ছাত্রদেরকে আল মাহমুদের ‘একুশের কবিতা’ ছড়াটি পড়তে দিয়ে ক্লাসরুমের চেয়ারে মাথা ঠেকিয়ে আনমনে দোল খাচ্ছে আরিফ। লজ্জার মাথা খেয়ে স্কুলের মুতি মাস্টারের কাছে টাকা ধার চেয়েছিল, সে-ও কি না মুখের ওপর ‘নেই’ বলে দিল। বিপদের সময় মানুষ এতটা নিষ্ঠুর হতে পারে? এত অনুরোধের পরও মুতি মাস্টার কীভাবে না করলো! এ রকম সাত-পাঁচ চিন্তা আরিফের মাথায় কানামাছি খেলছে। বাড়ি যাওয়ার মতো মুড নেই। পকেটে অন্তত দুটো কানা-কড়ি থাকলে আর কিছু না হোক দিনশেষে ভাই-বোনের হাতে দুটো চকলেট তো তুলে দেওয়া যেত। ভাই-বোন দুটো হয়তো রোজকার মতো অপেক্ষা করে বসে আছে। ওরা ব্রেড-চিপস না পেলে ঘুমোবে না। তবু যেতে তো হবেই। মা-ও অধীর অপেক্ষায় পথ চেয়ে বসে থাকবেন।
ইহলোকের মায়া ত্যাগ করে বছর তিনেক আগে আরিফের বাবা পাড়ি জমান পরপারে। সংসারের সম্পূর্ণ ভার এখন আরিফকে বহন করতে হয়। আজ তার বাবার মৃত্যুদিবস। এ দিনটি এলে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো বেদনা ঢেউ খেলে তার মনে। গা শিউরে ওঠে। ভাই-বোন আর মমতাময়ী মা-ই এখন তার একমাত্র আশা-ভরসা। ওদের নিয়ে তার সাত রঙে আঁকা স্বপ্নের ভুবন। শত যন্ত্রণার মধ্যেও পরিবারের একটু মায়ার দোলা তাকে ধীরে ধীরে করে তোলে কর্মজীবী। শিমুলতলা বেসরকারি প্রাইমারি স্কুলে চাকরি করার দু’বছর পেরিয়ে গেছে তার। মাস শেষে যে ক’টা টাকা পায়, তা দিয়ে কোনোমতে কেটে যায় তাদের দিনকাল। দুয়েকটা টিউশনি পেলে হয়তো চাপ কিছুটা কম হতো, কিন্তু এই গ্রামে টিউশনি পড়াবে কে? হোঁচট খেতে খেতে এই তিন বছরে বাধা ডিঙিয়ে সামনে বাড়ার একটা মানসিকতা তৈরি হয়ে গেছে আরিফের। ভাই-বোনের যে কোনো আবদার এখন যে কোনো উপায়ে সে পূরণ করার চেষ্টা করে।
এই তো মাস চারেক আগের কথা, ছোটবোন তাহিরা আবদার করেছিল একজোড়া জুতো আর জামা কিনে দেওয়ার জন্য। বন্ধু-বান্ধবের কাছে টাকা না পেয়ে, পাড়ার মকবুল চাচার কাছ থেকে এক হাজার টাকা ধার করে বোনটির আশা পূরণ করেছে সে। আজও সেই দেনা পরিশোধের কুওত হয়নি। মকবুল মিয়া পরহেজগার আল্লাহওয়ালা মানুষ। মানুষের উপকারে নিজের সর্বস্ব বিলীন করতে তিনি এক পায়ে খাড়া থাকেন। তাই হয়তো টাকার জন্য তেমন চাপাচাপি করছেন না। কিন্তু এভাবে আর কতদিন? এক মাসের কথা বলে গড়িয়ে গেল চার-চারটে মাস।
আজ বাড়ী থেকে বেরুতেই হঠাৎ মকবুল মিয়ার সঙ্গে আরিফের দেখা। মকবুল মিয়ার সামনে পড়লে আরিফের চোখ-মুখ নিজের অজান্তেই বিকেলের হেলে যাওয়া সূর্যের মতো লাল হয়ে ওঠে। সে লজ্জাবনত হয়ে কুশল বিনিময় সেরে রওয়ানা দিল স্কুলের দিকে। স্কুলে আজ বেতন পাবার তারিখ। কিন্তু বেতন নিয়ে চলছে বড্ড গÐগোল। কবে যে এর সমাধান হয় কে জানে! এদিকে পাড়ার মুকিত চাচার দেনা পরিশোধের তারিখ গড়িয়ে গেছে। মুকিত মিয়ার দোকান থেকে আরিফ সংসারের সকল খরচপাতি চালায়। মুকিত মিয়ার সঙ্গে তার চুক্তি হলো, সে মরুক কিংবা বাঁচুক, প্রতিমাসের শেষ তারিখে পাওনা পরিশোধ করে দেবে। মুকিত মিয়ার পাওনা পরিশোধ করার দিন ছিল গতকাল। কিন্তু পরিশোধ করতে পারেনি। কথার বরখেলাপি আরিফের মোটেও পছন্দ না। আজও বেতন পাবে না, ভাবতেই কেমন যেন তার মনটা দুমড়ে এতটুকুন হয়ে যায়।
স্কুল শেষ করে আল্লাহর ওপর ভরসা করে বাড়ির উদ্দেশে রওয়ানা হয় আরিফ। যাবার পথে শিমুলতলা জামে মসজিদে ওঠে। মসজিদের পাশেই গোরস্তান। গোরস্তানে তার বাবা চিরশায়িত। মৃত্যুবার্ষিকীকে উপলক্ষ করে আরিফ দু’রাকাত নফল নামাজ আদায় করে। নামাজ শেষে কবরের পাশে দাঁড়িয়ে চোখের পানি ফেলে কাঁদে, দুরুদ শরিফ পাঠ শেষে দোয়া করে বাবার জন্য। ভেভতরটা খানিক হালকা লাগে। আগে কখনও এ রকম শান্তির সুবাতাস তার হৃদয়কে আন্দোলিত করেছে বলে তার মনে নেই। সে ভাবছে, এই প্রশান্তির কারণ হয়তো নামাজ। মুনাজাত শেষে লম্বা একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে, রওয়ানা হয় বাড়ির দিকে। মসজিদ থেকে কয়েক কদম হাঁটলেই মহরম জমিদারের কলাবাগান, তারপর দু’চালা টিনসেড বাড়িটা আরিফের। মাত্র দু’মিনিটের পথ। কিন্তু এই দু’মিনিটের পথটা তার কাছে দু’বছরের পথ মনে হতে লাগল। বোধ হলো, পেছন থেকে কেউ তাকে টেনে ধরেছে, সামনে এগোতে দিচ্ছে না। অনেক কষ্টে পথ এগোচ্ছে সে। মহরম জমিদারের বাড়ির কছে আসতেই আবারও মকবুল মিয়ার সঙ্গে দেখা। আরিফের চোখ-মুখে বিষণœতার ছাপ। যেন কালবোশেখী ঝড় লÐভÐ করে দিয়েছে। সে ভাবে, যদি টাকার কথা বলে দেন মকবুল মিয়া। সালাম দিয়ে নিচের দিকে মাথা নুইয়ে মকবুল মিয়ার মুখোমুখি দাঁড়ায় সে। মকবুল মিয়া স্বাভাবিকভাবে সালামের জবাব দিয়ে আগের মতোই সোজাসাপ্টা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী রে বাবা আরিফ, কেমন আছিস?’ সে চমকে ওঠে জবাব দেয়, ‘এই তো চাচা, ভালোই।’
‘আজ তোকে বড় চিন্তিত দেখাচ্ছে, কারণটা কী? সদাই কোথায়?’ (স্কুল থেকে ফেরার পথে আরিফের হাতে খরচপাতির একটা ব্যাগ থাকে, এটা মকবুল মিয়া জানেন।)
আরিফের চোখে জলের ছলছলানি। চোখের জল দেখে মকবুল মিয়ার বুঝতে বাকি রইল না, আরিফের হাতে টাকা-পয়সা নেই। আরিফ বিষণ্ণতার ঢেঁকুর উগলে কিছু বলবে, তখুনি মকবুল মিয়া পকেট থেকে পাঁচশো টাকার একটা নোট হাতে ধরিয়ে বললেন, ‘যা বাবা, বাজার থেকে সদাই নিয়ে আয়!’ আরিফ বিস্ময়ে আনন্দে অভিভূত হয়ে বলে, ‘কিন্তু…!’ মকবুল মিয়া দরদমাখা কণ্ঠে বলেন, ‘কোনো কিন্তু নয়, এগুলো দিয়ে আপাতত সদাইপাতি কিনে আন। টাকা হাতে পেলে পরিশোধ করে দিবি নে। বাড়িতে তোর মা, ভাই-বোনেরা না খেয়ে আছে হয়তো। আর হ্যাঁ, কাল সকালে আমার বাড়ি আসবি, কথা আছে…।’
আরিফের চোখ থেকে দু’ফোটা জল গাল বেয়ে মাটিতে পড়ে, সে জলে মিশে আছে মকবুল মিয়ার প্রতি অনিঃশেষ কৃতজ্ঞতা আর প্রার্থনা।
হুসাইন আল হাফিজ সিলেটের নবীন লেখক
ডিসেম্বর, ২০১৮ সংখ্যায় প্রকাশিত