ছোট হামীদ। বয়স আর কত হবে, বড়জোড় সাত বা আট। স্কুলে পড়ে, আর সন্ধ্যার সময় মসজিদে পড়তে যায়, রাতে থাকে, গ্রামের অনেক ছেলে রাতে মসজিদের ইমাম সাহেবের কাছে পড়ে। মসজিদের ইমাম অনেক ভালো মানুষ, গ্রামের যুবক বৃদ্ধ থেকে শুরু করে শিশুরাও পর্যন্ত তাকে শ্রদ্ধা করে। সেই ছাত্র জীবন থেকে তিনি এই মসজিদের ইমাম। সবাই তাঁকে এলাকার অভিভাবক মনে করে।
হামীদের স্মরণশক্তি প্রখর, ইমাম সাহেব যা বলেন তাই মুখস্থ করে ফেলে। ইমাম সাহেব এজন্য তাকে মুহাব্বত করেন। এতোমধ্যে সে অনেক কিছু শিখে ফেলেছে। অনেক নবি-রাসুলের ঘটনা এখন তার জানা। যেকোনো ঘটনা খুব সহজেই হামীদের মুখস্থ হয়ে যায়।
অনেক ভালো ছেলে হামীদ। মা-বাবার কাজে সহযোগিতা করে। বিকালে ঘাস কাটতে যায় গরুর জন্য। হামীদও ছোটখাটো রাখাল। রাখাল গাছে উঠে বাঁশি বাজায়। তাদের বাঁশির সুর বাতাসে বর করে ছুটে যায় বহুদূর। হামীদের এই বাঁশির সুর অনেক ভালো লাগে। সে মুগ্ধ হয়ে শোনে। ধান ক্ষেতের আইলে বসে সে বাঁশির সুরের সাথে তাল মিলিয়ে গানের সুর ধরে।
হামীদদের বাড়িটা বেশ সুন্দর। যেন ক্যালেন্ডারে আটকানো কোনো ছবি। বাড়ির সামনে দিয়ে বয়ে গেছে এঁকেবেঁকে একটি ছোট খাল। হামীদ অনেক দিন খালের পাড়ে বসে আলসে-সময় কাটায়। তবে হামীদের এগুলো তেমন ভালো লাগে না। তার মূল আকর্ষণ বনের মধ্যে ঘুরে বেড়ানো, যা তাদের বাড়ির পশ্চিমে অবস্থিত। ঘন ঝোঁপঝাড় চিরে যাওয়া আকাঁবাকা পথে সে প্রায়ই ঘুরে বেড়ায়। চলে যায় বনের গহীন অরণ্যে। বনের গভীরে দেখতে পাওয়া যায় প্রাকৃতিক নিগূঢ় সৌন্দর্য। চারদিকে বিরাটাকার বৃক্ষ উদ্বাহু আকাশের দিকে উঠে গেছে। গুল্ম-লতা ছড়িয়ে আছে চারপাশে। বনফুল আর অজান্তা পাতার গন্ধে নেশা ধরে যায়। আবেগে চোখ বন্ধ হয়ে আসে হামীদের। সে পাখিদের খুব ভক্ত। পাখির বাসা পেলে পরম স্নেহে হাত বুলিয়ে দেয় সদ্য ফুটে ওঠা পাখির ছানাগুলোকে। পাখিদের সাথে তার আলাদা একটা সম্পর্ক। তার অন্তরে রয়েছে পাখিদের প্রতি কোমল ভালোবাসা। কোথাও পাখির ছানা দেখলে আদর করতে মন চায়। শৈশবের দিনগুলো এভাবেই কাটতে থাকে হামীদের।
এরই মধ্যে হামীদ আমপারা শেষ করে কুরআন শরিফে সবক নেয়। মা-বাবা খুশি হয়ে মসজিদের সবাইকে মিষ্টি খাওয়ায়। ইমাম সাহেবকে অনেক উপহার দেয়।
পাড়ার সবাই জেনে যায় হামীদ কুরআন শরিফ নিয়েছে। নিজেকে অনেক বড় মনে হচ্ছে তার। নাজেরা দ্রুত শেষ করে তাকে হিফজ শুরু করতে হবে। তার আব্বু বলেছেন হিফজ শেষ করলে সাইকেল কিনে দেবেন। কিন্তু তার পূর্বেই তাকে ঢাকা চলে যেতে হলো। তার বড়ভাই ঢাকা পড়ে, সে তাকে ঢাকায় নিয়ে আসলো। ঢাকা পড়লে দ্রুত হাফেজ হতে পারবে। মা-বাবা খুশি-মনে ছেলেকে ঢাকা পড়াতে রাজি হলেন।
হামেদ এই প্রথম ঢাকা এলো। এর আগে কখনো ঢাকা আসেনি। ঢাকার বড় বড় বিল্ডিং দেখল সে এই প্রথম। ঢাকার সবকিছুই যেন বড়, বড় বড় রাস্তা বড় বড় বিল্ডিং। তার বড়ভাই ছোট এক মাদরাসায় তাকে ভর্তি করিয়ে দিল। মাদরাসাটা বেশ পরিপাটি। মাদরাসার সামনে ছোট একটি মাঠ, ছাত্রদের খেলার জন্য বানানো হয়েছে।
মাঠের পাশে একটি বাগান, বাগানে অনেক ফুল ফোটে, গাঁধা আর গোলাপ ফুলের ঘ্রাণে মৌ মৌ করে আশপাশ। সবচেয়ে আকর্ষণীয় হচ্ছে মাদরাসার পেছনে ছোট একটি শিউলি ফুলের গাছ। প্রতিদিন সকালে শিউলি গাছের তলায় ফুল পড়ে সাদা হয়ে থাকে। এই দৃশ্য দেখে হামীদের গ্রামের কথা মনে পড়ে, সকালে ঘুম থেকে উঠে সে শিউলি ফুল কুঁড়াতে যেত। আর এখন এসব স্মৃতি মনে হয় তার। অনেক সময় খারাপও লাগে, তবুও হামীদ দমে যাওয়ার পাত্র না। তাকে মা-বাবার স্বপ্ন পূরণ করতেই হবে।
হামীদকে প্রথমে কায়দা দেয়া হয়, কয়েকদিনেই হামীদ কায়দা আমপারা শেষ করে আবার নাজেরা নিয়ে ফেলে। হুজুর হামীদের মেধা বুঝে হিফজে দিয়ে দেন।
মিষ্টি রোদ-ছড়ানো শাতের সকাল, ভোর থেকেই কয়েকটা দোয়েল পাখির কিচিরমিচির শোনা যাচ্ছে। হামীদ আজ অনেক খুশি। পূর্বে এর চেয়ে বেশি আনন্দিত হামীদ আর কোনোদিন হয়নি। আজ তার মা-বাবার একমাত্র স্বপ্ন পূর্ণ হয়েছে। হামীদ হাফেজ হয়েছে। ভোরেই ফোন করে বাড়িতে জানিয়ে দিয়েছে। তার মা তো খুশিতে কেঁদে ফেলার অবস্থা। তার বাবা পুরো এলাকার সবাইকে দাওয়াত করে খাওয়ান। সবাই জেনে যায় হামীদ হাফেজ হয়েছে। অনেকে তাদের ছেলেকেও ঢাকা পাঠানোর নিয়ত করে।
হামীদ বাড়িতে এসেছে। সেই ছোট হামীদ এখন অনেক বড় হয়ে গেছে। ততদিনে অনেক কিছুই পাল্টে গেছে। হামীদরা গ্রাম ছেড়ে চলে এসেছে। তারা প্রায় শহরের মতো এক জায়গায় থাকে। এখানকার পরিবেশ অনেকটা শহরের মতো। বাসার কাছেই হাসপাতাল। আশপাশে বড় বড় বিল্ডিং। শুধু হাসপাতালের পেছনে একটু খোলা জায়গা। ঝোপঝাড়ে-ঢাকা কয়েকটা পুকুর। মাঝে কয়েকটি কলাগাছ। এই জায়গাটা একটু অন্যরকম। কেমন গুমোট। থমথমে পরিবেশ৷
কয়েকদিন যাবত হামীদ খুব ব্যস্ত। আবদুল্লাহ মাহমুদ নজীবের একটি বই ‘বৃষ্টিমুখর রৌদ্রমুখর’ পড়া শুরু করেছে। এটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত যেন তার আর কোনো কাজ নেই। দিন-রাত শুধু এটাই তার কাজ। এই বইয়ে একটি অধ্যায়—‘বনের পাখিরে কে চিনে রাখে’—সে খুব মনযোগ দিয়ে পড়ে। বন আর পাখি দুটোই তার কাছে খুব প্রিয়। ভালোলাগা জিনিসগুলোর মধ্যে একটি। এখান থেকে হামীদ পরিচিত-অপরিচিত অনেক পাখির নাম জানতে পারে। ডাহুক নামে একটা পাখি তাকে খুব আকর্ষণ করে। কিন্তু মনে করতে পারছে না, পাখিটাকে কোথাও দেখেছে কি না। শুরু হয় ডাহুক নিয়ে গবেষণা, তার মাকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারে তাদের বাসার সামনে ঝোপঝাড়ে-ঢাকা যে জায়গাটা আছে সেখানে ডাহুক দেখতে পাওয়া যায়। এখানে ডাহুকের বাসাও আছে। হামীদের মা বললেন, আগামীকাল সকালে তোকে ডাহুক দেখাব। সত্যিই সকালে তার মা ডাহুক দেখে তাকে ডাক দেন, কিন্তু হামীদ যেতে যেতে ডাহুক ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে।
তিনদিন যাবত হামীদ ঘুরছে কিন্তু ডাহুকের আর দেখা পাচ্ছে না। তিনদিন পরের কথা; হামীদ এশার নামাজ পড়ে শুয়ে পড়ে, রাতে আল্লাহ তাআলা তাকে স্বপ্নের মাধ্যমে ডাহুক দেখিয়ে দেন। সকালে ঘুম থেকে উঠে হামীদ খুব খুশি, রাতে সে স্বপ্নে ডাহুক দেখেছে।
আজও সকালে তার মা ডাহুক দেখার জন্য ডাক দেন। আজ হামীদ সরাসরি ডাহুক দেখে ফেলে, কত সুন্দর দুটো ডাহুক, ঝোপের উপর হেঁটে হেঁটে কী যেন খাচ্ছে। পেছনে তাদের ফুটফুটে চারটি বাচ্চা। কত সুন্দর একটি ছোটখাটো পরিবার। কত সুখে তারা ঘুরে বেড়াচ্ছে। এত সুন্দর পাখি সে আগে কখনো দেখেনি। পাখির ছানাগুলোকে আলতো করে ছুঁতে ইচ্ছা করছে তার। এটা তার পুরানো অভ্যাস। শৈশব থেকেই সে পাখি-প্রিয়। হামীদ দীর্ঘক্ষণ ধরে দেখতে থাকে পাখিদের এই খেলা। দেখতে দেখতে একসময় ডাহুকগুলো হামীদকে ফাঁকি দিয়ে ঝোপঝাড়ের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে। প্রতিদিন সকালে ডাহুকগুলো খাবার খেতে ঝোপঝাড়ের উপর আসে, আর হামীদ তাদের দেখে। দেখে খুব আনন্দ পায়। ধীরে ধীরে ডাহুকের ছানাগুলো ক্রমশ বড় হচ্ছে।
এখন তারা উড়তে ও আলাদা থাকতে শিখেছে। ততদিনে ছানাগুলোর প্রতি হামীদের মায়া জন্মে গেছে। এখন রোজ ডাহুকের ডাক শোনে হামীদের ঘুম ভাঙে।
একদিনের কথা, খুব গরম পড়েছে সেদিন। ভোরে হামীদের ঘুম ভেঙে যায়। ফজরের নামাজ পড়ে সে ডাহুক দেখতে যায়। কিন্তু আজ সে ডাহুক দেখতে পেল না। দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও কোনো লাভ হলো না। হামীদের অনেক কষ্ট লাগল। সে প্রতিদিন ডাহুক দেখতে আসে, আজ দেখতে না পেয়ে মন বিষণ্ণ করে চলে আসে। তার মনে আশংকা জাগে, শিকারি কি ডাহুকগুলো ধরে নিয়ে গেছে? আশপাশে তো অনেক শিকারি।
সেদিন দুপুরে, প্রচণ্ড গরম, ফ্যানের বাতাসও অসহ্য লাগছে। মনে হচ্ছে সমস্ত গরমের মূল যেন এই হতচ্ছারা ফ্যানটা। বাইরে বের হলে গা ঝালসে যাচ্ছে। তবুও হামীদ বাহিরে বের হয়, যদি ডাহুকগুলোর দেখা পায়। বের হয়ে তার চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। দুজন শিকারি ডাহুকগুলো ধরার জন্য ফাঁদ পেতে বসে আছে। হামীদ মনে মনে দুআ করতে থাকে যেন ডাহুকগুলোকে ধরতে না পারে। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে ডাহুক দুটো ধরে ফেলে। হামীদ কিছুই বলতে পারল না। তার আদরের ডাহুক দুটো তার চোখের সামনেই ধরে নিয়ে গেল শিকারিরা।
কত সুখের একটি সংসার নিমিষেই ভেঙে খান খান হয়ে গেল। হামীদ এতে বিরাট আহত হলো। এমন কষ্ট পেল যে পূর্বে কোনোদিন এত কষ্ট সে পায়নি। সে ভাবতে থাকে মানুষ কেন এত নিষ্ঠুর, কেন তারা বুঝে না, পাখিদেরও তো বেঁচে থাকার অধিকার আছে। তাদের হয়রানি করা কি আমাদের জন্য ঠিক? শোনা যায়, এখানে একসময় নাকি অনেক ঝোপঝাড় ছিল। এবং হরেক রকমের পাখি ছিল। কিন্তু এখান সেই ঝোপঝাড়ের জায়গায় স্থান করে নিয়েছে উঁচু উঁচু বিল্ডিং। সেই সাথে পাখিরাও বিদায় নিয়েছে এই জায়গা থেকে। শুধু দুটো ডাহুক ছিল আজ সেগুলোও ধরে ফেলে জায়গাটা পাখি-শূন্য হয়ে গেল। যেন একটি বিরান ঝোপঝাড়। যেখানে নেই কোনো পাখির কিচিরমিচির, নেই কোনো কোলাহল।
শিক্ষার্থী, জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া, সাত মসজিদ, মুহাম্মাদপুর, ঢাকা
অক্টোবর ২০২০