান্তরও নেই। এদিকে টেস্ট করাবার মতো টাকাও নেই তাঁর কাছে। আগামী সপ্তাহে নতুন করে আবার ডাক্তারের ভিজিটও দেওয়া লাগবে ১৫০০ টাকা। ভদ্রলোক ধার-কর্জ করে হলেও কেবল স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে পরের সপ্তাহে আবার ডাক্তার কাওসারের কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
দুই.
ভদ্রলোক বিদায় হবার পর থেকে ডাক্তার কাওসারের চোখে একটা চেহারা বারবার ভেসে উঠছে। স্মৃতির বদ্ধ কপাটগুলো খটখট করে খুলে যাচ্ছে এক এক করে। রোগী দেখায় কিছুতেই মন বসাতে পারছেন না। ধুলোমলিন শৈশবটা খাবলিয়ে ধরছে তাঁকে। এই সিলেটরই তো কোনো এক বস্তিতে তিনি বেড়ে উঠেছেন। শৈশব আর কৈশোরের পুরোটা সময় এখানেই কাটিয়েছেন। বাবা নেই, মা এ-বাসা ও-বাসা ঘুরে ভুয়ার কাজ করে দু’বেলা খাবার জুটাতেন। কাওসার যখন বইয়ের ব্যাগ নিয়ে পাঠশালা যাওয়ার বয়েস, তখন মা তাঁকে স্কুলে যাবার বদলে কাজে লাগিয়ে দেন। আজকের ডাক্তার কাওসারকে তখন কয়সর নামে ডাকত সবাই। বস্তির পাশেই ছিল একটি হাইস্কুল। স্কুলের একজন শিক্ষক আবদুল বাসেত। সবাই বাসেত মাস্টার বলে ডাকে। একদিন ছোট্ট কয়সরকে কাজ করতে দেখে বাসেত মাস্টার তাকে কাছে ডেকে বললেন, ‘খোকা, তুমি স্কুলে পড়বে?’
‘পড়তে হইলে মা বলসে ম্যালা টেকা লাগব, আমর গরিব, এত টেকা কই পামু?’
‘কোনো টাকা লাগবে না বাছা, যা লাগে আমি দেব, তুমি বলো পড়তে চাও কি-না?’
‘হ, চাই।’
‘তাহলে চলো।’
ব্যাস। বাসেত মাস্টার সেদিনই তাকে ভর্তি করে দেন পাঠশালায়। পড়াশোনায় একাগ্রতা আর মেধাবী হবার কারণে কয়সরের অনেক সুনাম হয় স্কুলে। মায়েরও এতে আগ্রহ জন্মে। পাঠশালা পাশ করার পর বাসেত মাস্টার নিজের স্কুলে নিয়ে আসেন তাকে। এখন আরও নিবিড় তত্ত¡াবধানের সুযোগ পান তিনি। কয়সরকে বড় হবার স্বপ্ন দেখান। শিখিয়ে দেন কীভাবে সব বাধা জয় করে বড় হতে হয়।
ক্লাস এইটের পরীক্ষা দেওয়ার পর কয়সররা চলে যায় সিলেট থেকে। বাসেত মাস্টারের কাছ থেকে বিদায় নিতে হয় তাকে। তারপর মায়ের সঙ্গে ঢাকা এসে তিথু হয়। ঢাকা আসার পর কয়সর দমে থাকে না। বাসেত মাস্টারের দেখানো স্বপ্ন ও সাহস নিয়ে নিজের পড়াশোনা অব্যাহত রাখে। অদম্য ইচ্ছাশক্তি আর মেধার জোরে বস্তির সেই টোকাই কয়সর থেকে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে আজ তিনি দেশসেরা ডাক্তার কাওসার। কিন্তু সময়ের এই ব্যবধান তাঁর বড় হবার স্বপ্নদ্রষ্টা বাসেত মাস্টারকে কবে যে স্মৃতির অতলে ডুবিয়ে দিয়েছে, ডাক্তার কাওসার টেরই পাননি।
চেম্বারে আসা সেই ভদ্রলোককে দেখে আজ বাসেত স্যারকে ভীষণ মনে পড়ছে ডাক্তার কাওসারের। লোকটার চেহারা একদম বাসেত স্যারের মতো। বাসেত স্যারের দাঁড়ি নেই, তার দাঁড়ি আছেÑএই যা পার্থক্য। স্যার কি বেঁচে আছেন এখনও?
তিন.
ভদ্রলোক বসে আছেন ডাক্তার কাওসারের চেম্বারে। টেস্টের রিপোর্ট দেখাতে এসেছেন। টেস্টের টাকা জোগাড় করতে অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হয়েছে তাঁকে। ধার-কর্জ পাননি কোথাও। অগত্যা চড়া সুদে এক মহাজনের কাছ থেকে ঋণ এনেছেন।
ডাক্তার কাওসারের মুখ আজ হাসি হাসি। ‘আপনাকে দেখতে আমার একজন স্যারের মতো লাগে, আঙ্কল। বাসেত স্যার। খুব ভালো মানুষ। আপনাদের এই শহরেরই লোক। রায়নগর হাইস্কুলের সহকারী শিক্ষক ছিলেন। এই যে আজকে আপনাদের সেবা করতে পারছি আমি, এই আমাকে ছোট্ট বেলা গড়ে দিয়েছেন সেই স্যার। স্যারের অনেক অবদান আমার ওপর। কিন্তু আফসোস, ব্যস্ততার কারণে স্যারের একটু খোঁজও নিতে পারিনি আর। জানি না, স্যার বেঁচে আছেন নাকি মারা গেছেন।’
ভদ্রলোকের চেহারাটা তখন নিচের দিকে ঝুঁকানো। ডাক্তার কাওসারের দৃষ্টি সে পর্যন্ত যাবে না। গেলে তিনি দেখতে পারতেন আত্মমর্যাদাবান একজন শিক্ষকের চোখে পৃথিবীর সমস্ত ঘৃণা এসে জড়ো হয়েছে। ঘৃণার সঙ্গে জলের সংমিশ্রণ। অশ্রæটা কোনোমতো সংবরণ করে ভদ্রলোক তাড়া দিলেন ডাক্তারকে, ‘আমার প্রেসক্রিপশনটা রেডি হয়ে গেছে স্যার? খামোখা আমার সঙ্গে গল্প করে সময় নষ্ট করছেন। বাইরে আপনার অনেক ভিজিটর অপেক্ষমান। আমারও একটু তাড়া আছে। জলদি করলে ভালো হয়।’
ডাক্তার কাওসার আমলে নিলেন তাঁর কথা, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, তাই তো! অনেক দেরি হয়ে গেল। নিন, অষুধ লিখে দিয়েছি, ওগুলো নিয়মিত চলবে, আগামী মাসে আবার দেখা করবেন। আসুন। ধন্যবাদ।’
প্রেসক্রিপশন হাতে ডাক্তার কাওসারের চেম্বার থেকে দ্রুত বেরিয়ে গেলেন ভদ্রলোক। যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলেন তিনি।
ডাক্তার কাওসার কোনোদিন জানতেও পারবেন না, চরম আত্মাভিমানী এই লোকটাই তাঁর প্রিয় বাসেত স্যার, যাঁর কাছে তাঁর আজকের সমস্ত যশ-খ্যাতি আর বিত্ত-বৈভব ঋণী।
জুন ২০১৮