‘কীরে, দরজা খুলতে এতো দেরি কেন?’
রাগত স্বরে ঝাঁ-ঝাঁ করে উঠলেন লতিফা বেগম। হাত ওঠাতে গিয়েও কেন যেন আর ওঠালেন না। হয়তো সারাদিনের ক্লান্তি পেয়ে বসেছে। নাসরিনের দিকে অগ্নিঝরা চোখে তাকিয়ে গমগম করে বললেন, ‘যা এক গøাস ঠাÐা পানি নিয়ে আয়। ফ্যান চালিয়ে ধপাস করে সোফায় বসে পড়েন লতিফা বেগম। দরজা বন্ধ করে ঠাÐা পানি আনতে গেল নাসরিন। সে এ-বাসার কাজের মেয়ে। উদয়াস্ত কাজ করে দিনশেষে ঝারি শুনতে হয় একরাশ। কপালে থাকলে মাইরও জুটে যায় হাড় জিরজিরে ঐ শরীরে।
খুব আয়েশ করে গøাসে চুমুক দিলেন গৃহকর্ত্রী। টি-টেবিলে গøাসটা রাখলেন। মাথাটা পেছনে এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করলেন। হাত-মুখে একটু পানি দিতে পারলে ভালো লাগবেÑএই মনে করে উঠতে যাবেন, ঠিক তখনই নরম সুরে বেজে উঠল তাঁর ফোনটা। ঝুকে এসে তুলে নিলেন মোবাইল। নার্গিস আরার কল। তাঁর ঘনিষ্ট বান্ধবী। লতিফা বেগম সোফায় লম্বা হয়ে শুয়ে রিসিভ করলেনÑ‘হ্যালো…!’
দুই
লতিফা তখন সবে নারী-অধিকার সংগঠনে যোগ দিয়েছেন। ছেলেমেয়ে সব থাকে বাইরে। স্বামী ব্যস্ত ব্যবসা নিয়ে। সারাদিন ঘরে বসে কাজের মেয়ের সঙ্গে খটমট আর কতোক্ষণ ভালো লাগে! তাই কিছু এন্টাটাইনমেন্ট পেতে সংগঠনে যোগ দেওয়া। কিছু বন্ধুও জুটিয়ে ফেলতে পারবেন। অবসরটা কেটে যাবে বেশ। এবং হলোও তাই। সংগঠনে যোগ দেওয়ার পর এখন তাঁর সময় কাটে ভালোই। কয়েক ঘণ্টা ধরে মেকআপ নিয়ে দামি গাড়িতে চড়ে ক্লাবে যান। প্রায়ই কোনো সভায় যোগ দিতে হয়। তখন অবশ্য ভিন্ন গেট-আপ নিতে হয়। ঠাটবাটের সঙ্গে মসৃণ গাম্ভীর্য।
লতিফা বেগম সভায় এখন শুধু ‘ভরামুখে’ বসেই থাকেন না। মঞ্চে দাঁড়িয়ে নারী-অধিকার নিয়ে দৃপ্ত কণ্ঠে বক্তৃতাও করেন। এই সংগঠনেই নার্গিস আরার সঙ্গে তাঁর পরিচয়। প্রায় অভিন্ন কারণে তাঁদের সংগঠনে যোগ দেওয়া। তাই মনের মিল হতেও সময় লাগেনি তেমন। তাঁদের সখ্যতা এখন সবার ঈর্ষা যোগায়।
‘কীরে, আজকের সভা কেমন হলো?’
‘সভা তো ভালোই হলো। তুই এলি ন যে! কত করে বললাম চলে আয়। ভালো লাগবে।’
‘আর বলিস না! খুব খারাপ লাগছিল শরীরটা। তারপর বল, কী বিষয়ে আলোচনা হলো সভায়?’
‘আজকের আলোচ্য ছিল, গৃহকর্মী নারীর অধিকার। বাসায় কাজ করা ছোট মেয়েদের নিয়েও কথা হয়েছে বিস্তর।’
‘তুই কেমন বক্তৃতা দিলি? যা আবেগ তৈরি করতে পারিস না তুই! হা হা হা!’
‘এই আর কি! আজকে বললাম, আমরা নিজেরা পেট পুরে খাই, কিন্তু কখনো কি খোঁজ নিয়েছি, আমার কাজের মেয়েটা খেলো কি না? ঠুনকো বিষয়ে গায়ে হাত তুলি। এগুলো বলতে বলতে করুণ গলায় কাঁদো কাঁদো হয়ে পড়লাম। এবং শেষ করলাম গরম হুঙ্কার ছেড়ে। বক্তৃতা শেষ হতেই সে কী করতালি, তুই যদি…’ কথার মাঝেই ঝনঝন করে কিছু ভাঙার আওয়াজ এল রান্নাঘর থেকে। ‘এই রাখিরে পরে কথা বলব’ বলে ফোন রেখে ছুটে এলেন লতিফা বেগম। দু’টো কাঁচের প্লেট চুরমার হয়ে গড়াচ্ছে মেঝেতে। পাশেই শঙ্কিত মুখে ক¤িপত পায়ে ভয়ে জবুথবু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নাসরিন। রাগে সমস্ত শরীর জ্বলে যাচ্ছে লতিফা বেগমের। আগুন-গরম কণ্ঠে বললেন, ‘এ দিকে আছ!’
মেয়েটি কাছে আসতেই ‘হারামজাদি’ বলে চিৎকার ছুড়লেন তিনি। চুলের মুঠি ধরে এলোপাথারি প্রহার শুরু করলেন নারী-অধিকার সংগঠনের সংগ্রামী কর্মী লতিফা বেগম। ক্লান্ত শরীরে বেশ যুত করতে পারলেন না। শেষে বললেন, ‘এগুলো সাফ কর। আর আজ রাতে তোর খাওয়া বন্ধ।
তিন
রাত সাড়ে দশটা। ডিনার শেষে নরম বিছানায় গড়াচ্ছেন লতিফা বেগম। তাঁর মেসেঞ্জার বøাস্ট হয় হয় অবস্থা। আজকের বক্তৃতা এতক্ষণে ভাইরাল হয়ে গেছে ভার্চুয়াল জগতে। সকলেরই সহমত। সহমন। কমেন্টে সবাই
বলছে, ‘আপা, আপনার কী সাহস!’ ‘আপা, আপনার মতো মানুষ আছে বলেই বাঁচতে ইচ্ছা হয়।’ ‘আপা,
পাশের বাসার ভাবি কথায় কথায় কাজের মেয়ের গায়ে হাত তোলে।’ ‘আপা….আপা….আপা…’
রান্নাঘরে আলু-পেঁয়াজের সঙ্গে শুয়ে আছে নাসরিন। মাথাটা ওর ভনভন করছে প্রচÐ। খিদায় শক্তিরহিত নার্গিসের চোখ ফেটে বেরিয়ে আসছে লোনা জলের ধারা। যার প্রতিটা বিন্দু উপহাস করছে আমাদেরকে, দ্বিচারী এই সমাজকে।
সেপ্টেম্বর ২০১৮