আমার শৈশবের সমস্তই সেখানে। নানাবাড়িতে৷ সেই বুঝি-কি-বুঝি-না বয়সে পাড়ি দিয়েছিলাম। এখন আর পষ্ট মনে করতে পারি না। ঝাপসাটিও না৷ ঘোলা হয়ে যাওয়া অ্যালবামে নানুর কোলে ক্ষুদে আমি৷ এ-টুকুই দেখি৷ আরেকটা দৃশ্যপট—মরিয়ম নানুর পিছু-পিছু ছুটছে এক বালক। শীত শীত ভোর। সবুজ ক্ষেতের আলপথ৷ পা ধুয়ে দিচ্ছে শিশির। স্পঞ্জের স্যান্ডেল ভিজে উঠছে। আলপথ থেকে ক্ষেতে পা পিছলে পড়ছে বারবার। বড় নস্টালজিক এই স্মৃতিপট।
নানাই ছিলেন আমার প্রাইমারি জীবনের প্রাইভেট টিউটর। স্কুলের বাইরে আর কারো কাছে পড়িনি আমি। পরীক্ষার সময় প্রতিটা পরীক্ষা দুবার করে দিতে হতো আমার৷ একবার নির্ধারিত সময়। স্কুলে। আরেকবার বাড়ি ফিরে এসে। নানার কাছে। প্রশ্নটা হাতে দিলেই জিজ্ঞেস করতেন—
পরীক্ষা কেমন হইল?
ভালো।
কতো পাইবেন?
৮০/৯০/১০০ (পরীক্ষার ধরন বুঝে উত্তর।)
কোনটা কোনটার উত্তর দিছেন?
১-৩-৫/২-৩-৪ (যেদিন যেমন দিতাম—বলতাম।)
উত্তর শুনেই প্রেডিকশন করে ফেলতেন, কত পাব! মিলিয়েও দেখেছি বহুবার! তেমন একটা ভুল হয়নি কোনোদিন!
ক্লাস টু’র কথা মনে পড়ে। ছোট মামার হাত ধরে হাঁটছি। গন্তব্য, বাঠুইমুড়ী প্রাইমারি স্কুল। বার্ষিক পরীক্ষার রেজাল্ট দেবার কথা আজ। মামা জিজ্ঞেস করছেন—
কত হইবা?
ফাস্ট।
হাহ হাহ হা, দেখা যাইব একটু পরেই! রেজাল্টটা দিয়ে নিক।
সেদিনের হাসিতে কোনো তাচ্ছিল্য ছিল না, সত্যিই।
স্কুল-চত্বরে দাঁড়িয়ে আছি। হাত ধরে আছেন মামা। বুকের ধড়ফড়ানি থেমে নেই। সভাপতির চেয়ারে নানাকে বসা দেখেই কিনা! আজ হুট করে কেন এলেন তিনি৷ এর আগে-পরে কখনো দেখিনি তাঁকে। মনে পড়ে না আমার। সবাই কথা বলছে এর-ওর সাথে। আমি দাঁড়িয়ে, নীরব। অস্থির লাগছে আমার। হেডস্যার চুপ করিয়ে দিলেন সবাইকে। কিছু কথা বলে রেজাল্ট ঘোষণা শুরু করলেন। নানার দুপাশে বসেছেন শিক্ষকেরা। গুণিজন। সামনের টেবিলে পুরস্কার সাজানো। ক্লাস ফাইভ থেকে ঘোষণা শুরু। মিনিট কয়েক পরেই চলে এল টু’র পালা৷ হাত টিপে ধরলেন মামা। সম্বিৎ ফিরে পেলাম। হেডস্যারের দরাজ কন্ঠস্বর৷ দ্বিতীয় শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষায় তৃতীয় স্থান অধিকার করেছে—সেতু…
ভেতরটা কামড় দিয়ে উঠল আমার। আর দুজনের ভেতর আমি থাকব তো!
দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছ…নাম মনে নেই ওর। আব্দুল আলিমই ছিল কিনা! আমার চোখ টলটল। আর বাকি একজন! মনে হয় আমি নেই!
হেডস্যারের দরাজ গলার ঘোঘণা ভেসে এল আবার!
প্রথম স্থান অধিকার করেছে…
আনন্দ-দানো যেন দাঁত বসাল, বুকে। মামা আবার হাত চেপে ধরে সামনে এগিয়ে যেতে বলেন৷ টলটল চোখে গিয়ে নানার হাত থেকে পুরস্কার নিই। একটা লাইফবয় সাবান। একটা কলম। হাতে তুলে দেন নানা। হাসিমুখ। আমার চোখে জল। আর ঠোঁটের কোণে উনিশ টাকার রাজ্যজয়ের হাসি।
অনুষ্ঠান শেষেই বাসে চেপে বসি৷ মামা আর আমি। গন্তব্য—মানিকগঞ্জ৷ খালার বাড়ি৷ ছুটির কটা দিন ওখানেই কাটাতে হবে৷ আহা দিন!
ছোট মামা এখন সুইজারল্যান্ড। স্যাটেলড। বিয়ে-থা করেছেন৷ কচিকাঁচাও আলো দেখেছে দুনিয়ার৷ আমি ঢাকা। কত কত দিন দেখা নেই আমাদের! কথাও না! বাড়ি ফেরারই অবসর নেই৷ আর তো নানাবাড়ি! যেন-বা কত দূর! মুলতান খানের শেষ প্রদীপের আলো এখনো হায়াতে৷ হারিকেনের আলোয় না-হোক, সেই প্রদীপের আলোয় অন্তত বই খুলে বসতে চাই। আরেকটাবার।
সাপনো কা ও আগান কাহাঁ?
বাচপান বাতা, দারপান কাহাঁ?
সিধা সারাল থা জীবান জাহাঁ…
দারপান বাতা, বাচপান কাহাঁ?
জানুয়ারি ২০২২