মাদরাসার সামনে দিয়েই লেগুনা যাওয়া-আসা করে। বাংলাবাজার যাবার উদ্দেশ্যে বের হলাম। কিছু কাজ আছে, সারব। দিনগুলো যে কীভাবে পেরিয়ে যাচ্ছে, বুঝতেই পারছি না!
কতশত ভাবনার ভিড়ে হঠাৎ লেগুনা সামনে চলে এল। লেগুনা এখানে থামে না, তবে একটু ধীর গতিতে চলে। ঝুলে যেতে হবে সেটা তো জানা কথা। পোস্তগোলা থেকে গাড়ি ভর্তি হয়েই যাত্রী আসে।
হাতে ঝাপটে হাতল ধরার সময় উনার হাতের সাথে খানিকটা স্পর্শ খায়! বেশকিছু লজ্জা এসে হয়তো গালটাকে রাঙা করে দিলো! সরি বললাম, উনি একটু হাসলেন।
যেই হাসির অর্থ হচ্ছে—অসুবিধে নেই আমি কিছু মনে করিনি।
আমি ঝুলে আছি, এক বৃদ্ধ চাচাও সঙ্গী হলেন। হয়তো কাজের তাড়া আছে। উনাকেও জায়গা করে দিলাম। মাঝপথে দুজন যাত্রী নেমে যাওয়ায়, চাচাকে ভেতরে যেতে বললাম। উনি আরেকটু সামনে নেমে যাবেন তাই আর ভেতরে বসলেন না।
বাংলাবাজার পৌঁছুবার আগেই বেশ কিছু যাত্রী নেমে গেলেন। তবু কিছুটা সংকোচ হচ্ছিল, তাই আমি বাইরেই ঝুলে ছিলাম।
আমি উনার দিকে তাকাচ্ছিলাম। ওহ সরি, উনার কোলের ফুটফুটে বাচ্চাটার দিকে তাকাচ্ছিলাম। কী মায়াবী চেহারা! দেখলেই আদর করে দিতে ইচ্ছে করে!
ঘুমন্ত মানুষকে মায়াবী দেখায়। আর সেটা যদি হয় শিশু, কত নিষ্পাপ কত মায়াবী দেখায়!
বাবুটা বড় হোক। কিন্তু শৈশবের এই নিষ্পাপতা তার চরিত্রে লেগে থাকুক।
আহমাদের কথা মনে পড়ে গেল।
আমার ভাগ্নে। একবার ওর আম্মুকে বললাম, ‘ফোনটা বাবুর কানে দাও তো!’
পাশ থেকে ওর মা শিখিয়ে দিচ্ছিল যে, মামা ডাক দাও মামা ডাক দাও!
কিন্তু ও বাবা বাবা বলে ডাকতে লাগল! বাবুটা কি তখন আর মামা বুঝে!
জীবনে প্রথম বাবা ডাক শুনলাম! অদ্ভুত শিহরণ খেলে গেল! ভালোলাগা ছুঁয়ে গেল আমার দেহসত্তা।
ওর মা হাসছে, আমিও হাসলাম।
গাড়িতে বসা, মায়ের কোলে ঘুমন্ত বাবুটাকে দেখে আমার ভাগ্নের কথা মনে পড়ে গেল। পৃথিবীর বাগানে প্রতিটি মানবকলিই নিষ্পাপ হয়ে জন্ম নেয়। কিন্তু দিন দিন যত বড় হয়, পৃথিবীর কলুষতা তাদেরকে কলুষিত করে ফেলে!
দুআ করি, তারা অনেক বড় হোক! তাদের জীবনে শৈশবের পবিত্রতা লেগে থাকুক। আজকের প্রতিটি শিশুর জন্য আমার এই প্রার্থনা।
জ্যাম ছেড়ে গেছে। লেগুনা একটু জোরে টান দিয়ে হঠাৎ এত জোরে ব্রেক কষল, ভেতরের যাত্রীরা উপড়ে পড়ল সামনের দিকে। আমার ভাবনার জগতে তখনও বসবাস! তাই হোঁচট খেলাম একটু বেশিই! পড়ে গেলাম ভেতরের দিকে! আল্লাহ বাঁচালেন, বাইরের দিকে পড়লে তো বড় কিছু হয়ে যেতে পারত।
সাথে সাথে নিজেকে সামলে নিলাম।
উনি তখন বললেন, ভেতরে আসুন। ডানপাশের মধ্যবয়সী মহিলাও বললেন, ভেতরে আসো বাবা।
পুরুষ দুইটা যাত্রী ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে আছে।
মায়েদের মন কত কোমল হয়, আজ তার একটা প্রমাণ পেলাম!
‘ব্যথা পেয়েছ বাবা?’ ওপাশের মহিলাটি জিজ্ঞাসু নয়নে তাকালেন আমার দিকে।
‘না, সামান্য একটু ব্যথা পেয়েছি।’
পাশে বসা বাবুর আম্মুটি বললেন, ‘একটু! হয়তো বেশিই ব্যথা পেয়েছেন!’
ঘাড় ফিরে তাকালাম, ‘না অসুবিধা নেই! বাইরের দিকে পড়লে কি হতো সেটাই ভাবছি!’
হাঁটুর চামড়া ছিলে গেছে। কিন্তু দেখা তো যাবে না। মুখে ব্যথার প্রতিক্রিয়াও সৃষ্টি করা যাবে না। স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করছি।
মানুষ খুব অভিনয় পারে! একদম সত্যিই!
বাবুটার হাত আমার উরুতে। আগে যদিও বসতে সংকোচ করছিলাম, বসার পর যেন অস্বস্তি ভাব কিছুটা কেটে গেল! আগেই যদি বসতাম, হয়তো ব্যথাটা পেতাম না!
ভাগ্য বড়ই বিচিত্র! কখন কী ঘটে যায় একটুও টের পাওয়া যায় না! তবু মানুষের কত বড়াই!
বাংলাবাজার এসে পৌঁছুলাম। উনি নামলেন। একটু অবাক হয়ে আশপাশে তাকাচ্ছেন।
একটা লোককে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ভাইয়া শ্যামবাজার কোন দিকে?’
লোকটি প্রশ্নটা গায়েই লাগাল না। ভাবলেশহীন চলে গেল।
আরেকটা লোককে জিজ্ঞেস করতেই সে বলল, ‘এই রাস্তা দিয়ে বরাবর সামনে যাবেন, তারপর বাঁয়ে একটু মোড় নেবেন। তারপর আবার একটু বরাবর হাঁটবেন। আরেকটু সামনে যাবেন সোজাসুজি তারপরেই শ্যামবাজার।’
মহিলাটির চোখে অসহায় দৃষ্টি। লোকটার কথাগুলো হয়তো তার মাথার উপর দিয়ে গেছে! তখন আমি একটু এগিয়ে গেলাম।
‘আপনি যাবেন কোথায় আপু?’
‘শ্যামবাজার যাব। লালকুঠির ঘাট আর কি! লেগুনা এখানে থামাল কেন ভাইয়া?’
লেগুনা সবসময় শ্যামবাজার হয়ে আসে না। মাঝেমধ্যে লক্ষ্মীবাজার হয়ে আসে। তাই মহিলাটির চিনতে একটু কষ্ট হচ্ছে।
‘চলুন, আপনাকে এগিয়ে দিয়ে আসি। বাবুটাকে আমার কোলে দিন। ছোট্ট ব্যাগটা আপনার কাছে রাখুন।’ ঘুমন্ত মানুষের শরীর একটু ভারী হয়। এই ছোট বাচ্চাটার ভার আর ব্যাগ নিয়ে মহিলার চলতে কষ্ট হবেই!
একটু দ্বিধা করলেন, পরেরবার বলতেই দিয়ে দিলেন।
বাবুটাকে কোলে নিয়ে হাঁটছি। উনি আমার পেছন পেছন আসছেন। কত কিছু ভাবছি!
একদিন আমারও এমন একটা বাবু হবে! বাবুটাকে কোলে নিয়ে হাঁটব! ভাবতেই মনটা প্রশান্তিতে কেমন যেন ভরে গেল!
‘কোত্থেকে আসলেন?’
‘শাশুড়ির বাসায় গিয়েছিলাম। নারায়ণগঞ্জ। সেখান থেকে আসছি, নদীর ওপাড়ে বোনের বাসায় যাব এখন।’
‘বাবুটার আব্বু আসলেন না কেন?’
‘ওর আব্বু একটু ব্যবসা নিয়ে বিজি থাকে তো। এরকম একা চলতে অভ্যাস হয়ে গেছে।’
শেষ কথাটা বলতে গিয়ে মহিলাটির কণ্ঠে একটু বিষণ্ণতা ঝরে পড়ল।
প্রতিটা মেয়েই চায়, তার স্বামী তার সাথে সাথে থাকুক। কোথাও যেতে হলে স্বামী তার হাত ধরুক। রাস্তাঘাটে কত ভয়!
তেমন আর কথা হয়নি মহিলাটির সাথে।
আমাকে শুধু এতটুকু জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘কয় ভাই-বোন আপনারা?’
‘তিন ভাই এক বোন। আমি সবার বড়।’
‘খুব কষ্ট হচ্ছে আপনার ভাইয়া!’ এ কথাটা বারবার বলছিলেন উনি!
প্রতিউত্তরে আমিও বলে যাচ্ছিলাম, ‘আরে না, তেমন কিছু না!’
শহরের কপটতা মহিলাটিকে স্পর্শ করেনি! গ্রামের সরলতা যেন দেদীপ্যমান! একটু সময়ের সান্নিধ্যে এতটুকু আমার বুঝে এলো। দুআ করি আপনার স্বামী আপনাকে ভালবাসুক।
খেয়াঘাটে নৌকাতে উঠিয়ে দিলাম।
‘ঠিক আছে ভালো থাকুন! দুআ করবেন আমার জন্য! যাই?’ বলতে বলতে বাবুটাকে উনার কোলে দিলাম। বাবুটার প্রতি একটা মায়া জন্মে গেল যেন!
মায়া জিনিসটা বড়ই অদ্ভুত। কখন কার ওপর ভর করে বলা যায় না। ছায়া যেমন মানুষের পিছু ছুটে, মানুষও তেমন মায়ার পিছু ছুটে। ভুল সময়ে ভুল মানুষের মায়ায় পড়া থেকে আল্লাহ পাক আমাদেরকে রক্ষা করুন। আমীন।
‘ঠিক আছে। যান ভাইয়া। আপনি না থাকলে যে আজ কী হতো! অনেক কষ্ট করলেন আমার জন্য।’
কী যেন বলবেন বলবেন করে বলেই ফেললেন, ‘আপনার নাম্বারটা একটু দেয়া যাবে ভাইয়া?’
নৌকার অন্য যাত্রীরা তখন আমার দিকে তাকিয়ে আছে। হয়তো ওরা ভেবেছিল আমি মহিলাটির ভাই বা অন্য কেউ।
‘আমি তো ফোন ব্যবহার করি না আপু!’
মহিলাটি যেন অবাক হলেন। কী বলবেন কিছুই বুঝতে পারলেন না। ‘যাই’ বলে চলে এলাম।
নদীর পাড়ে উঠে একটু তাকালাম। নৌকা ছেড়ে দিয়েছে। কেন যেন মনে হলো—একটু তাকাই, তাকাতেই দেখলাম, মহিলাটি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন! হাত নাড়ছেন!
শিক্ষার্থী, ফরিদাবাদ মাদরাসা, গেন্ডারিয়া, ঢাকা
অক্টোবর ২০২০