বাড়ি থেকে দক্ষিণের পথটি ধরে সোয়া মাইল হাঁটলে স্কুলঘর। তার পূব পাশেই আমাদের ধানি জমি। এ গাঁয়ের সবটা জুড়ে তালুকদার বাড়ির আলাদা একটা যশ-খ্যাতি আছে। এককালে নাকি তালুকদারি ছিল আমার পূর্বপুরুষের। এসব শোনা যায় লোকমুখে। মোল্লা কাকা আর নছিমন দাদিই মাঝে মাঝে বলতেন এসব। তাঁদের মৃত্যুর পর আমার সঙ্গে আমাদের তালুকদারি নিয়ে গল্প করার আর কাউকে পাইনি তেমন। তবে দাদার আমল থেকে আমাদের পয়সাকড়ি একেবারেই যে শেষ হতে চলেছেÑতা সবাই স্বীকার করে নেয় ঠিকঠাক। অতকিছুর পরও সেকালে আমার দাদা-পরদাদারা যে বিলেত-ফেরত শিক্ষিত মৌলানা ছিলেনÑসে তো আর ঢাকবার নয়। ও দিয়েই চলছে আজকাল। পড়ুয়া ঘরের পোলাপান আমি। তালুকি নেই তো কী? তালুকদার লকব তো আছে। তালুকদারি যে ছিল এককালে, স্কুলমাঠের ওপারে সেই দেবদারু গাছটিই যেন তার দর্পণ। সে গাছ দেখিয়েই বাবা তাঁর গপ্প ফাঁদেন আমার সঙ্গে। তাঁর ইতিহাস; আমার পূর্বপুরুষদের স্মৃতিচিহ্ন।
‘বুঝলি বাবা! এই দেবদারু আমার দাদার লাগানো।’
প্রকাÐ একটা গাছ। বাবা বলেন এর বয়স পৌনে দুইশ বছর। তিন প্রজন্মের সাক্ষী। পাঁচ গাঁয়ের মানুষ এর নিচে বিশ্রাম নেয়। এখন তো কিছুই নাÑছেলেবেলায় আমি দেখেছি উত্তর আর পশ্চিমে যে বড় দুটো বিল তার প্রায় সব কৃষক দুপুরে এখানে জিরিয়ে যেত। কেমন উৎসব উৎসব লাগত সবটা। বাবা বেতের পাটিতে আয়েশ করে হুক্কা টানতেন। লোকজন কথার ঝাঁপি খুলে বসত মাঝেমাঝে। কিন্তু তাদের বেশিরভাগই থাকত ক্লান্ত।
‘তখন তোর দাদা তাদের বলতেন, “আরে মিয়া রাহো! এইবার একটু জিরাও। সারাদিন তো আর কম খাটলা না।” হো হো করে হেসে উঠত সবাই। বড্ড ভালবেসে বলত, ‘তালুকদার সাব! আপনে আমগো সঙ্গ দিবার আহেন। আপনের বাপের পোঁতা এই গাছ আমগো ছায়া দেয়। সাত গেরামের মানুষ বাতাস লাগায় আরামে। সেইখানে ঘুমাইতে মন চায় না। জাগবার থাকতে মনে লয়।” এরপর ক্লান্ত অবসন্ন শরীর ছেড়ে দিত সবাই। হুড়হুড় করে বাতাস নেমে আসত পাতার ফাঁক গলে। বাবা আমাকে নিয়ে বসে থাকতেন। গল্প করতেন। কিভাবে মানুষ হওয়া যায়Ñসেই গল্প। তিনি বলতেন, “আমরা সবাই মানুষ। আবার মানুষও না। আমাদের ভেতরটা পাপে ভরা। নানা রকমের পাপ জন্মায় সেখানে।” উদাস ভঙ্গিতে বলতেন, “বেহেশত অত সোজা না, বুঝলি দুলাল? শুধু নামাজ-রোজা কইরাই কেউ পার পাইব না। খোদায় যারে মাফ দিব, সেই সফল। নামাজ পড়তে হইব আল্লাহর লেইগা। মানুষরে কষ্ট দিয়া, তাগো হক মাইরা, পাড়ায় পাড়ায় ফ্যাসাদ লাগাইয়া তসবিহ টিপলে কাম হইব না।” এভাবে আরও কত কথা! মানুষকে ভালবাসার কথা বলতেন বেশি। ভোরে ফজরের পর পর জিকির করতে করতে এখানে চলে আসতেন। এই গাছের গোড়ায়। দল বেঁধে কৃষকেরা মাঠে যেত। আর তিনি তাদের হাল-পুরস্তি করতেন। সামর্থমতো সবাইকে সুপরামর্শ দিতেন সবসময়।’
আমাদের এই দেবদারু গাছ। তার পাতায় পাতায় মিশে আছে আমার বাপ-দাদার গন্ধ। এর প্রতিটি শাখা বিস্তর মনোযোগে হিসেব রেখেছে আমাদের সময়কে। প্রকাÐ দেহ নিয়ে এইযে দাঁড়িয়ে আছেÑএটা ওর মহত্ত। কখনো ছায়া কখনো বাতাস দিয়ে মানুষের সেবা করে আসছে প্রবল ধৈর্যের সাথে। দাদাও নাকি এই বিলের মাঝখানে এ মানসেই গাছটি লাগিয়েছিলেন।
দুই.
এভাবেই কেটে গেল বহুবছর। আমি শৈশব ছেড়ে কৈশোরে নামলাম। আমার বাবারও বয়স পড়তে থাকল সময়ের বিবর্তনে। সাথে দেবদারু গাছটারও। অদ্দিনে গ্রাম ছেড়ে আমরা জেলা শহরে এসে উঠেছি। আমাদের পড়াশোন, বাবার সামান্য ব্যবসাÑগ্রামে থেকে ওসব সামলে ওঠা মুশকিল। মাঝে বাবা অসুস্থ হলে সব ছেড়েছুড়ে শহরেই উঠলাম পাকাপাকি। ভাড়া বাসা। গ্রামের সেই উঠোনজুড়ো ঘর, পেছনের পুকুর, সামনেই আদিগন্ত বিস্তৃত ধানের বিল, একটা মুক্ত আকাশ, আর সেই দেবদারু গাছ, যেটা ছিল ধৈর্যের প্রতিমূর্তিÑকিছুই নেই এখানে। কিন্তু আশ্চর্য! আমি এতটুকুন কষ্ট পাইনি তখন। এমনকি সেই দেবদারু গাছের কথাও তেমন মনে পড়েনি। শহুরে জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়লাম ঠিকঠাক। বাবা সারাদিন ব্যস্ত থাকেন। কঠোর পরিশ্রম যে তিনি করছেন তা বোঝা যেত বাবার উন্নতিতে। দিনদিন তাঁর ব্যবসা ভালো হচ্ছিল। আয়-রোজগারও বেশ। আমাকে নিয়ে তাঁর অগাধ স্বপ্ন। আমার ছোট ভায়ের বয়স তখন সবে দুবছর। মাকে মাঝে-মধ্যেই বলতেন, ‘আল্লাহ অনেক দিয়েছে। এবার সন্তানগুলো মানুষ হলেই হলো। আমার আর কিছু চাওয়ার নেই। জায়গাটাও বায়না হয়ে গেছে। পৌরসভার ভেতর একটা বাড়ি করতে পারলেই হলো। বাকি জীবন ছেলে-সন্তান নিয়ে আল্লাহর রহমতে কেটে যাবে একরকম।’ বাবা এসব বলতে বলতে মাঝে জোরে নিঃশ্বাস নিতেন। শ্বাসকষ্ট ছিল তাঁর। প্রচুর পরিশ্রম করায় শরীরের প্রতি লক্ষ রাখতেন না একদম। অনিয়ম করতে করতে বেশ বড়সড় রোগ বাঁধিয়েছেন। আম্মা ব্যস্ত হয়ে উঠে যেতেন। ইনহেলার বের করে মুখে ধরতেন। জলে আম্মার চোখ ছলছল করত। অভিমান করে বলতেন, ‘সন্তান সন্তান করে নিজের জীবনটা একদম শেষ করে দিলে। এত রোজগার দরকার নাই আমার। কি হবে এতকিছু দিয়ে। যদি বড় কিছু হয়ে যায় তোমার। গতকাল রিপোর্ট আনতে যাওয়ার কথা, তাও তো যাওনি। মানুষ নিজের প্রতি অমন অবিচার করে কী করে!’ বলেই ফুঁপিয়ে কাঁদতেন তিনি।
বাবা শ্বাস নিয়ে মুখে কৃত্রিম হাসি টানতেন। এ আমি বুঝতাম। বাবার কষ্ট লুকোনোর অভ্যেস প্রবল। কাউকে কিছু না বলে বালিশে বুক চেপে থাকতে দেখেছি কত রাত। তখনও বুঝিনি বাবা ভয়ঙ্কর কোনো অসুখে পড়েছেন।
তিন.
আমার বয়স ততদিনে ২০ পেরিয়েছে। বাবা সারাজীবন নিজের প্রতি যে অবিচার করে এসেছেন, তার ছাপ পড়েছে শরীরের প্রতিটা অঙ্গে। এমনকি আমাদের সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ার নেশায় তিনি যে ব্যাংক থেকে ধার-দেনা করেছেন, তা আর কাটিয়ে উঠতে পারছেন না এখন। বয়স কতই-বা হবে আর। সর্বোচ্চ ৪৫ ছুঁই ছুঁই। অথচ এখনই তার দাড়ি সাদা হয়ে যাচ্ছে। মাথার একপাশ থেকে চুল পড়ে যাচ্ছে। তাঁর শক্তপোক্ত সেই পেশী এখন নরম হয়ে ঝুলে গেছে। বিছানায় পড়ে থাকেন মাঝেমাঝেই। সামান্য শক্তি পেলেই আবার দৌড়ান আমাদের জন্য। আমাদের গোছিয়ে দিয়ে যেতে চান ওপারে। নিজের প্রতি বিন্দু পরিমাণ খেয়াল যদি থাকত মানুষটার। জীবনের দৌড়ে হেরে যান মাঝে মাঝেই। আউট অব ফিল্ড হয়ে যান কঠোর পরিশ্রমী মানুষটি। কিন্তু জীবন তো তাঁকে থামতে দেয় না। প্রয়োজনের চাদর পেঁচিয়ে রেখেছেন তাঁর সর্বাঙ্গে। আমাদের সুখ কিনতে তিনি যে মরিয়া হয়েছিলেন, একটু থেকে আরেকটু করার নিমিত্তে যখন ঋণ করেছেন দেদারছে; হয়তো শোধ দেবার ব্যবস্থাও ছিল যথেষ্ট, কিন্তু জীবন কখনও বিপরীত ¯্রােতে প্রবাহিত হয়। বাবার ক্ষেত্রেও হয়েছে তাই। তিনি সে ¯্রােতে ঘুরছেন চক্রাকারে। তাঁর সামনের পথ ঘোর অন্ধকার। ভেঙে-পড়া শরীরে আর কতটুকু কুলোয়।
‘তা এবার কিছু একটা কর।’ আম্মার দীর্ঘশ্বাসের সে ভারী স্বর আমি হররোজ শোনি। অথচ, বাবা আজ পর্যন্ত কোনোদিন বলেননি।
তিনি বিধ্বস্ত শরীর নিয়ে রাতে ঘরে ফেরেন। পরদিন ভোরটা আরেকটু দেরিতে আসুকÑএই প্রার্থনা তাঁর মনে মনে। সকাল হলেই কিস্তির দৌড়ঝাঁপ। আবার দৌড়োতে হবে জীবনের ব্যস্ত রাজপথে। তিনি জানেন না এর শেষ কোথায়। তাঁর শরীরের প্রতিটা কোষ, প্রতিটা লোমকূপ থেকে অবশের চুপসানো আওয়াজÑআমরা আর পারছিনে, এবার থামুন মহাশয়!
কিন্তু তিনি দৌড়ান। দৌড়োতেই থাকেন মহাপ্রলয় পেছনে ফেলে। এই দৌড় কবে শেষ হবে? আদৌ শেষ হবে কি না তাও জানেন না। কিন্তু তাঁকে লড়তে হয়। পৃথিবীর বাবারা এমনই। তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মের সুখ কিনে মরতে চান তাঁরা। নিজের জীবনকে উৎসর্গ করে বাবারা হাঁটতে থাকেন অনিশ্চিত অন্ধকারের ঘুপচি গলিতে। সেখানে তাঁদের জীবন আস্তে আস্তে মুমূর্ষু হতে থাকে। একসময় তাঁরাও মুমূর্ষু হয়ে যান।
চার.
আজ বহুকাল পর আমার দেবদারু গাছের কথা মনে পড়ছে। সেই প্রকাÐ বিস্তৃত দেবদারু গাছ। যেটা আমার বাবার দাদা লাগিয়েছিলেন। যেখানে মিশে আছে আমার পূর্বের তিন প্রজন্মের অভিজাত স্মৃতি। তালুকদার বাড়ির বংশীয় প্রভাব। দেবদারুর গোড়ায় বসে বসে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে যখন শিক্ষা দেয়া হতো মনুষত্বের। ধৈর্যের প্রতিফলক হিসেবে দেখানো হতো মাথার ওপরের দেবদারুকে। প্রকৃতির সুনিবিড় মায়ায় যে বেড়ে উঠেছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে।
তাকে দেখেই বেড়ে উঠেছিলেন আমার বাবা। দেবদারুর ডালে দোল খেয়েছেন কতকাল। তার থেকে ধৈর্যের সবক নিয়েছেন দিনভর। কিন্তু আমার কাছে এসব মিথ্যে মনে হয়। মনে হয় আমার বাবাই দেবদারু। মূল যে দেবদারু গাছ, সে একটা গাছ মাত্র। আমার বাবার মতো জীবনের এই মহাসত্য কখনও উপলব্ধি করতে হয়নি এ তাকে। কোনোদিন দৌড়াতে হয়নি বুকে ব্যথা নিয়ে। বছরের পর বছর ভুগতে হয়নি শ্বাসরোগে। জীবনের গতিপথও পরিবর্তন হয়নি তার। অথচ আমার বাবা এসব তুচ্ছজ্ঞান করে ছুটেছেন যুগের পর যুগ। তাঁর সন্তানদের হাসি দেখতে বিসর্জন দিয়েছেন নিজের সর্বস্ব শক্তি। উপোস করে আমাদের জীবনের গোড়ায় পানি ঢেলেছেন ২০টি বসন্ত ধরে। তাহলে কে ধৈর্যের মূর্তপ্রতীক? আমার বাবা, না সেই শতবর্ষী দেবদারু গাছ?
পৃথিবীর বাবারা তাঁদের নিজেদের মতোই। প্রত্যেক বাবাই একটা সময়ে একেকটা দেবদারু হয়ে সন্তানদের ছায়া দেন। আগলে রাখেন। তাঁদের ওপর দিয়ে চলে যায় জীবন-ঝড়ের প্রবল সমীক্ষা। তাঁরা ঋজুভাবে কাঁদেন। ঝড়ের আঘাতে তাঁদের বুকের হাড় ভাঙে। অথচ তাঁরা তখনও নির্বিকার ভঙ্গিতে নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকেন। সন্তানের মুখ দেখে কাটিয়ে দেন জনমের দুঃখ। একসময় এ মানুষগুলো চলে যান অন্য কোথাও। খুউব দূরে। আকাশের ওপারে। তখনও বাতাস বয়। ঝড় আসে। আমরা অনুভব করি বাবাকে। আমাদের অপূর্ণ মন বারবার ডাকে, ‘বাবা! বাবা!’
বাবা হয়তো শোনেন ঠিক, উত্তরও দেন, কিন্তু তাঁর উত্তর আমরা শুনতে পাই না। আমরা নিরন্তর ডাকতেই থাকি। তারপর আবার ভুলে যাই কালের পরিক্রমায়। প্রকৃতি নিশাচর হয়ে উঁকি দেয় বাবার বদ্ধ স্মৃতিপথে। খটখট করে শব্দ হয়, ‘বাবা! বাবা!’
মে ২০১৮