জন নিক্সন বিশ্বাস করলেন উনিই সেই ব্যক্তি, যাঁকে খুঁজছে মার্কিন মুলুক। টেবিলে রাখা বইয়ের গায়ে চিত্রিত ফটো এবং লোকটির অঙ্গভঙ্গি এ কথারই সাক্ষ্য দিচ্ছে। তবু জিজ্ঞাসাবাদ দরকার। বিশ্বাসকে নিখুঁত ও পরিপক্ব করা দরকার। যাতে তাঁর কাছ থেকে উদ্ধার করা যায় মধ্যপ্রাচ্য-রাজনীতির অজানা সব তথ্য। লোকটি যে পশ্চিম দুনিয়ার বুকে ত্রাশ সৃষ্টিকারী এক ‘ডেজার্ট সোর্ড’ বা মরুভূমির তরবারি!
২০০৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সিআইএ তাঁকে আটক করে। তিকরিতে একটি রাজপ্রাসাদ সংলগ্ন ভূ-গর্ভস্থ বাঙ্কারে তিনি আত্মগোপনে ছিলেন। কিন্তু তাদের সংশয় হয় উনিই কি প্রকৃত ব্যক্তি? কেননা সিআইএ জানতে পারে তাদের কাক্সিক্ষত ব্যক্তির অবয়বে কিছু নকল লোক আছে ইরাক ভূমিতে। তাই মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাটি এই সংশয় নিরসনের জন্য তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের দায়িত্ব দেয় জন নিক্সনকে। সিআইএতে কর্মরত জন নিক্সন এই ব্যক্তিকে নিয়েই দীর্ঘদিন থেকে গবেষণা করে আসছেন। জন নিক্সন তাঁর পঠিত ব্যক্তিকে সামনা-সামনি পেয়ে অমাবস্যায় চাঁদ পাওয়ার মতো অবস্থা। নিজের গায়ে চিমটি কেটে দেখেন এটা সত্যি নাকি স্বপ্ন? আমেরিকার দাদাগিরি না মেনে বহুজাতিক আরবে দীর্ঘদিন শাসন করা চাট্টিখানি কথা নয়। কিন্তু তিনি তা করেছেন। এ রকম একজন লৌহমানবের কাছে বসাটাও ভাগ্যগুণে জুটে। জন নিক্সন নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছেন।
সিআইএ থেকে নির্দিষ্ট করে দেওয়া প্রশ্নগুলো ছাড়াও অতিরিক্ত বহু প্রশ্ন করেন জন নিক্সন। প্রতিটি প্রশ্নের জবাবে তাঁর ছিলো শান্ত ও ভয়হীন স্বর। যে স্বরের ভেতর তরঙ্গিত হতে থাকে আরেকটি স্বর। সে স্বর আত্মমর্যাদার। আপন জাতির বিশ্বাস রক্ষার। পর্বতের মতো নিজ আর্দশে অটল থাকার। জন নিক্সনের এবার দৃঢ় বিশ্বাস হলো ইনিই প্রকৃত ব্যক্তি।
অতঃপর শুরু হলো বিচার প্রক্রিয়া। বিচারকের সামনে তিনি উচ্চ কণ্ঠে বললেন, ‘ইয়োর অনার, আমি সাদ্দাম হোসাইন। আমি যখন কথা বলব, আপনি আমাকে একজন ইরাকি হিসাবে নিজের ভাই মনে করবেন। আমি এই আদালতের মৃত্যুদÐকে ইরাকি জনতার জুতার চেয়ে কম মূল্য দিই। ফাঁসির দড়ি গলায় নিতে ভীত নই আমি। আপনি আমাকে পৃথিবীর অন্য মানুষ থেকে বেশি চেনেন। কাউকে আমার ইতিহাস বলতে হবে না।
‘আমি এখানে ব্যক্তি সাদ্দাম হোসাইনকে ডিফেন্ড করতে আসিনিÑসাদ্দাম হোসাইন এতো উঁচু যে, সে নিজেও নিজেকে ডিফেন্ড করার অধিকার রাখে নাÑআমি এসেছি আপনাদের (ইরাকিদের) ডিফেন্ড করতে।
‘কোন সংবিধানে আমার বিচার হবে? যে সংবিধান সাদ্দাম হোসাইন সাইন করেছিলো? নাকি আমেরিকানদের দ্বারা লিখিত সংবিধানে? আমি জানি এই বিচারের নির্ঘাত পরিণতি হবে আমার ফাঁসি।’
‘কোনো ইরাকিকে ক্ষতি করলে আমার সে রকম কষ্ট হয়, যে রকম কষ্ট সে পায়। এ জন্য নয় যে, আমি তাঁকে ভয় করি বা কোনো মানুষকে ভয় করি। আমি ভয় করি কেবল মহামহিম আল্লাহকে।’
দুই
কয়েক বছর আগে ফেসবুকে আমাকে ইরাকি একটি মেয়ে নক করেছিলো। তার জীবন-বৃত্তান্ত দিয়ে লম্বা একটি জিমেইলও পাঠিয়েছিলো। সেখানে সে বলেছিলো ‘আমি একজন ইরাকি মেয়ে। আমার মা ও ছোট ভাইসহ আমরা একটি শরণার্থী শিবিরে আছি। আমার বাবা ছিলেন সাদ্দাম হোসাইনের একজন সামরিক অফিসার। মার্কিন জোট বাহিনীর হাতে তিনি শাহাদত বরণ করেন। এরপর ওরা আমাদের বাড়িটিও পুড়িয়ে দেয়। বাড়ির সঙ্গে আমাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের কাগজ-পত্র পুড়ে গিয়েছে। কাগজ ছাড়া আমাদের বাবার রেখে যাওয়া বিশাল অংকের টাকা আমরা ওঠাতে পারছি না। ব্যাংক ম্যানেজার বলেছেন, বিদেশি বিশ্বস্ত কোনো লোক যদি সুপারিশ করেন তবে তারা ভেবে দেখবেন।’ আরও নানা কথা ছিল সেখানে। কথা শেষ করে মেয়েটি ব্যাংকের ওয়েব লিংক, অ্যাকাউন্ট নম্বর ও একটি ভিডিও আমাকে শেয়ার করার অনুরোধ করেছিলো।
আমি সাদ্দাম হোসাইনকে নিয়ে এই গল্পটি লেখা শুরু করার আগে সে ভিডিওটি নতুন করে দেখছিলাম। সুন্দর মনোরম কয়েকটি বাড়ি। ফুলে-গাছে সুসজ্জিত। হঠাৎ প্রকাÐ একটি আওয়াজ হয়। কালো ধোঁয়া। মানুষের চিৎকার। রক্ত-লাশ। কেয়ামতের বিভীষিকা। ভিডিওটি দেখার সময় আমার ভাগিনে এসে বলল, ‘মামা, ওটা কী?’
‘ওটা আমেরিকান বোমার আগুন।’
‘ওরা কেন এই আগুন দিয়েছে?’
‘সে অনেক কথা। একটি নির্লজ্জ কিচ্ছা।’
‘একটু বলো না, প্লিজ!’
‘মন দিয়ে শুনবি?’
‘হুম।’
‘তখন ১৯৮১ সাল। ইরাক সরকারের একটি বিশেষ বিমান রাশিয়ার পথে যাচ্ছিল। মাঝপথে বিমানটির পথরোধ করে তা ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলের রাজধানী তেলআবিবে নেওয়া হয়। বিমানে ছিলেন ইরাকের সরকারি অ্যাটর্নি আরেফ-সহ পারমাণবিক প্রকল্পের কয়েকজন কর্মকর্তা। কিন্তু বিমানটি ভুল পথে যাওয়ার সঠিক ব্যাখ্যা ইরাক সরকারের কাছে একটি রহস্য হয়ে থাকে। এর কিছুদিন পর ইসরায়েল অভিযোগ করে, ইরাক পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে। ইরাক জোর গলায় অস্বীকার করে এই অভিযোগ। কিন্তু এর কোনো তোয়াক্কা না করেই ১৯৮১ সালের ৭ জুন ইসরায়েলের যুদ্ধবিমান ইরাকের নির্মাণাধীন ওসিরাক পারমাণবিক চুল্লিতে হামলা চালায়। ইরাক পাল্টা প্রতিক্রিয়া শুরু করলে ইসরায়েলের হামলা স্তিমিত হয়। কিন্তু তারা নতুন ফন্দি আবিষ্কার করে। ইসরায়েল আবার অভিযোগ করে ইরাক নাকি ইসরায়েল-প্রধানমন্ত্রী মেনাচেম বেগিনকে হাইজ্যাকের চেষ্টা করেছে। এভাবে ইরান-ইরাক ও কুয়েত-ইরাক যুদ্ধের ইন্ধন আসে ইসরায়েলের কূটবুদ্ধি থেকেই।
‘ইরাক ধ্বংসের ষড়যন্ত্র আর যুদ্ধের মধ্যদিয়ে শুরু হয় একুশ শতকের। ২০০৩ সালে আবার পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির অভিযোগ দেওয়া হয় ইরাকের ওপর। তখন আমেরিকা ও যুক্তরাজ্যের জোট বাহিনী এক যোগে আক্রমণ করে ইরাক ভূমিতে। তাদের হাতে নিহত হয় লক্ষ লক্ষ ইরাকি জনতা। সম্ভ্রমহারা হয় অগণিত নারী। বিধ্বস্ত হয় আধুনিক ইরাকের অবকাঠামো।’
‘আচ্ছা মামা, ওরা কি সত্যি ইরাকে পারমাণবিক অস্ত্রের কারখানা পেয়েছিল?’
‘না, পায়নি। ওটা খোদ আমেরিকাও স্বীকার করেছে।’
‘তাহলে এতো মানুষকে মারল কেন?’
‘এর রহস্য হলো, যদিও তারা পারমাণবিক অস্ত্রের দোহাই দিয়ে ইরাকে ঢুকেছিল, কিন্তু ভেতরের লালসা ছিল ইরাকের তেল সম্পদ দখল করা। তখনকার ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসাইন আমেরিকার প্রভুত্বকে বৃদ্ধাঙুলি দেখিয়ে তাঁর দেশের তেল ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ নিজেই নিয়েছিলেন। এটা দেখে অন্য আরব রাষ্ট্রগুলোও এই পথে হাঁটতে শুরু করে। বিষয়টি ভালো ঠেকেনি আমেরিকার কাছে। এটাই ইরাক দখলের মূল কারণ।’
‘তাহলে ওদের কি বিচার করা হবে না?’
‘তুমি গাঁয়ের মোড়লদের দেখেছ? যারা শুধু বিচার করে, কিন্তু তাদের বিচার করা হয় না। তেমনি ওরা হচ্ছে বিশ্বমোড়ল। অন্যায় করে নিজে আর বিচার করে অন্যের।’
এতোটুকু শুনে মুসলিম বিশ্বের মতো আমার ভাগিনের চোখেও তন্দ্রা চলে আসে। সে আর কোনো প্রশ্ন করেনি। তবু একুশ শতকের শুরুতে ইরাক ধ্বংসের এই ইতিহাস চিরজাগ্রত। মুসলিমদের হাজারো স্মৃতি বিজড়িত এই ভূমি ইতিহাসের সাক্ষ্য হয়ে আছে মার্কিন মুলুকের আরেকটি বিভৎস চিত্রের।
তিন
২০০৬ সালের ৩০শে ডিসেম্বর। সন্ধ্যার চাঁদের আলোর মধ্যে দুটি শিশুর ছায়া দেখা যায় বাগদাদের রাস্তায়। বয়সে বড়টির নাম ওলিদ, ছোটটির নাম সারা। তাদের গন্তব্য মার্কিন বাহিনীর উচ্ছিষ্ট ফেলার জন্য ব্যবহৃত একটি ড্রেন। গন্তব্যে পৌঁছে তারা দেখে সেখানে পড়ে থাকা খাবারগুলো ভাগাভাগি করে খাচ্ছে দুটি কুকুর ও কয়টি ইঁদুর। ওলিদ ও সারা শরিক হয় তাদের সঙ্গে। পশু ও মানবশিশুর এমন অদ্ভুত ভোজনসন্ধ্যা হয়তো এর পূর্বে আর দেখেনি বাগদাদের আকাশ।
সারা বলে, ‘ভাইয়া কাল তো ঈদ। গত ঈদের রাতে আব্বু আমাদের জন্য নতুন জামা এনেছিল, মনে আছে?’
‘হু। আর মা?’
‘মা রেঁধেছিল কাবাব রুটি গোশত ভুনা…।’
‘জানিস, পরশু রাতে আমি আব্বু-আম্মুকে দেখেছিলাম।’
‘তাই? আচ্ছা ভাইয়া, ওরা গুলি মারার পর আব্বুর মাথা থেকে যে রক্ত বেরুচ্ছিলো ওটা কি বন্ধ হইছে? আর মায়ের যে হাতটা কেটে নিয়েছিল ওটা কি ফিরিয়ে দিছে?’
ওলিদ সারাকে জবাব দেয় না। তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। ভেজা গলায় বলে, ‘সারা, কাল তোকে একটি নতুন জামা দেব।’
‘সত্যি?’
‘হ্যাঁ। ঈদের দিন প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসাইন তাঁর গ্রাম ‘আল আওজাহ’তে নতুন জামা-কাপড় খাবার ও নগদ মুদ্রা বিতরণ করতেন।’
‘হয়তো এবারও দেওয়া হবে। আমরা কাল সেখানে যাব।’
ওলিদ ও সারা খোলা আকাশের নিচে ঘুমিয়ে পড়ে রাত্রি শেষের অপক্ষায়। রাত্রি শেষে ভোর হয়ে ওঠে। অনেক মানুষ যাচ্ছে ‘আল আওজাহ’ গ্রামের দিকে। ওলিদ আর সারাও যায় তাদের সঙ্গে। ঈদের প্রভাতে সবাই আনন্দে থাকার কথা। কিন্তু তারা নিশ্চল। নির্জীব। অপেক্ষা করছে কোনো এক আগন্তুকের। এই ঈদ যেন একটি শ্যামল উদ্যানে বর্ণহীন ক্যাকটাসের বার্তা নিয়ে এসেছে ইরাকের দুয়ারে।
সূর্য যখন আরেকটু উদিত হয়, বিধ্বস্ত ইরাকের চিত্রটা যখন আরেকটু পরিষ্কার হয়ে ওঠে, তখন ‘আল আওজাহ’ গ্রামের মাঠে নামানো হয় একটি লাশ। বাতাস নাড়িয়ে যায় কাফনের আঁচল। উপস্থিত জনতার অনেকের চোখ বেয়ে অশ্রæ গড়িয়ে পড়ে। অনেকে চেয়ে থাকে নিথর অপলক। নিরাপত্তারক্ষী সুপার টুয়েলভ মার্কিন সদস্যের চোখেও দেখা যায় অশ্রæধারা। তাদের একজন দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে কাফনে মোড়া লাশকে। আরেকজন কান্নাভাঙা কণ্ঠে বলে আমরা তোমাকে ফাঁসি দিয়ে নিশ্চয় অন্যায় করে ফেলেছি। সারার এসবে কোনো ভাবান্তর নেই। সে দাঁড়িয়ে থাকে নতুন পোশাক ও খাবারের অপেক্ষায়। আর এদিকে নীরবে শুয়ে থাকেন একজন সাদ্দাম হোসাইন। একজন ডেজার্ট সোর্ড। মরুভূমির তরবারি।
শিক্ষার্থী, ইমাম আবু হানিফা ইনিস্টিটিউট, সিলেট
ডিসেম্বর, ২০১৮ সংখ্যায় প্রকাশিত