আমাদের জীবনের অন্যতম একটি অনুষঙ্গ পড়া। ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় আমাদের পড়তে হয়। বিদ্যালয় থেকে শুরু হওয়া পড়া কারও কারও ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকে অফিসের ফাইলপত্র এবং দৈনিক পত্রিকা পড়ার মধ্যে। ভাগ্যবান কেউ কেউ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভের পরও বই পড়েন। প্রমথ চৌধুরীর মতে এই পড়াই মানুষকে আসল শিক্ষিত করে তোলে। তাই পাশ করা আর শিক্ষিত হওয়া কখনো এক না।
বই পড়ে শিক্ষিত হওয়ার এই পথ অনেক বেশি বিস্তৃত। মহাসাগরের চেয়ে বেশি তার ব্যাপ্তি। সেই মহাসাগরে পাঠককে একটা খড়কুটোর সাথে তুলনা করা যায়। বই পাঠককে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায় নানা পথে। নিজের অজান্তে একটা মত গড়ে ওঠে পাঠকের ভেতর।
বই পাঠক এবং লেখকের মধ্যে এক অদৃশ্য বন্ধন সৃষ্টি করে। তাদের মাঝে সেতু হিসেবে কাজ করে তৃতীয় একজন। তিনি প্রকাশক। ছাপার বইয়ের প্রচলন শুরু হবার পর থেকে প্রকাশকই বই পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করেন পাঠকের কাছে। তাই জ্ঞানচর্চায় প্রকাশকের অবদান অস্বীকার করা যায় না।
মুসলমানদের সোনালি যুগ বলে আমরা যে সময়কে নিয়ে গর্ব করি সে সময়ে খলিফারা ভূমিকা পালন করেছিলেন প্রকাশকের। তখন ছাপাখানা তৈরি হয়নি। হাতে লিখে কপি করা হত পাণ্ডুলিপি। আব্বাসি খলিফারা লেখক বা অনুবাদকদের পারিশ্রমিক দিতেন। তাদের বদান্যতায়ই সেসময়ে বাগদাদে গড়ে ওঠেছিল জ্ঞান বিজ্ঞানের বিশাল সম্ভার।
তাই যদি বলি, প্রকাশকের ভূমিকা লেখকের চেয়ে কম নয় তাহলে অত্যুক্তি হবে না। কারণ প্রকাশক লেখককে প্রতিষ্ঠিত করেন। পাঠকের কাছে লেখককের চিন্তাকে মলাটবদ্ধ করে পৌঁছে দেন। প্রকাশক শুধুই ব্যবসায়ী নন। জ্ঞানের বিস্তারে তিনিও সমান ভূমিকা পালন করেন।
লেখকের মত প্রকাশকেরও আদর্শ থাকতে পারে। যদিও আমাদের বাজারে আদর্শ বিবর্জিত লেখক, প্রকাশক এবং পাঠকের সংখ্যাই বেশি। তবু আদর্শবানদের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়।
লেখক, পাঠক এবং প্রকাশক এই তিন মাত্রার সম্পর্কে ভূমিকা পালন করেন তা আসলে আপেক্ষিক বিষয়। কখনো লেখক স্বাধীনভাবে লিখেন। সাহসী প্রকাশক তা প্রকাশ করে ছড়িয়ে দেন মানুষের মাঝে। কখনো লেখক পাঠকের তাবেদার হন। পাঠকরা যা খোঁজে তাই লিখেন। লোভী প্রকাশক তা ছাপেন। তাতে প্রচুর অর্থাগম হয়। কিন্তু প্রকৃত লাভ কিছুই হয় না।
বইকে অনেকে বিনোদনের মাধ্যমে মনে করে। কিছু বই বিনোদন দিলেও তা নিছক বিনোদন নয়। তার মধ্য দিয়েও একটা সাংস্কৃতিক বিকাশ ঘটে।
প্রকাশকের পর পাঠক কতটা গুরুত্বপূর্ণ সে কথা বলি। একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে আমরা বলতে পারি, পাঠকই সবচে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। কারণ পাঠক না পড়লে লেখকের লেখা বেকার থেকে যায়। প্রকাশকও বই ছাপাতে পারেন না। সবমিলিয়ে বলা যায়, বইয়ের পৃথিবীতে লেখক, প্রকাশক এবং পাঠক কেউই গুরুত্বহীন নয়।
পৃথিবীতে নানা রকম পাঠক আছে। কিছু পাঠক বোধহীন, অন্ধ। লেখকরা যা বলেন তা নির্দ্বিধায় মেনে নেয়াই তাদের কাজ। কিছু পাঠক কুয়োর ব্যাঙের মত। নিজের জ্ঞান নিজের চিন্তা-ভাবনার বাইরে আর কিছু ভাবতে পারে না। বিভিন্ন বিষয়ে তাদের নিজেদের মধ্যে একটা মত তৈরি হয়। বইয়ের মধ্যে তারা সে মতের সমর্থন খুঁজে বেড়ান। লেখক একটু এদিক ওদিক বললেই তাদের সহ্য হয় না।
কিন্তু সচেতন পাঠককে জানতে হবে সাহিত্য আবেগ দিয়ে চললেও জ্ঞান-বিজ্ঞানে আবেগের কোন স্থান নেই। জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠিত হয় প্রাপ্ত তথ্য এবং যুক্তি তথ্যের মাধ্যমে। তাই কোনো কিছু আবেগের বিরুদ্ধে গেলেও তা মেনে নেয়ার মত সাহস থাকা উচিত। মানতে না পারলে সে কথার যুক্তি খন্ডনের চেষ্টা করতে হবে। না হয় এমন পাঠককে এক প্রকার অন্ধই বলা যায়।
পাঠক বলেই যে তাকে একদম অজ্ঞ হতে হবে তা কিন্তু নয়। কখনো পাঠক লেখকের চেয়ে জ্ঞানী হতে পারেন। পাঠক অনেক অনুসন্ধিৎসু হতে পারেন। তার চিন্তা ও জ্ঞানের পরিধি ছাড়িয়ে যেতে পারে স্বয়ং লেখককেও।
সাহসী ও সচেতন পাঠকই পারেন পৃথিবীকে বদলে দিতে। পাঠক অনুসন্ধিৎসু হলে বইয়ের মান বেড়ে যায়। তাই বই তৈরির আগে পাঠক তৈরি করা দরকার।
নবপ্রকাশ সাহসী প্রকাশকের ভূমিকা পালন করে। তাই শুধু মাত্র সাহসী পাঠকরাই স্বাগত নবপ্রকাশের আঙ্গিনায়। গোঁড়া ও সংকীর্ণমনা পাঠকদের জন্য নবপ্রকাশ নয়। মুসলিম হিসেবে যারা পৃথিবীতে মাথা উঁচু করে বাঁচতে চায়, যারা মনে করে আমাদেরও আছে পৃথিবীকে শাসন করার অধিকার, তাদের জন্য নবপ্রকাশ।
দেখতে দেখতে নবপ্রকাশের প্রায় পাঁচ বছর পেরিয়ে গেল। নবপ্রকাশ ইতোমধ্যে সাহসী পাঠকদের গন্তব্যে পরিণত হয়েছে। পাঁচবছর পূর্তি উপলক্ষে সকল পাঠকের প্রতি রইল অকৃত্রিম ভালোবাসা।